শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ওজন স্কেল কেন চট্টগ্রামের ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের অপচেষ্টা শিগগির থামান

50

আ ব ম খোরশিদ আলম খান

চট্টগ্রামকে বলা হয় দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী। কথাটি শুনতে চট্টগ্রামবাসীর খুবই না ভালো লাগে। কিন্তু চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে চট্টগ্রাম-বিদ্বেষী আচরণও আজ অনেকটা স্পষ্ট। সরকার বলছে মহাসড়কে প্রতি ট্রাকে ১৩ টনের বেশি পণ্য পরিবহন করা যাবে না। তাই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সীতাকুÐের বড় দারোগাহাটে এবং কুমিল্লার দাউদকান্দি টোল প্লাজায় স্থাপন করা হলো ওজন নিয়ন্ত্রণ স্কেল। সারা দেশে আরও অনেক মহাসড়ক আছে। ওই সব মহাসড়কে দিব্যি প্রতি ট্রাকে ১৮/১৯/২০ টনের বেশি পণ্য পরিবহন করা হলেও ব্যতিক্রম শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। উক্ত দুটি ওজন স্কেল বসিয়ে বাস্তবে চট্টগ্রামের ব্যবসা বাণিজ্যেরই বারোটা বাজানো হচ্ছেÑতা কী আদৌ অস্বীকার করা যাবে? ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বসানো এই ওজন স্কেলের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা নানা সময়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দেখালেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এতে সরকারের টনক নড়ছে না। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের দাবি শোনার যেন কেউ নেই। বছর বছর ধরে ওজন স্কেলের ফাঁদে পড়ে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা বড় আর্থিক ক্ষতির শিকার হলেও সরকার কেন ওজন স্কেলের খড়গ থেকে চাটগাঁবাসীকে মুক্তি দিচ্ছে নাÑতা এক বিরাট রহস্যই বটে। তা কী মহলবিশেষের চট্টগ্রামের ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের অপচেষ্টা নয়?
‘মহাসড়কে ওজন স্কেল প্রত্যাহারে ব্যবসায়ীদের ঐক্য’ শিরোনামে চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় ১৯ সেপ্টেম্বর (২০২২) প্রথম পাতায় প্রকাশিত প্রতিবেদন পড়ে ওজন স্কেল বিষয়ে অনেক কিছু জানা গেল। দেশের অন্য সব মহাসড়ক বাদ রেখে কেবল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দুটি স্থানে ওজন স্কেল বসিয়ে চট্টগ্রামের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে এবং এটি চরম বৈষম্যমূলক পত্রিকার প্রতিবেদনের মাধ্যমে তাই আমরা জানতে পারছি। ওজন নিয়ন্ত্রণ স্কেলের কারণে চট্টগ্রামের বৃহৎ পাইকারি বাজার চাক্তাই খাতুনগঞ্জের ব্যবসা বাণিজ্যেও ধস নামছে বলে ব্যবসায়ীদের বরাতে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। মহাসড়কের সুরক্ষায় যদি ওজন স্কেল বসানো হয়, তাহলে দেশের অন্যান্য মহাসড়কেও কেন বসানো হয়নিÑ এই জিজ্ঞাসা চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী নেতাদের ও সর্বস্তরের ব্যবসায়ীদের। এতেই মূলত চট্টগ্রাম বিদ্বেষ স্পষ্ট। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, ওজন স্কেল যদি বসাতেই হয়, তাহলে শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কেন, দেশের সব মহাসড়কেও এমন ওজন স্কেল বসানো হোক। এতে তখন তাদের আপত্তি থাকবে না। চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মুহাম্মদ মাহবুবুল আলমও এ ব্যাপারে বারবার সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। চট্টগ্রামের অন্যান্য ব্যবসায়ী নেতা-সংগঠনগুলোও আজ এ দাবির সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করছেন।
ব্যবসা-বাণিজ্যে চট্টগ্রামের বিশেষ ঐতিহ্য ও সুনাম রয়েছে। দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রামে অবস্থিত। এই সমুদ্র বন্দরকে ঘিরে যেভাবে ব্যবসা বাণিজ্য প্রসারিত হওয়ার কথা, বিভিন্ন সময়ে সরকারগুলোর নানা বিমাতাসুলভ আচরণ ও বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্তের কারণে চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এখানকার ব্যবসায়ীদের দুর্ভোগেরও যেন শেষ নেই। পদে পদে তারা বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এক সময় চাক্তাই খাতুনগঞ্জ থেকে সারা দেশে ভোগ্যপণ্য সরবরাহ করা হতো। এখন সেই জৌলুস হারাতে বসেছে চট্টগ্রাম। দেশের অন্য অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা প্রতি ট্রাকে ১৮/২০ টন পর্যন্ত পণ্য আনা-নেয়া করতে পারছেন। অথচ চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা ওজন স্কেলের কারণে প্রতি ট্রাকে ১৩ টনের বেশি পণ্য পরিবহন করতে পারছেন না। এতে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের পরিবহন খরচ দিন দিন বাড়ছে। তারা অসম প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হচ্ছেন। বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দুটি স্থানে ওজন নিয়ন্ত্রণের খড়গ থাকায় চট্টগ্রামের ব্যবসা বাণিজ্যও ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে এবং অন্য জায়গায় স্থানান্তর হয়ে যাচ্ছে বলে ব্যবসায়ীরা বেশ আক্ষেপের সঙ্গে বলছেন।
এখন মহাসড়কে ওজন নিয়ন্ত্রণের কারণে বাল্ক ক্যারিয়ারে আসা বেশিরভাগ পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর থেকে লাইটারেজ জাহাজে করে নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জে চলে যাচ্ছে বলেও পত্রিকার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন সরকারি মহলে নানা দেন দরবারও কম হয়নি। তবুও রহস্যজনক কারণে প্রতিকার মিলছে না বলে ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ ক্ষোভের সঙ্গে জানাচ্ছেন। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের একটাই দাবি, ওজন স্কেল স্থাপন করতে হলে কেবল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কেন, সবগুলো মহাসড়কে স্থাপন করতে হবে। এই বৈষম্য কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। বর্তমান ওজন স্কেলের কারণে পণ্য পরিবহন খরচ বাড়ায় প্রভাব পড়ছে পণ্যমূল্যের ওপর। যার খেসারত দিতে হচ্ছে ভোক্তা সাধারণকে। সরকারি তরফ থেকে সারা দেশের মহাসড়কগুলোতে পর্যায়ক্রমে ওজন স্কেল বসানো হবে বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ছাড়া অন্য কোথাও বসানো হয়নি। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের আক্ষেপ ও আপত্তি মূলত এখানেই। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা প্রতি ট্রাকে ১৩ টনের বেশি পণ্য পরিবহন করতে পারছে না, অন্যদিকে দেশের অন্য এলাকায় মহাসড়কে ১৮/২০ টনের বেশি পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে কোনো বিধি নিষেধ নেই তা কী চরম বৈষম্যমূলক ব্যাপার নয়? একটি দেশে একেকটি অঞ্চলের জন্য একেক বিধি নিষেধ কেন? ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে স্থাপিত ওজন স্কেলের ধকল সইতে হচ্ছে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের। কী দোষ চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের? কেন এই বঞ্চনা? এর মাধ্যমে চট্টগ্রামের ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের অপচেষ্টা হচ্ছে না তো! সরকারি এই অবিবেচক পদক্ষেপের খেসারত আর কতদিন দিতে হবে চাটগাঁবাসীকে?
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের প্রাণের দাবি একটাই। হয় সারা দেশে সব মহাসড়কে ওজন স্কেল বসানো হোক। না হয় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বসানো ওজন স্কেল প্রত্যাহার করে সবার জন্য একই নিয়ম করা হোক। আশাকরি, জনগণের সরকারের কাছে জনদাবি উপেক্ষিত হবে না। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের দাবি আমলে নিয়ে এখানকার ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার নির্বিঘœ করা হোকÑএটাই প্রত্যাশা। চট্টগ্রামের উন্নয়ন দেখভাল করার দায়িত্ব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার, এক যুগ আগে করা তাঁর এই অঙ্গীকার তাঁকে আমরা স্মরণ করে দিচ্ছি। এ সরকারের আমলে চট্টগ্রাম হোক সত্যিকার অর্থে বাণিজ্যিক রাজধানী। প্রসারিত হোক চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্য। অপসৃত হোক সকল বাধা প্রতিবন্ধকতা। কেননা, চট্টগ্রাম বাঁচলেই তো বাঁচবে দেশÑতা যেন আমরা মনে রাখি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! ওজন স্কেল বসিয়ে চট্টগ্রামের ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের অপচেষ্টা থামাতে এখানকার ব্যবসায়ী সমাজ সরাসরি আপনার নির্দেশনার অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে। প্লিজ, আপনি চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের দিকে একটু মানবিক দৃষ্টি দিন।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট