শিশুদের দেশপ্রেম ও নৈতিক শিক্ষায় উজ্জীবিত করতে হবে

7

আজ জাতীয় শিশু দিবস ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। গোপালগঞ্জের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছায়া সুনিবিড় ছোট্ট একটি গ্রামের নাম টুঙ্গীপাড়া। গ্রামটির কোল বেয়ে বয়ে যাওয়া মধুমতী নদী। এই গ্রামেই ১৯২০-র ১৭ মার্চ জন্মেছিল এক শিশু। ছোটবেলায় বাবা-মা আদর করে তাকে ডাকতেন খোকা বলে। ছোট্ট গ্রামের এ ছোট্ট খোকা একদিন হলেন বাঙালির বড় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। অবশ্য নামটি রেখেছিলেন তাঁর মাতামহ। আর শেখ মুজিবুর রহমান থেকে বঙ্গবন্ধু; এবং সব শেষে জাতির জনক স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। কথায় বলে উঠন্তি মূলো পত্তনেই চেনা যায়। অথবা সকাল বলে দেয় সারা দিনের কথা। পেছন ফিরে দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না শিশু খোকা কেন ও কীভাবে বঙ্গবন্ধু হয়েছিলেন। শিশুটির বেড়ে ওঠা জীবনের অনেক ঘটনা ছিল যা বলে দিয়েছিল এই খোকা আর দশটি সাধারণ খোকার মতো নয়; এই খোকা ব্যতিক্রমী খোকা ছিল। কালক্রমে এই ব্যতিক্রমী খোকা হয়েছিল বাঙালির ব্যতিক্রমী নেতা।
কিশোর খোকা জীবন শুরুর দিকে একটি ঘটনা। ১৯৩৮ সাল। খোকা তখন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। স্কুল পরিদর্শনে এসেছেন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক। সঙ্গে ছিলেন শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। স্কুল পরিদর্শন শেষে তাঁরা ফিরে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তাদের পথ আটকে দাঁড়ালেন এই কিশোর শেখ মুজিবুর রহমান। সবাই বিস্মিত, কিছুটা বিব্রতও। প্রধানশিক্ষক হতভম্ব ও ক্রুদ্ধ। কিন্তু কেন এই দুই বিশাল ব্যক্তিত্বের পথ আটকানো? কোনো দ্বিধা বা জড়তা ছাড়াই এই কিশোর দাবি করলেন যে, স্কুল ছাত্রাবাসের ছাদ দিয়ে পানি পড়ে; তা মেরামতের ব্যবস্থা না করে মন্ত্রী দু’জন যেতে পারবেন না। কিশোরের সাহস আর দৃঢ়তা দেখে মুগ্ধ শেরে বাংলা জানতে চাইলেন, ছাত্রাবাস মেরামত করতে কত টাকা লাগবে। হিসেবটা আগেই করা ছিল বলেই ভবিষ্যতের বঙ্গবন্ধু উত্তর দিয়েছিলেন: বারো ’শ টাকা। টাকা তাৎক্ষণিক বরাদ্দ হলো, ছাত্রাবাসটিরও মেরামত হলো। একজন কিশোরের সাহস আর দৃঢ়তার জন্য তা সম্ভব হয়েছিল, স্কুল প্রশাসনের কোনো ভূমিকার জন্য নয়। নেতৃত্ব হঠাৎ গজিয়ে ওঠে না; নেতৃত্ব জীবনের শুরু থেকে সাধনার ফসল।
শিশু-কিশোর খোকা কালক্রমে যখন বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি হলেন তখনো শিশু-কিশোরদের ভোলেননি। শিশুঅন্তর মানুষ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন তাই সংগত কারণে জাতীয় শিশু দিবস। বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোরদের বড় ভালোবাসতেন। বঙ্গবন্ধু শৈশবে বা কৈশোরে স্বাধীনতা ভোগ করেছেন, বাঁধনহারা আনন্দে দিন কাটিয়েছেন। ঠিক একইভাবে বাংলাদেশের শিশু-কিশোররা যাতে হেসেখেলে মুক্তচিন্তায় মুক্ত মনে বেড়ে ওঠার সুযোগ ও পরিবেশ পায় সে কথা তিনি ভাবতেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চ। কিন্তু তিনি সেদিন আনুষ্ঠানিক জন্মদিন পালন না করে শিশুদের নিয়ে আনন্দঘন সময় কাটাতেন। ’৭১-এর ১৭ মার্চ তিনি একজন বিদেশি সাংবাদিককে বলেছিলেন, ‘আমার জন্মদিনই কী। আর মৃত্যুদিন বা কী?’ অবশ্য আমরা তার জন্ম-মৃত্যুদিন পালন করি বিবেকী দায়বদ্ধতা থেকে।
১৯৭২-এর মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় সফরে সোভিয়েত ইউনিয়ন গিয়েছিলেন। সে সময়ে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পরামর্শে দাদাভাই রোকনুজ্জামান খান মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা, পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারের অত্যাচারের দৃশ্য নিয়ে ৫ থেকে ১২ বছরের ১৫-১৬ জন শিশুর আঁকা ছবি সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভকে উপহার হিসেবে দেয়ার জন্য গণভবন ‘সুগন্ধা’য় যান এবং বঙ্গবন্ধু মুগ্ধ হয়ে বললেন, ‘আমার দেশের শিশুরা এমন নিখুঁত ছবি আঁকতে পারে, এসব না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।’ তিনি আরো বলেছিলেন, ‘আজকের কর্মব্যস্ত সারাটা দিনের মধ্যে এই একটুখানি সময়ের জন্য আমি শান্তি পেলাম। শিশুদের সান্নিধ্য আমাকে সব অবসাদ থেকে মুক্তি দিয়েছে।’ ১৯৭৪-এ গুলিস্তান সিনেমা হলের সামনে তখনকার শিশুপার্কে আয়োজিত শিশুমেলা শেষে সমবেত শিশুরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যায়। শিশুরা চাইলেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে পারত। সবার হাতে মিষ্টির প্যাকেট তুলে দেয়ার সময়ে বঙ্গবন্ধু একে একে সব শিশুর নাম শুনলেন। একটি শিশু তার নাম মুজিবুর রহমান বলায় বঙ্গবন্ধু আদর করে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, ‘পেয়েছি, আমার মিতাকে পেয়েছি।’
বঙ্গবন্ধু শিশু উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট চারটি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এক) শিশু কল্যাণের জন্য মায়েদের সম্পৃক্ত করে প্রতিষ্ঠা করেন মা ও শিশু কল্যাণ অধিদপ্তর। দুই) শিশুর সার্বিক উন্নতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় শিশু একাডেমি। উল্লেখ্য, এ দুটো প্রতিষ্ঠানসংক্রান্ত ভাবনা-পরিকল্পনা বঙ্গবন্ধুর সবসময়ই ছিল। তিন) শিশুর শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে ১৯৭৩-এ ৩৭,০০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়। বাংলাদেশের সে সময়ের সার্বিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সিদ্ধান্তটি ছিল সাহসী ও যুগান্তকারী। চার) ১৯৭৪-এর ২২ জুন শিশু আইন জারি করা হয়। এ আইন শিশু অধিকারের রক্ষাকবচ। ১৯২০-র ১৭ মার্চ যে শিশুটির জন্ম হয়েছিল সে আজীবন ছিল শিশুর মতো সরল। আজ জাতীয় শিশুদিবসে বঙ্গবন্ধু প্রণিত পদক্ষেপ তথা শিশুসনদ বাস্তবায়নে এগিয়ে এসে দেশের সকল শিশুর অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি।