শহর-গ্রাম সবখানেই মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ!

78

শহর কিংবা গ্রাম যেখানেই হোক, সব জায়গায় ফার্মেসিতে অবাধে বিক্রি হচ্ছে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ। এসব ফার্মেসিতে অভিযান চালালেই মিলছে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ। ভোক্তারা এসব ওষুধ কিনে একদিকে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন অন্যদিকে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন। এছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন আইনত দÐনীয় অপরাধ জেনেও কতিপয় অসাধু ওষুধ কোম্পানি ও ফার্মেসি ব্যবসায়ী অর্থের লোভে এ ধরনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এদের কাছে মানুষের মূল্যবান জীবনের চেয়ে অর্থের গুরুত্ব অনেক বেশি।
এদিকে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ এক মাসের মধ্যে ধ্বংস করতে হাইকোর্ট গত ১৮ জুন নির্দেশ দেওয়ার পর তা বাস্তবায়নে রাজি হয়েছে ফার্মেসি এবং ওষুধ কোম্পানিগুলো। তবে তা কতটুকু বাস্তবায়ন হবে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সেই সাথে দেশে কার্যকর ওষুধ বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তুলে নিয়মিত মনিটরিং ও বিশেষ সক্রিয়তার ধারাবাহিকতা জরুরি বলে মনে করছেন ভোক্তা সংশ্লিষ্টরা।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, ওষুধ যেমন জীবন রক্ষা করতে পারে, তেমনি একই ওষুধ নকল, মেয়াদোত্তীর্ণ কিংবা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষণ না করলে কার্যকারিতা হারিয়ে জীবনহানিও ঘটাতে পারে। এছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ খেলে চামড়ার ওপর মারাত্মক এলার্জি সৃষ্টিসহ কিডনি ও লিভার নষ্ট হতে পারে। মস্তিষ্কের প্রদাহে অজ্ঞান হয়ে মারাও যেতে পারে।
জানা যায়, দেশে ওষুধের উৎপাদন থেকে বিপণন কোনো স্তরেই সরকারি পরীক্ষাগারে মান নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হয় না। বিপণনের পর অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বাজার থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে পাঠান। তখন ওষুধের মান জানা যায়। এর আগ পর্যন্ত পরীক্ষাবিহীন, মান না জানা ওষুধই ব্যবহার করেন ভোক্তারা। অনেক সময় অসাধু ব্যবসায়ী ও বিক্রেতারা মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের গায়ে নতুন করে মেয়াদ সম্বলিত স্টিকার লাগিয়ে তা বিক্রি করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সেই সাথে ওষুধ বিপণনের সঙ্গে জড়িত অসৎ ব্যবসায়ীরা বিদেশ থেকে ওষুধ আমদানি করে নিজেরাই ইচ্ছেমতো মেয়াদ বাড়িয়ে লেবেল এবং মূল্যও বাড়িয়ে থাকেন।
এসব বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ওষুধ প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টরা অবগত হয়ে সাময়িকভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। অভিযানে ওষুধ কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল করা হয়। অপরাধীদের জরিমানা ও আইনানুগ দÐ দেয়া হয়। কিছুদিন পর একই বিপজ্জনক পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি ঘটে। বাজারে থেকে যায় মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ।
জানা যায়, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ব্যবসার সিন্ডিকেটের সঙ্গে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
সেবা সংস্থা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম গত এপ্রিল ও মে মাসে নগরীর ইপিজেড, বন্দর, ডবলমুরিং, বায়েজিদ, অক্সিজেন, সদরঘাট, কোতোয়ালী, আকবরশাহ থানা এলাকা, খুলশি, পাঁচলাইশ, জুবলী রোড়, চকবাজারসহ বেশ কিছু এলাকায় তদারকিমূলক অভিযান পরিচালনা করে। এসময় এসব এলাকার বিভিন্ন ফার্মেসিতে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ মেয়াদোত্তীর্ণ ও অনুমোদনহীন ওষুধ পাওয়া যায়। এ অপরাধে অধিদপ্তর ফার্মেসির মালিককে বিভিন্ন অঙ্কের জরিমানা করেছেন। সেই সাথে অনেক ব্যবসায়ীকে জরিমানার পাশাপাশি মামলা ও কারাদÐ দিয়েছেন।
একইভাবে গত দুই মাসে ওষুধ প্রশাসন নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ফার্মেসিগুলোতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ও নকল বিরোধী অভিযান পরিচালনা করে। এসময় মেয়াদোত্তীর্ণ ও নকল ওষুধ পাওয়া যাওয়ার অপরাধে বিভিন্ন ফার্মেসির মালিককে ২ লাখ ৩৮ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। জব্দ করা হয় বিপুল পরিমাণ ওষুধ। যার আনুমানিক বাজার মূল্য ৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা। একই অপরাধে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ১৮টি মামলা ও একজনকে এক বছরের কারাদÐ প্রদান করা হয়।
এছাড়া বিভিন্ন সময়ে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ফার্মেসিতে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত ও র‌্যাবের অভিযানে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ পাওয়ার নজির রয়েছে।
এছাড়া আরো শোচনীয় অবস্থা গ্রামের ফার্মেসিগুলোতে। সেখানে নেই যথাযথ ওষুধ সংরক্ষণ ব্যবস্থা। ফার্মেসিগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের বড় বাজার।
বিএমএ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ডা. শফিউল আজম বলেন, যারা মানুষের জীবন রক্ষাকারী ওষুধ নিয়ে বাণিজ্য করছে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এ সমস্ত অসাধু ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে আমরা সোচ্চার। তাছাড়া এ ধরনের অপরাধ কর্মকাÐের সৃষ্টির মূল কারণ হলো সংশ্লিষ্ট বিভাগের মনিটরিংয়ে দীর্ঘসূত্রতা। নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ নির্মূলে সেবা সংস্থাগুলোকে আরো কঠোর হওয়ার আহবান জানান তিনি।
মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ সেবনে মানুষের শরীরে কি ধরনের প্রভাব পড়ে জানতে চাইলে সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, এগুলো একধরনের বিষ। এসব ওষুধ খেলে চামড়ার ওপর মারাত্মক এলার্জি সৃষ্টি হতে পারে। মস্তিষ্কে প্রদাহে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে এমনকি মারাও যেতে পারে। আর নষ্ট হতে পারে কিডনি ও লিভার। এছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ সেবনের ফলে নার্ভ এর সমস্যা হতে পারে। মারাত্মক পরিণতির দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে। দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতার মধ্যে পড়তে পারে। মোটকথা হলো মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ সেবনের কারণে ভোক্তারা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে পারেন।
কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এ জঘন্য অপরাধ নির্মূলের জন্য দুই জায়গায় নজরদারি বাড়াতে হবে। একটি হলো ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর আর অন্যটি হলো ওষুধ কোম্পানি যারা ওষুধ উৎপাদন করে থাকে।
তিনি বলেন, ওষুধ প্রশাসন তদারকি করে না বলেই এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। তাই ওষুধ প্রশাসনের গাফিলতির কারণে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা দরকার। এছাড়া নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ নির্মূলের জন্য যারা উৎপাদন ও বিপণন করে তাদের বিষয়ে প্রশাসনকে তথ্য দেওয়া ওষুধ কোম্পানিগুলোর নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করি। তাই এই লক্ষ্যে সবাইকে সচেতন হওয়া জরুরী।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর চট্টগ্রামের তত্ত¡াবধায়ক কামরুল হাসান বলেন, এ সমস্ত বিষয়ে খবর পেলে সাথে সাথে আমরা অভিযান পরিচালনা করি। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকি।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মুহম্মদ হাসানুজ্জামান বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ, অনুমোদনহীন ও নকল ওষুধ যারা উৎপাদন ও বিপণন করছে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। যতদিন না এসব জঘন্য অপরাধ বন্ধ না হবে ততদিন আমাদের তদারকিমূলক কার্যক্রম চলবে। সবার সহযোগিতায় এসব অপরাধমূলক কাজ বন্ধ করা সম্ভব।