চাটগাঁইয়া রন্ধন সংস্কৃতি ও রসবোধ

362

 

(দ্বিতীয় কিস্তি)
চাটগাঁইয়ারা ভোজনরসিক এটা সর্বজন স্বীকৃত। তাদের খাদ্যরুচিতে আছে নানানপদের খাদ্যের সমাহার। এরা যেমন খেতে ভালোবাসে তেমনি অন্যদের খাওয়াতেও ভালোবাসে। এদের খাদ্যরুচি, রসবোধ এবং সংস্কৃতি যুগ যুগ ধরে বহমান। ধারণা করা হয় অতীতে চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের মানুষের আগমন ঘটে। এই মিশ্র সংস্কৃতির মানুষের সাথে চাটগাঁইয়াদের খাদ্যরুচি ও সংস্কৃতির সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে নতুন রন্ধন সংস্কৃতি ও রসবোধ সৃষ্টি করে। কিন্তু চাটগাঁইয়াদের এই সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণামূলক কোন কাজ হয়েছে কিনা অদ্যাবধি চোখে পড়েনি। অথচ এই ঐতিহ্যবাহী খাদ্য রুচি ও রসবোধের শুলুক সন্ধান জরুরি। যথাযথভাবে এর শুলুক সন্ধান করা গেলে এতদঞ্চলের মানুষের ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য বেরিয়ে আসবে। খাদ্যরুচির কিছু নমুনা নিম্নে দেয়া হলো,
দো-মাছা: চাটগাঁইয়া রন্ধন সংস্কৃতির একটি বিশেষ পদ হলো দো-মাছা। এই দো-মাছা রান্নার জন্য শুটকি অপরিহার্য। সাধারণত দো-মাছা রান্নার সময় সামাজিক শ্রেণি বিভাজন লক্ষ করা যায়। উচ্চবিত্তবানরা লাক্কা, কোরাল ইত্যাদি বড় আকারের কাঁচা মাছের সাথে এই প্রজাতির শুটকি ব্যবহার করে। এই প্রজাতির কাঁচামাছ ও শুটকি অনেক দামে বিক্রি হয়ে থাকে। এই মাছ ও শুটকি মাংসলও শুরু হয়। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা সাধারণত: জিয়ল মাছের সাথে ছুরি, পোপা, দাতিনা কোরাল, কাইকা ইত্যাদি কমদামি শুটকি ব্যবহার করে।
রান্নার পদ্ধতি : কাঁচামাছ, শুটকি বেশি পরিমাণে পিঁয়াজ, রসুল কুচি, পরিমানমতো আদা, হলুদ, জিরা, গুঁড়ো মরিচ, লবণ তৈল ও ধনেপাতা লাগে। প্রথমে মাছ ও শুটকি পরিষ্কার করে ধুয়ে নিন। এবার পাত্রে পিঁয়াজ রসুন ও অন্যান্য মসল্লাসহ তেলে কষিয়ে নিন। কষানোর সময় হাল্কা পানি দিতে হবে। তা না হলে অনুমানগুলো পুড়ে যাবে। কষানো হলে শুটকি কষাতে থাকুন, সামান্য পানি দিন। ২০-২৫ মিনিট পর কাঁচামাছগুলো ছেড়ে দিয়ে জ্বাল দিতে থাকুন। ৩০ থেকে ৩৫ মিনিট পর ধনেপাতা দিয়ে নামিয়ে নিন। দো-মাছা রান্নার সময় মাছ ও শুটকি কিউব আকৃতির করে কাটতে হবে। দো-মাছার রঙ লাল করতে চাইলে হাটহাজারির মরিচ ব্যবহার করুন। শুটকি মাছ ঝাল হলে খেতে উপাদেয়। ঝাল বাড়ানোর জন্য কাঁচা মরিচ ব্যবহার করতে পারেন।
হলইদ ফুলের ভর্তা (হলুদ ফুলের ভর্তা) : হলুদ কন্দ থেকে প্রাপ্ত এক ধরনেনর মসল্লা, যা রান্নায় ব্যবহার হয়ে থাকে। বিশ্বব্যাপী হলুদ মসল্লা হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। হলুদ আদা পরিবারের অন্তর্গত একটি গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। এর আদি উৎস দক্ষিণ এশিয়ায়। আদা, হলুদ এবং শটিগাছ দেখতে প্রায় এক ধরনের হলেও আদা ও হলুদ গাছ মসল্লার কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। হলুদ চাষের জন্য পানি জমেনা এমন জমিই উত্তম। কর্ণফুলী অববাহিকার উঁচু জমিতে প্রচুর পরিমাণে হলুদ উৎপাদিত হয়। হলুদ চাষে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাতের দরকার। কর্ণফুলী অববাহিকার পাহাড়ে এবং সমতলে প্রচুর পরিমাণ হলুদ জন্মে। এর কন্দ রান্নার কাজে ব্যবহার হলেও এর ফুল সবজি হিসাবে বেশ ব্যবহার হয়। এ ছাড়া পাতা প্যাকিং ও সবজি পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। চাটগাঁইয়া রন্ধন সংস্কৃতি ও রসবোধ নামে একটি লেখা প্রকাশ হওয়ার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও খ্যাতিমান বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ড. গাজী আসমত জানান যে, তাঁর প্রিয় মেনু হলুদ ফুলের ভর্তা লেখা হয় নি। আমি জানিনা তিনি কোথায় এ সবজি খেয়েছেন। তবে আমরা জানি যে চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠি এই ফুল দিয়ে নানাপদ রান্না পাকোরা ভর্তা, ও সালাদ খেয়ে থাকেন। তারা কেন চাটগাঁইয়ারাও হলইদ ফুলের নানা পদ খেয়ে থাকেন। সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় লইট্টা মাছ রান্নায় এবং ভর্তা খাওয়ার সময়। চট্টগ্রাম পার্বত্য চট্টগ্রামের হাটে বাজারে হলুদ ফুল ব্যাপক হারে বিক্রি হয়। এটি একটি জনপ্রিয় সবজি ও খাদ্যপণ্য।
হলুদফুল কিঞ্চিত হলুদে সবুজ ও সাদা বর্ণের। ডাটাসহ ফুল ৩০ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার, প্রস্থে ৮ থেকে ১০ সেন্টিমিটার, শুধু ফুলের দৈর্ঘ্য ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার।
ভর্তা প্রস্তুত প্রণালী : প্রথমে হলুদ ফুল নিয়ে পরিষ্কার করে ধুয়ে নিন। হলুদ ফুলে অনেকগুলো পাপড়ি থাকে। পাপড়িগুলো আলাদা করে নিন। ডাটায় হলদে ও হর্ষদ রুপালী যে অংশ থাকে তা নেওয়ার প্রয়োজন নেই, ফেলে দিন। ডাটা থেকে পাপড়িগুলো আলাদা করার পর পরিষ্কার জলে ধুয়ে লবণ মেখে একটি পাত্রে ১৫/২৫ মিনিট রেখে দিন। হলুদ ফুল বর্তায় কেউ কেউ কাঁচা মাছ বা ছুরি শুটকি ব্যবহার করেন। যদি আপনি মাছ বা শুটকি দিতে খেতে চান তবে খোলায় মাছ বা শুটকি ধুয়ে তাওয়ায় বসিয়ে সেঁকে নিন। যদি রসুন খেতে চান তাহলে ৪/৫ খোয়া রসুনও তাওয়ায়সেঁকে নিন। সেঁকা হলে মাছ বা শুটকি কাঁটা বেছে নিন। অতঃপর ফুলের পাপড়িও খানিকটা বেশি পরিমাণ পিঁয়াজ কুচিকুচি করে নিন। সরিষার তেলে কয়েকটি লাল শুকনো মরিচ / কাঁচা মরিচ ঢেলে নিন। অতঃপর পাপড়ি, মাছ / মুটকি, রসুন পোড়া মরিচ একটি পাত্রে নিয়ে পরিমাণ মতো সরিষার তেল ও লবণ দিয়ে কচ্লিয়ে নিন। পরিবেশন করুন হলইদ ফুলের ভর্তা (হলুদ ফুলের ভর্তা)
মধুভাত : ‘মধু কই কই বিষ খাবাইলা’ গানের মধু নয়। এটি একটি মিষ্টি জাতীয় ভাতের নাস্তা। এর প্রধান উপকরণ হলো গজানো বীজ ধান। যা খাওয়ার পর খাদকের ঘুম ঘুম ভাব জাগ। সম্ভবত: আরাকানি সংস্কৃতি থেকে মধুভাত চাটগাঁইয়া রন্ধন সংস্কৃতি এসেছে। অতীতে চট্টগ্রামের বনেবাদাড়ে এবং পাহাড়ে প্রচুর পরিমাণে মধু পাওয়া যেত। প্রকৃতি থেকে মৌমাছি কমে যাওয়ার মধুভাতে মধুর পরিবর্তে চিনির ব্যবহার বেড়েছে। মধু ও চিনি ভাতকে মিষ্টি করার জন্য ব্যবহৃত হয়। চাটগাঁইয়া সমাজে মধুভাত ঐতিহ্যবাহী নাস্তার পদ। যা বিশেষ বিশেষ আত্মীয়দের বাড়িতে পাঠানো হয়। কিম্বা জামাই, বউ, বেয়াই-বেয়াইন এবং গণ্যমান্য আত্মীয় এলে পরিবেশন করা হয়ে থাকে। যুগযুগ ধরে মধুভাতের প্রচলন থাকলে হালের আধুনিক চাটগাঁইয়ারা উপকরণের অভাবে এবং জ্যাঙ্কফুডের প্রভাবে ভুলতে বসেছে এই ঐতিহ্যবাহী নাস্তাটি।
প্রস্তুত প্রণালী : এক কেজি চিনিগুঁড়া বা কালো জিরার মতো চিকন চাল নিন। চাল ধুয়ে একটি পাত্রে পরিমাণের চেয়ে বেশি পানি দিয়ে চালগুলো উনুনে বসিয়ে দিন। ভাত হয়ে এলে নামিয়ে ঘুটে নিন বা কাঠি দিয়ে নাড়তে থাকুন। ভাত জাউয়ের মতো হলে তাতে গজিয়ে যাওয়া বীজধান (জালা) এর গুঁড়ো বা দোভাঙ্গা ছেড়ে নিয়ে নাড়তে থাকুন। সাথে পরিমাণ মতো (দুই চিমটি) লবণ দিতে ভুলবে না। অতঃপর মোটা কাপড় / কাঁথা দিয়ে ঢেকে রাখুন যাতে করে পরদিন ভোর পর্যন্ত গরম থাকে। ভোরে মধু/চিনি নারকেল কুচি ও কিসমিস দিয়ে পরিবেশন করুন। মধুভাতের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো একা না থেকে নিকট আত্মীয় স্বজনের দিয়ে খাওয়া কিম্বা পাঠিয়ে দেয়া। মধুভাত বিলানোতেই তৃপ্তি। এহচ্ছে সামগ্রীক সংস্কৃতি, যৌথ পরিবার সংস্কৃতি।
পরিশেষে ভারাক্রান্ত মনে বলতে হয় দেশে গবেষণাকর্ম নিতান্তই গৌণ। সমাজ কাঠামোর এক বিকাশের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য গবেষণা অতি জরুরি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কর্ম ও মান আজ প্রশ্নবিদ্ধ। আবার সরকারিভাবে গবেষণার জন্য বরাদ্দও অপ্রতুল। ফলে মেধাবীরা গবেষণা কর্মে এগিয়ে আসছেননা যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে। একটি জাতির উন্নয়ন, ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিনির্মাণে গবেষণার ভূমিকা অপরিসীম। এটা দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, চাটগাঁইয়া ভাষা, ঐতিহ্য ও রন্ধন সংস্কৃতিসহ নানাবিধ অনুষঙ্গ নিয়ে গবেষণা হয়নি বললেই চলে। অথচ এর শুলুক সন্ধানে চাই নিবেদিত গবেষণা। ব্যক্তিপর্যায়ে দু-একটি কাজ হলেও তা সর্বজন স্বীকৃত নয়। ধরা যাক চাটগাঁয়ের একটি ভাষা আছে। তার কোন বর্ণমালা নাই। যে যার মতো করে লিখছেন। এ জন্য চাই প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যাপক গবেষণা এবং গবেষকদের পৃষ্ঠপোষকতা।

লেখক : কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব.)