শীতের হিমেল হাওয়ায় স্বাদের পিঠা-পুলি

184

বাংলার লোক-সংস্কৃতিতে পিঠা-পুলি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। বিশেষ করে শীত ঋতুতে বাংলার ঘরে ঘরে তৈরি হয় হরেক রকম পিঠা। পৌষের মাঝামাঝি চারিদিকে বিরাজ করছে হিমেল হাওয়া। এমন দিনে গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে পিঠা তৈরির ধুম পড়ে। গাঁয়ের বধূরা ব্যস্ত সময় কাটান চুলার পাশে। তৈরি করেন ভাপা পিঠা, নকশি পিঠা, চিতই পিঠা, রস পিঠা, ডিম চিতই, দোল পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা, পাকান, জামদানি পিঠা, হাঁড়ি পিঠা, চাপড়ি পিঠা, চাঁদ পাকান, সুন্দরী পাকান, পুলি, পানতোয়া, মালপোয়া, মালাই, কুশলি, ক্ষীরকুলি, ঝালপোয়া, সূর্যমুখী, নারকেলি, সিদ্ধপুলি, ভাজা পুলি ও দুধরাজসহ বিভিন্ন ধরনের পিঠা।
তবে চট্টগ্রাম অঞ্চলে শীতের পিঠা বলতে ভাপা পিঠা বা ‘ধুঁই’ পিঠাকে বোঝায়। এছাড়াও তৈরি হয় চিতই বা চিতল পিঠা, পুলি পিঠা এবং পাটিসাপ্টা পিঠা। কনকনে শীতের দিনে খেজুর রস, নারকেল এবং দুধ দিয়ে ভাপা পিঠা খাওয়ার মজা বলে বোঝানো যাবে না। এক বাড়িতে পিঠা তৈরি করলে আশেপাশের কয়েক বাড়িতে চলে যায়। দাওয়াত করে খাওয়ানো হয় বন্ধু-বান্ধবদের। শীতের দিনে পিঠা নিয়ে আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া চট্টগ্রামের গ্রামীণ ঐতিহ্য। ভাপা পিঠা, খেজুরের রস, মুরগি অথবা গরুর মাংস রান্না করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় মেয়ে, ছেলে কিংবা বোনের শ্বশুর বাড়িতে।
তবে গ্রাম বাংলার আবেগমাখা ভালোবাসা শহরে অনুপস্থিত। ইট-পাথরের এই ব্যস্ত নগরীতে কার খোঁজ কে নেয় ? যার পয়সা আছে সে থাকে গ্লাস লাগানো আবদ্ধ ফ্ল্যাটে। সেখানে বউ-বাচ্চা নিয়ে শীতের পিঠা বানিয়ে খেলেও কারো নাকে সুগন্ধি আসার কথা না। আবার যার পয়সা কম সে থাকে কোনো বস্তি বা কলোনিতে। এরকম মানুষের যা আয় তা দিয়ে কোনো রকম খেয়ে পরে দিন চলে। শীতের মৌসুমে পিঠা তাদের জন্য বাড়তি ঝামেলা। আবার যারা বিভিন্ন মেসে ব্যাচেলর থাকেন তারাও তৈরি করতে জানে না বলে থেতে পারে না শীতের পিঠা। তবে এসব মানুষের একমাত্র ভরসা নগরীর অলিতে-গলিতে পসরা সাজিয়ে বসা পিঠা বিক্রেতা। রাস্তার পাশে বা ফুটপাতে টংয়ের মতো ছোট জায়গায় তৈরি করছে পিঠা। ভিতরে দেওয়া হচ্ছে নারকেল এবং গুড়। আকার ভেদে প্রতিটি পিঠা বিক্রি হচ্ছে ৫-১০ টাকায়।
নগরীর অলি-গলি কিংবা বাসস্ট্যান্ড যেখানে লোক সমাগম হয় সেখানে ছোট জায়গায় চুলা বসিয়ে তৈরি হচ্ছে শীতের ভাপা পিঠা। নগরীর বহদ্দারহাট মোড়ে একটি পিঠার দোকানে জড়ো হয়েছেন কয়েকজন পথচারী। বিক্রেতা একটি একটি করে পিঠা বানিয়ে ডালায় রাখছেন। অমনি পাশে দাঁড়ানো উৎসুখ পথচারীদের কেউ প্লেট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাওয়া শুরু করে দিয়েছেন। আবার কেউ দু-চারটে পিঠা কাগজে মুড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বাসায়। বলতে গেলে ব্যস্ত সময় কাটছে পিঠা বিক্রেতা জসিমের। তার বাড়ি উত্তরবঙ্গের কুড়িগ্রাম জেলায়। বছর তিনেক আগে ঢাকা শহরে শুরু করেছিলেন পিঠা বিক্রি। প্রথমবারের মত বিক্রি করছেন চট্টগ্রামে। প্রতিদিন নগরীর বিভিন্ন মোড়ে ঘুরে ঘুরে পিঠা বিক্রি করছেন তিনি। ১ কেজি চালের গুড়া দিয়ে তৈরি হয় ১৮-২০টি পিঠা। তিনি বলেন, ঢাকার মানুষের চেয়ে চট্টগ্রামের মানুষ একটু ভিন্ন। তবে বেচা-বিক্রি ভালো হচ্ছে। প্রতি দিন ১ হাজার থেকে ১২শ টাকার মত পিঠা বিক্রি হয়। যেখানে আমার লাভ হয় ৬ শ টাকার মত।
গ্রামে খেজুরের রস দিয়ে খাওয়া হয় মায়ের হাতে বানানো পিঠা। তবে শহরে সে সুযোগ নেই, লেখাপড়ার সুবাদে চট্টগ্রাম শহরে ব্যাচেলর। তাই পিঠার দোকানে দাঁড়িয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর চেষ্টা। কথাগুলো বলছিলেন অনার্স পড়ুয়া ছাত্র রিদুয়ান। বাড়ি বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের উপজেলা টেকনাফে। তিনি বলেন, পড়ালেখার ব্যস্ততায় বাড়িতে খুব একটা যাওয়া হয় না। তবে মোড়ে এরকম ভাপা পিঠা দেখলে লোভ সামলে রাখা কঠিন। তাই শখের বসে পিঠা খাওয়া।
প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় আমাদের আবেগ-অনুভূতিগুলো পরিবর্তিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। হায়িয়ে যেতে বসেছে আমাদের আবহমানকাল ধরে চলমান ঐতিহ্য। যার ফলে মানুষের সাথে মানুষের দূরত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে দিনদিন। শীতের পিঠার ঐতিহ্যও এভাবে হারিয়ে যাচ্ছে দিনদিন। হারিয়ে যাওয়া এই ঐতিহ্যকে তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার লক্ষ্যে প্রতিবছর চবি ক্যাম্পাসসহ বিভিন্ন জায়গায় পিঠা উৎসবের আয়োজন করে আসছে ‘লোকজ সাংস্কৃতিক সংসদ’ নামের একটি সংগঠন। সংগঠনের সহ-সভাপতি রায়হান সুমন বলেন, আবহমান বাংলার লোক-সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে লোকজ সাংস্কৃতিক সংসদ। ব্যস্ত শহরের মানুষের সাথে গ্রামীণ ঐতিহ্যের সম্মিলন ঘটাতে আমাদের এই উদ্যোগ। আমরা মনেকরি আমাদের সবার প্রচেষ্টায় নতুন প্রাণ ফিরে পাবে হারাতে বসা এই ঐতিহ্য।