শাহীন মাহমুদের কবিতা ভাষা ও ভাবনা

133

 

আমাদের অধিকাংশ কাব্য-রসিক, কবি-সাহিত্যিক ও সাহিত্যের শিক্ষকগণ কবিতার রূপ দেখে মুগ্ধ হন; প্রতিষ্ঠিত-শক্তিশালী কবিগণের বন্দনা করেন। তাঁরা কর্পোরেট কবিদের নামের আগে বিশেষণ বসাতে ব্যস্ত হন। কিংবা তাঁদের ভাষায়Ñ দুর্বল কবিদের তুচ্ছ রচনাগুলোর উপর বিরূপ মনোভাব ব্যক্ত করেন। তাঁরা ভুলে যান সাহিত্য-সমালোচকের কাজ কেবল বাইরের রূপ-শোভা নয়, মূলের রহস্য সন্ধান করা। সমালোচককে তাই উৎকৃষ্ট-নিকৃষ্ট সকল শ্রেণির কবিকেই সাহিত্যের আঙ্গিনায় আমন্ত্রণ জানাতে হয়; অভ্যর্থনা করে আনতে হয়। কেননা, ‘সাধারণ কবির তুচ্ছ রচনা জমিয়া জমিয়া যে পলিমাটি সৃষ্টি করে, সেই উর্বর জমিতেই অসাধারণ কবির অঙ্কুরোদ্গম সম্ভব হয়’ (তারাপদ, ১৯৫৪: ৪৪)। অন্যভাবে দেখলে, সমালোচক মূলত বিশ্লেষণ করতে পারেন শিল্পসৃষ্টির উপকরণের বৈশিষ্ট্যকেই- শিল্পের সমগ্রতাকে নয়, কারণ তা অসীম, আর অসীমের স্বরূপকে ভাষা দেওয়া যায় না (আবিদ, ২০১৮: ৩১)। সে-চেষ্টাও তাই অবান্তর। বর্তমান আলোচনায় তাই কবি শাহীন মাহমুদ (জ. ১৯৭১) রচিত পাঁচটি কাব্যগ্রন্থের আলোকে কবির কাব্যভাষা ও ভাবনা-বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করবার প্রয়াস মাত্র।
নির্বাচিত প্রেমের কবিতা (১৯৯৭) কাব্যগ্রন্থ দিয়েই কবির কাব্যযাত্রা শুরু; যদিও নব্বই দশকের শুরু থেকেই কথাসাহিত্য নিয়ে শাহীন মাহমুদের সাহিত্য-সৃষ্টিতে শুভাগমন ঘটে। তবু লেখকের প্রকাশিত কথাসাহিত্য বা উন্যাসগ্রন্থের নামগুলোও কাব্যিক-অন্তর্গূঢ় দিশা (১৯৯৪), ছুঁয়ে দাও একবার (১৯৯৭), ও হৃদয়ে তুলির আঁচড় (২০০১) নামগুলোও লেখকের কবিপরিচয়কে প্রকাশ করে দেয়। এই পদ্মার পললে গড়ে ওঠা বাংলার প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে কবি অনুভব করেন, ‘নদী, নারী-ভালোবাসার কথা বলে-/ নারী আবার নদী হয়ে ডুব দেয় অতলে/ নদীর মতো নারী সূর্যস্নানে মেতে ওঠে/ খোলস পাল্টায় বিষুবরেখা পারের নেশায়।’ (‘নদী’, নির্বাচিত প্রেমের কবিতা)। বিশ শতকের শেষ দশকে দাঁড়িয়ে নারী, নদী আর জীবনানন্দের শঙ্খচিল মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় কবির উপমায়-কাব্যভাষায়। তাঁর কাব্যকুশলতায় উচ্চারিত হয়: ‘নদী, শঙ্খচিল, কালো মেঘ এসব যেন তারই উপমা/ শঙ্খচিলের কান্নায় ঘুম ভাঙে/ হৃদয় পুড়ে খাঁক হয়-’ (‘ভালোবাসার জলছাপ’, নির্বাচিত প্রেমের কবিতা)। এভাবেই জেগে ওঠেন কবি শাহীন মাহমুদ। মানবিক হৃদয় তাঁর সৌরলোক থেকে আসা পৃথিবীর পার্থিব আলোয় পুড়ে খাঁটি হয়। পৃথিবীর প্রিয়তমার প্রেমে তাই কবির উপমাময় উচ্চারণ, ‘পেরেকবিদ্ধ প্রজাপতি মন ডানা ঝাপটাই কেবল/ বেঁচে থাকা, স্বপ্ন বিভোর, আহত দৃষ্টি/ তোমার জন্য সবি’ (‘কষ্টের মিছিল’, নির্বাচিত প্রেমের কবিতা)। তবু তীব্র-গভীর সকল প্রেম ধরাধামে সকলেরে ধরা দেয় না। সত্যি সত্যি সকলে প্রেমে সফল হয় না বা প্রেমাস্পদকে পার্থিব জগতে জয় করতে হয়তো পারে না। কখনও এই বেদনাময় বিলাপ শৈল্পিক কবিতা হয়ে ব্যক্ত হয়; ব্যক্তিকে কবিতে রূপান্তরিত করে। হৃদয়ের হাহাকার ধ্বনিত হয় কবিতার শরীরে, ‘চার্লস থেকেও নেই/ ফুল্লরা-পঞ্চাশ টাকায় রাত জাগে-/ স্বপ্নের এলিয়েদা উড়ে যায়-দূর থেকে দূরে-/ ঠিক তোমার মতো করে-।’ (‘অবাঞ্ছিত ভালোবাসা’, নির্বাচিত প্রেমের কবিতা)। প্রথম প্রকাশিত এ কাব্যগ্রন্থে ইঙ্গ-মার্কিন ড্যাডিজম বা দাদাবাদের প্রভাব লক্ষণীয়। বলা যেতে পারে আধুনিক কবিতার শিল্পকুশলতার পথে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তরুণ কবির অভিসার আরম্ভ হয় এই কাব্য থেকেই। তবু এ কাব্যে কিছু বানান বিভ্রাটজনিত অযত্নের ছাপ পাঠকের চোখে পীড়াদায়ক। এমনকি প্রেমের কবিতায় ‘ভালবাসা’ বানানটিও প্রমিত নয়। অবশ্য এ-দায় একা কবির নয়। প্রকাশক-সম্পাদকও এ-দায় থেকে মুক্তি পেতে পারেন না। আবার সারা বছর বাদ দিয়ে ফেব্রæয়ারিতে বই প্রকাশ-প্রবণতাও এমন বিড়ম্বনার কারণ হতে পারে।
প্রসব্য প্রণয় (২০১৬) কাব্যের প্রথম কবিতা থেকেই কবি শাহীন মাহমুদ আরও বেশি শব্দ-সচেতন। বৃষ্টিস্নাত বাংলায় ঘন বরষার দিনে কাব অনুভব করেন, ‘তুমুল বৃষ্টিতে কাঁপছে শব্দমালা’। কেননা, স্বপ্নের সোনার বাংলায় তখনও তমুল বৈপরিত্ব; কবির ভাষায়: ‘ভাদ্রের তুমুল বৃষ্টিতে আষাঢ় অসাড়,/ শ্রাবণ ভুলের মাশুল।’ (‘উড়ছে সন্তাপ সনদ জলজ দর্পণে’, প্রসব্য প্রণয়)। তাইতো কবি দেখতে পান চারিদিকে কেবল হাহাকার-অনুতাপ-সন্তাপ। বেদনা বিদুর বিদীর্ণ দর্পণে দৃশ্যের পর দৃশ্য সাজিয়ে কবি তোলে আনেন সমকাল থেকে উড়ন্ত ‘সন্তাপ সনদ’। তবু আশার ভরাডুবি কিংবা ভাদ্রের ভুলগুলো নিয়েই মশগুল মনে হয় না কবি শাহীন মাহমুদকে। কেননা তাঁর হৃদয়ের হরিৎ উপত্যকায় বাংলার ষড়ঋতুর মতোই ভাদ্রের পর আশ্বিন আসে-শুভ্র কাশফুল ফোটে। আর তখন প্রিয়তমাকেও মনে হয়-‘শারদের কাশফুল তুমি/ কবির পাঁজরে বেড়ে ওঠা পাহাড়ি তুমি, নিজেকে আড়াল করো শব্দ কুঠারে।/ শারদ বালিকা তুমি জ্ঞানপাপী জাগতিক নারীমূর্তি।’ (‘শারদ মেঘের ফুল তুমি’, প্রসব্য প্রণয়)। এ জ্ঞানপাপীর খপ্পর থেকে কি পালাতে চান কবি? তাই কি আশ্রয় খোঁজেন প্রকৃতির কাছে, বাহু বাড়ান বিটপীর পানে। তাই হয়তো বিটপী সারির সান্নিধ্যে অনুভব করেন- ‘নিশ্চুপ বিটপী খুঁজে প্রেম-খুঁজে মানসের মানত দ্রাক্ষা/ আদিম যুগল খোঁজে ডাকটাইল ভালোবাসা।’ (‘ডাকটাইল ভালোবাসা বিদ্রুপে বিটপী’, প্রসব্য প্রণয়)। তবু উন্মুখ প্রান্তরে নিসর্গের নিবিড় ছোঁয়া পেয়ে কবি যখন উদার-অসীম নীলিমায় নয়ন রাখেন, তখন নীল বেদনায় বিমূঢ় কবি উপলব্ধি করেন, ‘নিরুদ্দেশ নীলিমা-হাওয়া মিঠাই প্রেম/ হৃদয় পোড়া ইচ্ছের শাম পাপড়ি। তোমাকে দেখার সাধ দীপ্ত, অমলিন? মরে গেছে স্বপ্নের ধবল বক-পিছুটান দুর্বোধ্য মায়ার জাল? জিওল অশরীরী।’ (‘প্রসব্য প্রণয়’, প্রসব্য প্রণয়)। কবি তাই পৌরাণিক কৃষ্ণের মতো বিরহে কাতর। বসন্তের বাতাসে বিমুগ্ধ বাঙালি বাউল আবার আশায় বুক বাঁধেন আর আহব্বান জানান কাব্যলক্ষী প্রিয়তমাকে-
‘বসন্তের হিরণ্ণয় সন্ধ্যায়
চল ঘর বাঁধি
নাগেশ্বর ফুল পাপড়ির বুকে-
চল হারিয়ে যাই এই ফাগুনের রাতে।’(‘নাগেশ্বর হাতে ঠাঁই দাঁড়িয়ে’, প্রসব্য প্রণয়)।
প্রিয়তমা আর স্বদেশ নদী ও নারীর মতো একাকার হয় কবির কাব্যভাষার জাদুতে। প্রিয়তমা যেনো নদী আর কবি যেনো নাবিকের প্রতীক। প্রিয়তমা আবার সমকালের স্বদেশও; তাই কবি উচ্চারণ করেন-‘রূহানীর বুকে বিঁধে চাদিগাং দেশ/ সুধারামের পঞ্জরে বঙ্গের গান/ দিকহীন নাবিক খুঁজে একশো বছর/ “নুর নামা” খসে পড়ে শণের বাকল/ কবি কিংকর্তব্যবিমূঢ় পড়ে “ঈশ্বরের হাত”।’ (‘বন্ধ্যা কবির ওরসে মীননাথের পদাবলী’, প্রসব্য প্রণয়)। এই পাঠ কবিকে ঋদ্ধ করে, লোক থেকে তাঁকে ব্যক্তিতে উন্নীত করে। ব্যক্তিভাষার আবির্ভাবের সাথে সাথে তাঁর বোধ জাগে আর কলম থেকে ঝরে জীবনদর্শন, ‘জীবনের পূর্ণতা বলে কিছু নেই/ পূর্ণতার পানকৌড়ি ডুব দেয়/ না ডুবা না ভাসা যাদুর লিরিকে/ মাথিনের ভালোবাসা-অপূর্ণতার প্রণয় উপাখ্যান।’ (‘পূর্ণতার সংশয়ে ধবল বক পাখা মেলে’, প্রসব্য প্রণয়)। এমন জীবনদর্শনে জারিত হয়ে কবি শাহীন মাহমুদ অনায়াসে সম্মুখে অবলোকন করেন, ‘বড় দুঃসময় এখন/ মনের অণুগল্পে আফিমের চাষ। নেটওয়ার্কে বন্দী বিবেকের/ কুঠরি। নিসিন্দার তেঁতো বিষফল হয়ে গেছে ভালোবাসা।’ (‘অমনিবাস প্রেমিকাদের প্রণয় উপাখ্যান’, প্রসব্য প্রণয়)। তবু হতাশ নয় কবি। কেননা স্বপ্নহীনতা যে মৃত্যুর আরেক নাম। তাই চরম দুঃসময়েও কবি শাহীন মাহমুদ স্বপ্নবাজ। কবিতার ভাষায়: ‘ভরা পূর্ণিমা যদি আমাকে/ নেশাখোর বানায় ঘুন পোকা যদি নির্ঘুম কাঁদায় আমি রাজি/ আমিও স্বপ্নবাজ’ (‘নির্ঘুম এক রাত্রির গল্প’, প্রসব্য প্রণয়)। স্বপ্নবাজ কবি শুধু নিজে স্বপ্ন দেখেন না, স্বপ্ন দেখান প্রিয়তমাকে। পাঠককেও নিপুণ কাব্যভাষায় নিয়ে যান এক স্বপ্নময় শরীরের স্বপ্নীল ভাজে-‘ফুটবো দারুণ/ লুকানো লাজের ভাজে গোলাপি তিল হয়ে।’(‘আমি গোলাপের কীট’, প্রসব্য প্রণয়)। তবে বাস্তবতা ব্যতিরেকে বেশিক্ষণ রোম্যান্টিকতায় মগ্ন থাকতে পারেন না কোনো আধুনিক কবি। শাহীন মাহমুদও তাঁর ব্যতিক্রম নয়। সমকালে ফিরেন তাই কবি, তুলে আনেন স্বদেশের ছন্নছাড়া অবস্থার ছবি: ‘দোয়েল, শ্যামা, বুলবুলি আর বসে না মাঠে/ সোনালি জমি আজ শ্মশান এক অজানা ঝড়ে।’ (‘কার্তিকের নবান্নে কার্তুজের গন্ধ’, প্রসব্য প্রণয়)। শুধু কি গ্রামেই হাহাকার! না, শহরেও যে বাড়ছে বিপদ।

বিবেকের তাড়নায় কবি তুলে আনেন সে-বিপন্নতার ছবিও।
কবির ভাষায়:
‘ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া
সেই বখে যাওয়া যক্ষের ধন
যার রাত কাটে ইয়াবা আর খঞ্জনের অভিসারে
নির্ঘুম অশ্রুপাত-মায়ের অভিসম্পাত
কোন পাপ আজ বসেছে সিনায়-।’ (‘নিকষ রাত্রিতে ঘরে ফিরে না কিশোর’, প্রসব্য প্রণয়)।
এমন নির্ঘুম রাত কাটানো কবি কখনও বলতে পারেন না ‘আমি কেন রাত ভালোবাসি’। এ কবি তাই রাতকে ভালোবাসেন না; কারণ রাতের নিকষ অন্ধকার ছবি তাঁর চোখে ধরা পড়ে। কেননা তিনি আধুনিক কবি। বর্তমান বাস্তবতার বুকে দাঁড়িয়ে তিনি কাব্যে-গানে গর্বিত হতে চান। সমাজ-রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতাকে এড়িয়ে কেবল শিল্পের জন্য সৃষ্টি করে সুনাম কুড়াতে চান না কবি। কবি তো ‘কবিতার দাস’; সে-কথা তাঁর প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গপত্রেই বলে দিয়েছেন। শুধু কবিতায়-ই নয় ছড়ার স্বরবৃত্ত ছন্দে কবিতা লিখেও শাহীন মাহমুদ দক্ষতার ছাপ আঁকেন। ছড়ার ছন্দে তিনি তাঁর সন্তানদের উপদেশ দেন: ‘টাকা পয়সা সব কিছু নয়/ মানুষ হতে হবে/ ধনী গরীব নেই ব্যবধান/ একি সাথে রবে।’ (‘দুষ্ট বাবুর মিষ্টি ছড়া’, প্রসব্য প্রণয়)। এভাবে শিশুতোষ ছড়ায়ও একটি পরিণত জীবনদর্শন কবি এঁকে দেন।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক কবি শাহীন মাহমুদ জাতির পিতার নির্মম হত্যযজ্ঞের বার্ষিকীতে-জাতীয় শোকদিবসে কেবল শোকগাঁথা উচ্চারণে থেমে যান না। তিনি বেদনা-বিধুর দিনেও স্বপ্ন বুনেন, আশা জাগানিয়া কাব্যভাষায় লিখেন, ‘তবুও ভরা অমাবস্যায় জোছনা নামে/ ৩২নং বাড়িতে ফোটে হাসনাহেনা/ … আবার ক্যাকটাসে ফোটে ফুল।’ (‘শোকার্ত জাতি পিতার শোকে নতজানু’, প্রসব্য প্রণয়)। এই ফুলেল স্বপ্ন দেখতে গিয়েই স্মৃতিপটে ভেসে ওঠেÑফেলে আসা পুষ্পিত সময়ের হারানো আনন্দ-বেদনা। তবু, ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল আজো ফোটে/ রিমঝিম বৃষ্টি-ঝাপসা করে দৃষ্টিসীমা-/ কষ্টের অবেলায়’ (‘একজন রেণু ও একটি কদম ফুল’, প্রসব্য প্রণয়)। সতেরো শতকে সন্দ্বীপের কবি আবদুল হাকিম (১৬২০-১৬৯০) বলেছিলেন, ‘আরবি ফারসি শাস্ত্রে নাই কোন রাগ।/ দেশী ভাষে বুঝিতে ললাটে পুরে ভাগ \’ (‘বঙ্গবাণী’, নূরনামা)। আর একুশ শতকের শুরুতে আরেক সন্দ্বীপ-সন্তান শাহীন মাহমুদ শোনান, ‘আমার বর্ণমালা মাগো-শুধুই তুমি/ নয় আরবি, নয় হিন্দি নয় উরদুয়ানি।’ (‘আমার পূর্ব পশ্চিম বাংলা’, প্রসব্য প্রণয়)। মাতৃভাষা আর মাতৃভ‚মির প্রতি প্রেম থেকে জাত দারুণ দ্রোহের দাবানলে জ্বলেই কবি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘জেগে উঠুক জনকের স্বপ্নডিঙ্গা মুছে যাক শোণিত রক্তজবার করুণ পংক্তিমালা।’ (‘সন্দীপ্ত অগ্নি’, প্রসব্য প্রণয়)। অথচ বর্তমান বাস্তবতায় তা অনেকটাই অসম্ভব ঠেকে। সামরিক শাসনের করাল স্রোতে সময়ের পরিবর্তনে অনেক কিছুই তখন অবাস্তব-আকাশকুসুম কল্পনা মনে হয় যেন। এমনকি যে ‘জয় বাংলা’স্লোগানে প্রকম্পিত হয়েছিল উনিশশ’ একাত্তর-আমাদের গর্বের সময়-বাঙালির রাষ্ট্রের জন্ম-মুহূর্ত। সেই স্লোগান আজ কবিতার শিরোনাম থেকে সরে যায়-কবি-সম্পাদকের কলমের খোঁচায়। কেননা, ‘হিন্দুয়ানির ভয়ে কবি পাল্টে দেয় কবিতার শিরোনাম’ (‘জয় বাংলা’, প্রসব্য প্রণয়)। এমন বীজমস্ত্রের গৌরব ভুলবার কারণও কবি সক্ষোভে সামনে নিয়ে আসেন তাঁর দৃঢ়চেতা কাব্যভাষায়: ‘ভুলবেই তোÑতারা সব জানোয়ার রেখে যাওয়া নষ্টের উত্তম বীজ।’ (‘জয় বাংলা’, প্রসব্য প্রণয়)। এমন পরিস্থিতিতেও তিনি প্রকৃতির লীলাভ‚মি এই বাংলার ষড়ঋতুর কাছে-বৈশাখের কাছে আহব্বান জানান নতুন স্বপ্নের সুর তুলতেÑ‘অভিবাদন নাও প্রিয়তমা বৈশাখ/ ছিন্ন করে দাও পৌরাণিক দেবতার বেড়ী/ বাজাও শঙ্খ নতুন স্বপ্নঠোঁটে।’(‘হে বৈশাখ’, প্রসব্য প্রণয়)। এভাবে নিয়তি বা নিসর্গ-প্রকৃতির কাছে আহব্বান, আকুতি আর অভিবাদন জানিয়ে পূর্ণতা পায় কবির ‘প্রসব্য প্রণয়’।
জেগে ওঠে ফিনি´ পাখি (২০১৭) কাব্যে এসে কবি শাহীন মাহমুদ তাঁর জিজ্ঞাসু কাব্যভাষায় আর তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণী কৌশলে মাতবতার বাণী ফুটিয়ে তোলেছেন। শিল্পঋদ্ধ মনন নিয়ে কবি সাবলীল ভাষায় সৃজন করেছেন তাঁর কবিতার কায়া। প্রায় প্রতিটি কবিতায় কবি এখানে বিচ্ছুরণোন্মুখ। সমকালীন সমাজবোধের তীব্রতা আর তাঁর বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গির প্রখরতায় দ্যোতিত হয়ে ওঠে শেখ হাসিনাকে নিবেদিত কবিতায়। কবি লিখেন, ‘তুমিতো মুজিবের ক্লোন হয়ে জন্মেছো/ এদেশ মুজিবের সোনা মোড়ানো দেশ/ … এদেশ বাঙালির দেশ।’ (‘তুমিতো আগুন বরফের ঔরসে জন্মেছো’, জেগে ওঠে ফিনি´ পাখি)। ধর্মান্ধ-সামরিক ছত্র-ছায়ায় বেড়ে ওঠা এদেশীয় খুনীদের খুঁজে বের করতে কবি কাব্যভাষায় সাধনা করেন আর আহŸান জানান তাঁর পাঠককেও-‘চলুন কাকের ভাষা শিখি, ধরে ফেলি সব গুপ্ত খুনিদের।’ (‘একটি কাক ও মানব সভ্যতার প্রথম খুন’, জেগে ওঠে ফিনি´ পাখি)। অসীম আগ্রহ নিয়ে কবি অধ্যয়ন করে চলেন আমাদের অতীত ঐতিহ্য। কবির ভাষায়: ‘ক্লেদ নগরে শিখি তক্ষশীলার পাঠ।’(‘তক্ষশীলার পাঠ’, জেগে ওঠে ফিনি´ পাখি)। আমাদের অতীত-অহংকার আর ইতিহাসের অমিত পাঠ শেষে কবি তোলে আনেন জাতির পিতার হত্যকারীদের প্রকৃত পরিচয়: ‘তারা ওই হানাদারদের বংশপরম্পরা,/ বাঙালির খোলসে ভিনদেশি বেজন্মা দাগ।’(‘লায়ালপুর ট্রায়াল’, জেগে ওঠে ফিনি´ পাখি)। বাস্তব বাংলাদেশের এই বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতেও কবি তাঁর কাব্যভাষায় কেবল দ্রোহে ফেটে পড়েননি। সমকালীন অনেক বাঙালি কবির মতো কল্পনার মায়াজাল রচনাতে মগ্ন হননি, তিনি পুনর্জাগরণ প্রত্যাশা করেন কবিতায়-‘ফিনিক্স কল্পনায় ভেসে চলি আগুন পাখি হয়ে/ জেগে উঠতে আকুল;’(‘জেগে ওঠে ফিনি´ পাখি’, জেগে ওঠে ফিনি´ পাখি)। এই কাব্যে কবি নিজেকে ‘অতি সাধারণ বাঙালি এক ক্ষুদ্র কবি’ (‘অঞ্জলি লহ মোর কবি নজরুল’, জেগে ওঠে ফিনি´ পাখি) বলে অভিহিত করলেও কাব্য-কুশলতা নৈপুণ্যে তিনি দক্ষতার পরিচয় দেন। নিজস্ব নতুন এক কাব্যভাষা নির্মাণেও তাঁর অবস্থান বেশ দৃঢ়তা লাভ করে এই কাব্যে এসে।
হৃদ্যা আমিও জেগে আছি (২০১৮) কাব্যগ্রন্থে এসে কবি সমকালীনতার পঙ্কিল-পিচ্ছিল মাটিতে দাঁড়িয়ে থেকেও যেনো কল্পনার ডানা মেলে দেন শরৎ আকাশের শুভ্র মেঘের রাজ্যে। তবু বলতে হয় যে, তিনি সমকালের চিত্রকে রূপায়িত করেন কবিতায়। সাহিত্য অন্তপ্রাণ শাহীন মাহমুদ-এর এই সময়ে কবিতার দিকে গভীর মনোনিবেশ লক্ষ্য করে এ কাব্যের সমকালীন সমালোচককেরও মনে হয়েছে যে, এ মুহূর্তে কবিতাই তাঁর একমাত্র আরাধ্য বস্তু (চৌধুরী, ২০১৮)। সমকালীন সমাজ-সমস্যাকে পাশকাটিয়ে তথাকথিত সুশীল-বুদ্ধিজীবীগণের টকশোর নামে টাউট-বাটপাড়ি কবিকে প্রশ্নাকুল করে তোলে। তাই কবিতা দিয়ে কবি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন-‘নির্বোধ জিব আর মগজের কাকতাড়ুয়া/ অসাড় জিব নিয়ে বাঁচো কীভাবে?’(‘ডালিম সমাচার’, হৃদ্যা আমিও জেগে আছি)। এর কারণও কবি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন তাঁর চিত্রময় কাব্যভাষায়: ‘টগবগে তরুণ খাচ্ছে চোলাই মদ মউদুদিনামা,/ আয়না পড়ায় দেখছে বেহেস্তের পুষ্পিত ময়দান।’ (‘পুড়ছে মালাউনের ঘর’, হৃদ্যা আমিও জেগে আছি)। এমন যখন প্রতিবেশ তখন কবির কবিতায় প্রতিধ্বনিত হয়-‘হলি আর্টিজান থেকে নাসির নগর’-সমগ্র বাংলাদেশের যেখানে-সেখানে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসে সন্ত্রস্ত সমাজের হাহাকার। বাঙালির বিপন্ন মানবতার মলিন মর্মযাতনাকে তিনি কবিতায় ধারণ করেন। তাঁর কবিতার পঙক্তি হয়ে উঠে আসে আমাদের জাতির জনকের অনবদ্য অবদান আর তাঁর হত্যাকারীদের প্রতি ধিক্কারের ধনুর্বাণ। শাহীন মাহমুদের কাব্যভাষায় অতি অল্প কথায় চিত্রপটের মতো স্পষ্ট ভেসে ওঠেÑ‘ঐ পুঁজিবাদ আজও রক্ত চায়। ঐ জাগ্রত সাম্রাজ্য এখনও/ পানির দামে কিনতে চায় মানবতা, অলৌকিক শ্রমঘণ্টা।’ (‘হেনরির হাতুড়ি’, হৃদ্যা আমিও জেগে আছি)। বাংলাদেশের আদিবাসী নারীর বেদনার-ভালোবাসার চিত্রও আঁকেন কবি আদিবাসী ভাষাকে নিজের কাব্যভাষায় নিপুণতার সাথে ঠাঁই দিয়ে। তাঁর কাব্যের আদিবাসী তাই প্রশ্ন রাখে, ‘পিরিতি বাড়াইলা কেনে?’ (‘স্বারতী উঁরাও’, হৃদ্যা আমিও জেগে আছি)। এভাবে দ্রোহ-দারুণ বেদনা আর সমকালের সাথে জড়িয়ে যায় কবির প্রেমের-ভালোবাসার রূপক-চিত্রকল্পগুলি। তাঁর কবিতার ভাষা যেমন প্রতিবাদমুখর, তেমনি জনগণের জয়গানেও মুখরিত অনুক্ষণ। আর সব মিলে স্বদেশের সাথে আধুনিক জীবনের নানান অনুসঙ্গ তাঁর কবিতায় এসে ধরা দেয় পার্থিব-মানবিক প্রেমের টানে। এই প্রেমই তাঁর কাব্য-পাঠককে মুগ্ধ করে রাখে, কবিকে দেয় পাঠকপ্রিয়তার মুকুট।
হেম ও তস্করের পদাবলি (২০১৯) কাব্যগ্রন্থে কবি শাহীন মাহমুদ তাঁর স্বভাবজাত নতুন শব্দের সমাবেশ ঘটিয়ে স্বকীয় কাব্যভাষা সৃষ্টিতে সম্যকরূপে সক্রিয় হয়েছেন। তাঁর কাব্যভাষার মায়াবী মন্ত্রমুগ্ধতা আর নন্দনতত্তে¡র সম্মোহনী স্ফ‚রণ পাঠকে বিস্মিত-বিমুগ্ধ করে তোলে। কাব্যগ্রন্থের শুরুতেই দেখা যায়, কবি প্রচলিত পথে নয়- সমকালের প্রায় সবার বিপরীতে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের বীরাঙ্গনার কথা বলতে শুরু করেন এভাবে, ‘এবার তবে নাহয় উল্টো থেকে লিখ রমানামা, তাঁর কিশোরীকাল/ দুরন্ত যৌবনে হায়েনাদের তাড়া খাওয়া উপোসকালের দিনগুলির কথা।’ (‘দুটি রুগ্ন পা ও পাদুকার গল্প’, হেম ও তস্করের পদাবলি)। কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গও করেন একাত্তরের জননী রমা চৌধুরীকে। বাস্তবের বাতাসে কবি উনিশশ’ ছেয়ট্টির ছয়দফাকে দুলতে দেখেন আর উপলব্ধি করেন যে, ছয়দফার ফসল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়। তাইতো তাঁর কাব্যভাষায় তোলে ধরেন-‘আকাশে বাতাসে আজও দোল খায় সেই ছয়টি পাপড়ি/ ফোটে আছে বিজয় ফুল সাতটি পাপড়ি নিয়ে।’ (‘বিজয় ফুল’, হেম ও তস্করের পদাবলি)। এই বাস্তবতার মধ্যেই অবলীলায় প্রবেশ করে অতিবাস্তব আখ্যান; সেখানে, ‘মায়ের বাসন মাজার শব্দ অলৌকিক দেয়াল ঘড়ি’। বাস্তব আর অতিবাস্তব মিলেমিশে এক মায়াময় আবেশ সৃষ্টি হয় কবি যখন লিখেন, ‘ঘুমঘরে দেখি দৌড়ে পালায় যাপিত জীবন/ অনন্ত কাল; এক ভয়ংকর কালো বিড়াল।’ (‘অলৌকিক দেয়াল ঘড়ি’, হেম ও তস্করের পদাবলি)। এভাবে অধিবাস্তববাদের সাথে মিশে বিভিন্ন মতবাদ। তবে মানবিক প্রেমের রসায়নে সব মিলে এক অভিনতুন কাব্যভাষা গড়ে ওঠে, কবি যখন লিখেন, ‘দৈতবাদের ঘোরে অমাবস্যা নামে/ নির্ঘুম চলে ঘাস আর শিশিরের/ ফোটা ফোটা প্রেম।’ (‘আরশি নগর’, হেম ও তস্করের পদাবলি)। এই মানবিক প্রেম আবার আচমকা তাঁকে বাস্তব-জমিনে নামিয়ে আনে।
সেখানকার প্রতিবেশে কবি অবলোকন করেন কিছু ঊনমানুষ আর কর্পোরটে কারবারিদের ক‚টকৌশল। সে দৃশ্য কবিকে ভাবিয়ে তোলে, তাই তিনি লিখেন, ‘একবারও ভাবলে না কর্পোরেট বেশ্যার মতো দাঁড়িয়ে/ ডামট্রাক, কাভার ভ্যান, কিছু ঊনমানুষ রাস্তার দুধার/ ফুটপাতে চাঁদাবাজ প্রহরী।’ (‘এক নিঃস্পৃহ বৈরাগী’, হেম ও তস্করের পদাবলি)। সাধারণ অবলোকনে আমরা যাকে উন্নয়নের সহায়ক দেখি, কবি গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে সেখানে দেখতে পান পুঁজিবাদী কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের কালো হাত। আর তাই তাঁর কাব্যভাষাতেও ‘ডামট্রাক’, ‘কাভার ভ্যান’ ইত্যাদি শব্দ সেই আধিপত্যবাদীদের প্রতীকরূপে প্রতীয়মান হয়। কবি আপন জন্মভ‚মিতে ওমোন উপদ্রব আশা করেন না। কেননা তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, ‘এদেশ মুজিবের সোনা মোড়ানো দেশ/ … এ দেশ বাঙালির দেশ।’ (‘মাদার অব হিউমিনিটি’, হেম ও তস্করের পদাবলি)। শেখ হাসিনাকে নিবেদিত এই কবিতায় কবি তাই মানবতার মা অভিধা দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অভয় বাণী শোনান। আর শেখ মুজিবের চিন্তা-চেতনা ধারণ করে, সেসব বাস্তবায়নে অগ্রসর হবার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেন। এভাবে কবি তাঁর পাঠককে এক সুন্দর আগামীর স্বপ্নও দেখান। কবি নিজে স্বপ্ন দেখেন বলেই পাঠককে স্বপ্ন দেখাতে পারেন। তাইতো কবি তাঁর আত্মপরিচয় দিয়ে লিখেন, ‘আমিতো স্বপ্নবাজ সীমাহীন আকাশ/ রুপোর কাঠিতে ভাঙাই মেঘফুলের ঘুম/ আমিতো তীর ভাঙা ঢেউ’(‘ব্লিডিং হার্ট’, হেম ও তস্করের পদাবলি)। কিন্তু স্বপ্নের আকাশে কবি উড়ে চলেন না তাঁর পা রয়ে যায় এই পৃথিবীর প্রতিবেশে তাই পরক্ষণেই তিনি বলেন, ‘হেমন্ত অরণ্যে আমি মরকুটে বাকল বিষণ্ণ অন্তর্দেশ’ (‘হেম ও তস্করের পদাবলি’, হেম ও তস্করের পদাবলি)। এভাবে সমকালীন বাস্তবতাকে বুকে ধারণ করে কবি বিষণ্ণতাকে বিতাড়িত করে এগিয়ে যান এক শৈল্পিক ও কাল্পনিক এক নন্দনকাননের অভিমুখে। ‘মানুষের সবচেয়ে বড় ক্ষমতা বুদ্ধি নয়, হৃদয় নয়Ñকল্পনা। কবিতা এতো শক্তিশালী হয়ে ওঠে এ জন্যেই যে কল্পনা তার পেছনে সবচেয়ে উজ্জ্বলভাবে কাজ করে যায়’ (আবদুল মান্নান, ১৯৮৭: ৯)। কবি শাহীন মাহমুদের কবিতা সেই কল্পনা আর স্বপ্নকে নিয়েই শক্তিশালী। আর তাঁর সহৃদয় পাঠক মাত্রেই অনুভব করেন এক নতুন মোহনীয় কাব্যভাষা শুনে প্রেমময় কল্পজগতের পথে অভিযাত্রার অভিজ্ঞতা। এই নতুন কাব্যভাষা নির্মাণের প্রয়াস নিসন্দেহে কবি শাহীন মাহমুদের কবিতার অন্যতম বিশিষ্টতা।
শাহীন মাহমুদের কবিতায় সমকালীন ভাবনা ও নন্দন তত্ত্বের এক সম্মোহনী খেলা তাঁর কাব্যপাঠককে মুগ্ধ করে। সমকাল আর প্রতিবেশকে তিনি পান্ডিত্য দিয়ে নয়-কবির নান্দনিক দৃষ্টিতে চয়ন করে তাঁর স্বকীয় ভাষাশেলী দিয়ে উপস্থাপন করেন কবিতায়। বিষয়টি আরেকটু স্পষ্ট করবার জন্যে কালিদাসের আমলের একটি ঘটনা বলি: সে আমলে রাজা বিক্রমাদিত্য তার সামনে একটি কাঠের টুকরো রেখে এ সম্পর্কে কিছু বলতে বললে রাজ-পন্ডিত বললেন, ‘শুষ্কং কাষ্ঠং তিষ্ঠং অগ্রে’, অর্থাৎ আগে একটি শুকনো কাঠ আছে। আর কালিদাস বললেন, ‘নীরস তরুবর সম্মুখভাগে’, অর্থাৎ, সামনের দিকে একটি নীরস গাছ। শাহীন মাহমুদের কবিত্বও তেমনি প্রতিবেশের কাঠ দেখে তিনি তাঁর পাঠকে গাছের কল্পনায় নিয়ে যান তাঁর কাব্যপ্রতিভা দিয়ে। নীরস-নির্জীব সময়ের চিত্র আঁকতে আঁকতে কবি তাঁর সরস ভাষার শৈল্পিক বিন্যাসে পাঠকে উপহার দেন এক স্নিগ্ধ আলোকিত সকালের স্বপ্ন। এভাবেই কবি সমকালীন বাংলা কাব্যজগতে শব্দ প্রয়োগ, বাক্য-বিন্যাস, নতুন নতুন শব্দের গাঁথুনিতে গড়ে তোলেছেন এক স্বকীয় কাব্যভাষা যা তাঁর একান্ত নি-ভাষা বা ব্যক্তিভাষা। এমন ভাষা ও ভাবনা নিয়ে কবি শাহীন মাহমুদ বাঙালি কাব্যপ্রেমীদের আরও নতুন নতুন উপহারে উল্লসিত করবেন। আর তাঁর কবিতার অনুবাদ প্রকাশিত হলে বাংলা সাহিত্য বিশ্বদরবারে আরও মর্যাদা লাভে সক্ষম হবে।