পুরোদমে সচল ছিল চট্টগ্রাম বন্দর

311

ফারুক আবদুল্লাহ

করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে গত বছর তৈরি পোশাক শিল্পে চরম বিপযর্য় নেমে এসেছিল। একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিতাদেশের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক শিল্প-কারখানা। এসময় প্রায় ৩ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানী আদেশ বাতিল ও স্থগিত হয়েছে। আর চট্টগ্রামের পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠানে প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রপ্তানী আদেশ বাতিল ও স্থগিত হয়েছে। তবে পোশাক শিল্পের ভবিষ্যত সুরক্ষা ও শ্রমিকদের মজুরি প্রদানের লক্ষ্যে ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক স্বল্প ঋণের ব্যবস্থা করায় ক্রমাগত লোকসানের মধ্যেও পোশাক শিল্প বর্তমানে ঘুরে দাড়াঁনোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। বলতে গেলে মাস দেড়েক সময় বাদ পুরো বছরজুড়ে পোশাক খাতের জন্য সুসময় অবস্থান ছিল। বিপুল ক্রয়াদেশের কারণে অনেক রপ্তানীকারক নতুন করে বিনিয়োগ করেছেন।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, করোনার প্রথম বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের প্রথম ১১ মাস জানুয়ারি-নভেম্বরে ২ হাজার ৪৮১ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছিল। চলতি বছরে একই সময়ে রপ্তানি হয়েছে ৩ হাজার ১৭৭ কোটি ডলার তথা ২ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার পোশাক। অর্থাৎ গত এক বছরে রপ্তানি বেড়েছে ২৮ শতাংশ।

চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার ও কার্গো হ্যান্ডেলিংয়ে রেকর্ড:
করোনা মহামারীর কারণে গত বছর চট্টগ্রাম বন্দর ৩০ লাখ কন্টেইনার পরিবহনের তালিকা থেকে ছিটকে পড়েছিল। এর প্রভাবে আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথে কন্টেইনার পরিবহন গত ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ কমে যায়। একই সময়ে চট্টগ্রাম বন্দরেও কন্টেইনার পরিবহন ৮ শতাংশ কমে যায়। যার ফলে চট্টগ্রাম বন্দর ৯ ধাপ পিছিয়ে ৬৭তম স্থানে নেমে এসেছিল। এর আগে চট্টগ্রাম বন্দর একটানা ৭ বছর বৈশ্বিক ক্রমতালিকায় ৩২ ধাপ উন্নতি হয়। কন্টেইনার পরিবহনের হিসেবে বিশ্বের ব্যস্ততম ১০০টি বন্দরের তালিকায় সর্বশেষ চট্টগ্রাম বন্দরে অবস্থান ছিল ৫৮তম।
তবে করোনার সেই ধাক্কা সামলে নিয়ে এবার বছর শেষ হওয়ার আগে কন্টেইনার পরিবহনে রেকর্ড গড়েছে এই বন্দরটি। এ সফলতার কারণ হলো- করোনার প্রভাবে যখন বিশ্বজুড়ে স্থবিরতা চলছিল, তখন বাংলাদেশর অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখতে সারাবছর পুরোদমে সচল ছিল চট্টগ্রাম বন্দর।
গত বছরের তুলনায় তিন লাখ কন্টেইনার এবং এক কোটি মেট্রিক টনেরও বেশি পণ্য হ্যান্ডেলিং করায় এ সফলতা এসেছে।১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং হয়েছে প্রায় ৩১ লাখ টিইউএস। যা গত বছর ছিল ২৮ লাখ ৩৯ হাজার টিইউএস। আর কার্গো হ্যান্ডেলিংয়ের ক্ষেত্রেও গড়েছে রেকর্ড। গত বছর ১০ কোটি ৩২ লাখ মেট্রিক টন পণ্য হ্যান্ডেলিং করলেও এবার বছর শেষ হওয়ার আগেই তা ১১ কোটি ২৬ লাখ ছাড়িয়েছে। তাছাড়া এই বছরই প্রথম চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্যবাহী জাহাজ আসার সংখ্যা চার হাজার অতিক্রম করেছে।

ডিসেম্বর মাসে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানির রেকর্ড:
এবছরের বিভিন্ন সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি হলেও বছরের শেষ সময়ে ডিসেম্বর মাসে হঠাৎ করে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি বেড়ে যায়। এই একটি মাসে বড় বড় ৪টি চালান আটকে পড়ে চট্টগ্রাম কাস্টমসে। এসব চালানে প্রায় ২৭০ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির চেষ্টা করে কাস্টমসের কাছে ধরা পড়ে।
কাস্টমসের তথ্য মতে, চলতি মাসে ১১, ১৪, ২২ এবং ২৩ তারিখে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানির চারটি চালান জব্দ করে কাস্টমস। এসব চালানে প্রায় ২৭০ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির চেষ্টা করে কাস্টমসের কাছে ধরা পড়ে।

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি:
চলতি বছর বিশ্ব অর্থনীতির সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে যখন সারাবিশ্ব লকডাউনে স্থবিরতা বিরাজ করছিল, তখন জ্বালানির তেলের দাম কমে দাঁড়ায় মাইনাস ৩৭ ডলার। কিন্তু এরপর থেকে ওপকে ও তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো ধারাবাহিকভাবে তেল সরবরাহ কমাতে শুরু করে। এরপর চলতি বছরের শুরু থেকেই তেলের দাম বাড়তে শুরু করে। অক্টোবর মাসে তা ব্যারেল প্রতি ৮৩ ডলারে উঠে যায়। এতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশই জ্বালানির দাম বাড়াতে বাধ্য হয়। এর ফলে সবকিছুর দামও হু হু করে বেড়ে যায়।
এমন পরিস্থিতির কারণে কারখানা থেকে বেসরকারি ডিপো পর্যন্ত রপ্তানি পণ্য পরিবহন ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে বেসরকারি ডিপো হতে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে ৬ লাখ ৫৫ হাজার ৯৯০টি রপ্তানি পণ্যবাহী কন্টেইনার জাহাজীকরণ করা হয়। এসব রপ্তানি পণ্য কারখানা হতে ডিপোতে পরিবহননের জন্য প্রয়োজন হয় ৮ লাখ ১৯ হাজার ৯৮৮টি কাভার্ড ভ্যান। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে প্রতি কাভার্ড ভ্যানে ভাড়া বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার টাকা।
এতে আগামী এক বছরে রপ্তানি পণ্য কারখানা হতে বেসরকারি ডিপো পর্যন্ত পরিবহনে মোট ভাড়া বৃদ্ধি পাবে ২৮৭ কোটি টাকা। বেসরকারি ডিপো মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো এসোসিয়েশন (বিকডা) এর তথ্য মতে, করোনা মহামারিতে শিপিং লাইনসমূহের ফ্রেইট চার্জ বেড়েছে ৪০০ হতে ৫০০ শতাংশ। বাংলাদেশ হতে আমেরিকায় একটি রপ্তানি পণ্যবাহী কন্টেইনারের ফ্রেইট চার্জ ছিল ৩ হাজার ইউএস ডলার, যা এখন বেড়ে হয়েছে ১৮ হাজার ইউএস ডলার। বাংলাদেশ হতে ইউরোপে একটি রপ্তানি পণ্যবাহী কন্টেইনারের ফ্রেইট ছিল ১২০০ ইউএস ডলার যা এখন বেড়ে হয়েছে ১৫ হাজার ইউএস ডলার।
প্রতি রপ্তানি পণ্যবাহী কন্টেইনারে গড়ে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার ইউএস ডলার ফ্রেইট চার্জ বেড়েছে। এছাড়া বেসরকারি ডিপোতে রপ্তানি পণ্য কন্টেইনারে স্টাফিংকরণ পূর্বক বন্দরে পাঠানো পর্যন্ত সামগ্রিক অপারেশনাল কার্যক্রমসমূহের বিপরীতে ২০ ফুট কন্টেইনারের ক্ষেত্রে প্রতি কন্টেইনারে মাশুল বেড়েছে ৯৫২ টাকা এবং ৪০ থেকে ৪৫ ফুট কন্টেইনারের ক্ষেত্রে প্রতি কন্টেইনারে মাশুল বেড়েছে ১ হাজার ২৭০ টাকা। আর ভিজিএম (ভেরিফাইড গ্রস ম্যাস) এর মাশুল বেড়েছে প্রতি কন্টেইনারে ২৬৫ টাকা।