শাটল ট্রেনে শিক্ষার্থীকে যৌন নির্যাতন

44

চবি প্রতিনিধি

এবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) চলন্ত শাটল ট্রেনে বহিরাগত বখাটের হাতে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক ছাত্রী। এ ঘটনায় ক্যাম্পাসে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়া। গত বৃহস্পতিবার রাত সোয়া সাতটার দিকে এই ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগী ওই ছাত্রী কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের একটি বিভাগের ৩য় বর্ষে অধ্যয়নরত। শাটল ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের রেশ কাটতে না কাটতেই চলন্ত শাটলে ছাত্রীকে যৌন হেনস্তার ঘটনা ঘটল। এদিকে স্থানীয়দের হাতে একের পর এক হামলার শিকার হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা। এসব ঘটনায় ক্যাম্পাসের নিরাপত্তাব্যবস্থা চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। ছাত্রীকে যৌন হেনস্তার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ৪র্থ বর্ষের ছাত্রী নাজনীন সুরভি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটলে একজন ছাত্রী যৌন হেনস্থার শিকার হলে এর দায় কি প্রশাসনের উপরেও বর্তায় না? বহিরাগত প্রবেশ কেন ঠেকাতে পারছে না?’
এদিকে ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দেশের সবচেয়ে অরক্ষিত ক্যাম্পাস’, ‘চবির প্রশাসন সবচেয়ে অথর্ব প্রশাসন’, ‘চবির প্রশাসনিক লোকেরা শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে না পারলে গদি নিয়ে বসে আছে কেন? নিরাপত্তা দিতে না পারলে তারা গদি ছেড়ে দিক।’ এরকম বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপ ও পেজের কমেন্টবক্সে এমন মন্তব্য করতে দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের। অপরদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াটাকেই নিজের ব্যর্থতা বলে ব্যক্ত করেছেন নৃবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র তানভীর তানিম। তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াটাকে আমার জীবনের অন্যতম সার্থকতা মনে করেছিলাম। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে ততোই দেখতেছি এখানে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নেই। শাটলে পাথরের আঘাতে আহত হচ্ছে, চলন্ত শাটলে যৌন হেনস্তার শিকার হচ্ছে এছাড়াও স্থানীয়দের হাতে প্রায়ই মার খাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। অথচ প্রশাসন এখন শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে সক্ষম হয় নি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরে নিজেকে যতটা না সফল মনে করেছিলাম তার চাইতে বেশি ব্যর্থ মনে হচ্ছে নিজেকে। কোনোমতে এই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যেতে পারলেই বাঁচি।’
শাটল ট্রেনে যৌন হয়রানির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর ড. শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ঘটনাটি শুনেছি। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। ভুক্তভোগী ওই ছাত্রীর সাথে আমরা যোগাযোগ করেছি। দুর্বৃত্তদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি কিন্ত এটা কঠিন হবে কারণ ছাত্রীটা হেনস্তাকারীর চেহারা দেখেনি। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করব।’

ভুক্তভোগী ছাত্রীর ভাষায় যৌন হয়রানির ঘটনা : ভুক্তভোগী ছাত্রী বলেন, ‘আমি বৃহস্পতিবার ক্যাম্পাস থেকে সাড়ে পাঁচটার শাটলে সামনে থেকে ৩/৪নং বগিতে উঠি। একই বগিতে এক বয়স্ক একজন এবং অল্প বয়স্ক আরো দুজন লোক উঠেন। কিন্তু সময়মতো ট্রেন ছাড়েনি। এদিকে ইফতারের সময় হওয়ায় লোক দুজন ইফতার করার জন্য নেমে যান। আমি ট্রেনে বসেই করি। কিন্তু ইফতারের পর অন্য লোকেরা আর এই বগিতে উঠেননি। ইফতারের পর নতুন দুইজন ছেলে বগিতে উঠে। এরপর ট্রেন একটি স্টেশনে কিছুক্ষণ থামার পর আবার চলতে শুরু করলো। আমি কিছুক্ষণ ফোন ঘেঁটে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বসেছিলাম। চলন্ত ট্রেনে হঠাৎ কেউ একজন এসে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে একহাতে আমার মুখ এবং অপর হাতে আমার মাথা চেপে ধরে। সাথে সাথেই আমি চিৎকার করি এবং হাত সরানোর চেষ্টা করতে করতে মাটিতে পড়ে যাই। চোখের সামনে মৃত্যু দেখছিলাম। তখনও মুখে হাত দিয়ে চেপে ধরা এবং আমি প্রাণপণে হাত এবং কনুই দিয়ে ঠেলে বিকট শব্দে চিৎকার করতে থাকি। হঠাৎ তার হাত ফসকে যেতেই আমার চিৎকার বাইরে যাচ্ছিলো। তখনই কোথাও যেন সে পালিয়ে গেল। আমি জানালা দিয়ে হাত, মাথা বের করে চিৎকার করতে থাকি। দুইদিকেই তাকিয়ে ডাকতে থাকি। থামান, প্লিজ থামান এটাই বলতে থাকি। এক পাশের বগিতে এক ছোট ছেলে শুনে চিৎকার করে থামাতে বলে। কিন্তু হায়! ট্রেনের শব্দের সাথে আমাদের শব্দ মিলিয়ে যায়। অপর পাশের বগি থেকে দরজায় এসে এক ছেলে কিছু একটা বলছে। বললো, কী হয়েছে? আমি শুধু চিৎকার করে বলতে থাকি, প্লিজ, এখানে আসুন। এখানে কতগুলো ছেলে, এখানে আসুন, এখানে কতগুলো ছেলে, এখানে আসুন, থামাতে বলুন। ছেলেটিও চিৎকার করে বলে, আসছি, এখন ট্রেন স্লো হবে, একটু অপেক্ষা করুন। আমি বললাম, কখন স্লো হবে? প্লিজ আসুন, এখনই আসুন, এখানে ওরা আছে। ছেলেটি বলে, আপনি একটু অপেক্ষা করুন, এখনই ট্রেন থামবে, একটু পরেই স্টেশন। এরপর ছেলেটি আমাকে এভাবে আরও অনেক কিছু বলছিলো, বন্ধুকে বললো ওদের ধরতে এবং ওদের উদ্দেশ্য করে গালি দিচ্ছিলো। আমি চিৎকার করেই যাচ্ছিলাম। গলা ফেটে যাচ্ছিলো।
একটু পর ট্রেন স্লো হলে ছেলেগুলো আসলো। ফোনের লাইট জ্বালালো। সেখানে খুঁজে কাউকে পেলো না। বললো, কোথায় গেল ওরা? আমি আস্তে আস্তে বললাম, মনে হয় জানালা দিয়ে উঠে ছাদ দিয়ে অন্য বগিতে গেছে। তারা সেখানে দেখলো এবং কাউকেই পেলো না। ছেলেগুলো আমাকে জিজ্ঞেস করলো কী ঘটেছে, আমি ঠিক আছি কি না, এবং সান্ত্বনা দিচ্ছিলো।
আমি তখন হাঁফাতে হাঁফাতে ক্লান্ত। সারা মুখ অবিরত জ্বলছে। মনে হচ্ছে রক্ত ঝরছে। আমি ছেলেগুলোকে বললাম, দেখুন তো একটু আমার মুখে কী হয়েছে। তারা বললো, মুখে আঁচড় লেগেছে এবং ঠোঁট ফেটে গেছে, সম্ভবত আপনার দাঁতের চাপে।
তখনও ট্রেন চলন্ত। একজন এসে মুখের রক্ত মুছে দিল আমার বোতলের পানি দিয়ে। জিজ্ঞেস করলো, কোন ইয়ার, ডিপার্টমেন্ট, কোথায় যাব। আমি তাদের জিজ্ঞেস করি, আপনারা কারা? তারা বললো, আমরা আপনার ভার্সিটির না। এদিকের কলেজের স্টুডেন্ট।
আমি ষোলশহর নামব বললাম। ছেলেগুলো আমার ব্যাগ নিয়ে আমাকে নামিয়ে দিল, তারাও নামল, একটি বসার জায়গায় বসিয়ে ঠান্ডা পানি নিয়ে আসলো। সেখান থেকে আমি বাড়ি চলে এলাম।
বাড়িতে এসে দেখি আমার মুখের বিভিন্ন জায়গায় নখের ছোট, বড়ো লাল আঁচড়, চোখের ঠিক উপরে কালো, সেখানে সুঁই ফোটানোর মতো অনুভব হচ্ছে এবং চোখের কোণায় ফুলে ব্যথা, গলা বসে গিয়েছে, মানসিকভাবে অত্যন্ত বিপর্যস্ত।’