শতবছরেও স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা-সেবায় অপ্রতিদ্বন্ধী

57

চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের মানুষের জন্য এক অনন্য স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র চন্দ্রঘোনা খ্রীস্টিয়ান হাসপাতাল। শতবছর পূর্বে ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সোসাইটি (ইউকে) কর্তৃক ১৯০৭ সালে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া ও কাপ্তাই উপজেলার সীমান্ত এলাকায় এই হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে শতবর্ষী এই হাসপাতালে দেশ-বিদেশের অভিজ্ঞ চিকিৎসকের সমন্বয়ে সেবা দিয়ে আসছে। আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত চিকিৎসক ম্যাগফিল, ডা. খাতানো, ডা. হার্ট সহ বিশ্বের নামকরা অনেক চিকিৎসক এই হাসপাতালে সেবা দিয়েছেন। এভাবে চিকিৎসা সেবায় আস্থার ঠিকানায় পরিণত হয়ে উঠেছে হাসপাতালটি।
সুত্রে জানা যায়, বর্তমানে এটি ১০০ বেডের জেনারেল হাসপাতাল। ১৯১৩ সালে খ্রীস্টিয়ান লেপ্রসী (কুষ্ঠু) সেন্টার চালু হয়। এটিও ৬০ বেডের হাসপাতাল। ১৯৩৭ সালে এই হাসপাতালের সাথে চালু করা হয় নার্সিং ইনিস্টিটিউট। বর্তমানে নার্সিং ইনিস্টিটিউটে দুটি কোর্স চালু আছে। একটি হলো ৩ বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স এন্ড মিডওয়াইফারি এবং অন্যটি হলো ১৮ মাস মেয়াদি জুনিয়র মিডওয়াইফারি। সামাজিক স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্প সংযুক্ত হয় ১৯৯১ সালে। বর্তমান কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৬ সালে। কাপ্তাই-রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে এই কার্যক্রম চলমান আছে। ৬২ হাজার জনসংখ্যার মধ্যে এই কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এভাবে হাসপাতালটি ১১১ বছর ধরে নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে এখনও মাথা উঁচু করে অব্যাহত ভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছে প্রান্তিক জনসাধারণকে। বর্তমানে হাসপাতালের পরিচালক ডা. প্রবীর খিয়াং।
খ্রীস্টিয়ান হাসপাতাল চন্দ্রঘোনা থেকে যেসব সেবা দেওয়া হয় তা হলো, ২৪ ঘন্টা জরুরী বিভাগ, সপ্তাহের ৬ দিন বহিঃবিভাগ, পরিচ্ছন্ন অন্তঃবিভাগ, এক্সরে বিভাগ, কালার আল্ট্রা সোনলজি, উন্নত ল্যাবরেটরি সুবিধা, স্ত্রী রোগ ও প্রসূতি বিভাগ। এরমধ্যে এন্টি নেটাল ও পোস্ট নেটাল চেক আপ, সিজারিয়ান সেকশন ও জরায়ু সহ অন্যান্য স্ত্রীরোগে চিকিৎসা দেওয়া হয়। রয়েছে মেডিসিন বিভাগ, সার্জারি বিভাগ। এরমধ্যে জেনারেল সার্জারি ও শিশুদের ক্লাব ফুট বা মুগুর পায়ের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। দিনের ২৪ ঘন্টা অপারেশন থিয়েটার খোলা ও জরুরী অপারেশন সুবিধা, স্ট্রোক এবং প্যারালাইসিস ম্যানেজমেন্ট, বেবি ইন্কিউবেটর। এছাড়া কমিউনিটি হেলথ প্রোগ্রামিং কার্যক্রম চালানো হয় এই হাসপাতালের মাধ্যমে। এর মাধ্যমে বেসিক হেলথ ওয়ার্কাদের সাহায্যে মাঠ পর্যায়ে স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরি করা, কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে আগ্রহী করে তোলা, সিসি, ইউএইচসি বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগী রেফারেল নিশ্চিত করা, শিশুদের ইপিআই টিকা দানের ব্যাপারে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করা ও নিশ্চিত করা, গর্ভবতী মায়েদের এএনসি ও প্রসব পরবর্তী পিএনসি চেকআপ নিশ্চিত করা, ম্যালেরিয়া সংক্রান্ত সচেতনতা বৃদ্ধি, ম্যালেরিয়া স্ক্রিনিং ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতিসমূহ সরবরাহ, লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে জন সচেতনতা, সেনিটেশন ও নিরাপদ পানি ব্যবহারে সচেতনতা সৃষ্টি করা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
বর্তমান পরিচালক প্রবীর খিয়াং দায়িত্বভার নেয়ার পর হাসপাতালের প্রতি সাধারণ রোগীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেন। এরমধ্যে রয়েছে ২৪ ঘন্টা হাসপাতালের ফার্মেসি খোলা রাখার ব্যবস্থা, স্টাফদের প্রত্যেকের জন্য নিজস্ব স্মার্ট পরিচয়পত্র, নার্সিং কোর্সে শিক্ষার্থীদের আসন সংখ্যা ১৫ থেকে ৩০ করণ, হাসপাতালের উন্নয়নে বিদেশী দুটি সেবা সংস্থার সাথে চুক্তি করেন।
এই চুক্তির ফলে এবছর থেকে বিদেশী নামকরা চিকিৎসক এবং নার্স দিয়ে সেবা কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। তারা আগামী ৩ বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এছাড়া প্রতিবছর গরীব অসহায় রোগীদের জন্য দরিদ্র তহবিল থেকে সর্বাত্মক বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়। ২০১৯ সালে দরিদ্র তহবিল থেকে ২৪ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে। এছাড়া হাসপাতালের নিজস্ব তহবিল থেকে পার্শ্ববর্তী কুষ্ঠু চিকিৎসা ও সেবা কেন্দ্রে ৪২ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে।
হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. বিলিয়ম এ সাংমা জানান, বর্তমান হাসপাতালের বহিঃবিভাগে রোগীদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই কর্তৃপক্ষ হাসপাতালের উন্নতিকল্পে অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এবছরেই আমেরিকা থেকে বিভিন্ন বিষয়ের উপর অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা সংযুক্ত হবেন। হাসপাতালে বেশ কিছু অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজিত হয়েছে এবং শীঘ্রই আরও আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজিত হবে। বিভিন্ন বিভাগের কর্মচারীদের কর্মে দক্ষতার নিমিত্তে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ সহ সামাজিক স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনার পরিকল্পনার গ্রহণ করা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে বিএস.সি. নার্সি কার্যক্রম চালু করা, আধুনিক ফিজিওথেরাপি ডিপার্টমেন্ট শুরু করা, হাসপাতালকে আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রূপান্তর করা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
পরিচালক ডা. প্রবীর খিয়াং বলেন, আগের মতই এখানে চিকিৎসা সেবা উন্নতির জন্য দেশ-বিদেশের অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকে সমন্বয়ে উন্নত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা হচ্ছে। ধনী গরীব সকলের জন্য সেবা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। হাসপাতালটি যে লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা পূরণে আমরা বদ্ধ পরিকর।
চন্দ্রঘোনা-কদমতলী ইউনিয়নের লিচুবাগান এলাকার আবদুল খালেক (৬৫) বলেন, একসময় যখন কালাজ্বর, ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া সহ বিভিন্ন জঠিল রোগে আক্রান্ত হয়ে রাতারাতি শত শত মানুষ মারা যাচ্ছিল তখন এই হাসপাতালে বিনামূল্যে বিদেশী চিকিৎসকদের সহযোগিতায় এলাকার হাজার হাজার রোগীদের প্রাণ বাঁচিয়েছিল। এভাবে শতবছর ধরে রাঙ্গুনিয়া সহ তিন পার্বত্য এলাকার মানুষের সেবা দেওয়া হচ্ছে এই হাসপাতালের মাধ্যমে।
কাপ্তাই উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মফিজুর রহমান বলেন, স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম চালাতে এই হাসপাতালে আধুনিক সরঞ্জাম, দেশ-বিদেশের অভিজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা দিন-রাত নিরলস পরিশ্রম করে চলেছে। রাঙ্গুনিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান চৌধুরী বলেন, সুদূর আমেরিকা সহ বিভিন্ন দেশ থেকে বড় বড় ডাক্তার দ্বারা সারা-বছরই বিভিন্ন রোগের সেবা ক্যাম্প করে থাকে। দরিদ্র শ্রেণির মানুষের উন্নত চিকিৎসার জন্য এই প্রতিষ্ঠানটি আদর্শ প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেবা দিয়ে আসছে।