রোহিঙ্গা সংকটের তিন বছর পূর্তি প্রত্যাবাসন সুদূরপরাহত

56

গত ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা সংকটের তিন বছর পূর্ণ হয়েছে। নানা উদ্যোগ ও পরিকল্পনার মধ্যেই আটকে আছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। দীর্ঘ চার বছরে দ্বিপক্ষীয়-বহুপক্ষীয় কোনো আলোচনাতেই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। বলা যায়, চলতি বছরের শুরু থেকেই কোভিড-১৯ এর বৈশ্বিক মহামারির কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মনোযোগ হারিয়েছে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর ফলে রোহিঙ্গাদের নিজভূমে প্রত্যাবাসনের বিষয়টি দীর্ঘতর হচ্ছে, পরিকল্পনা বাস্তবায়ন যেন সুদ‚রপরাহত। এরমধ্যেও আশাসঞ্চারকারী খবর আছে রোহিঙ্গাদের জন্য; আর তা হলো, আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) নির্দেশ। আদালত অন্তর্বরর্তী আদেশ জারির পর মিয়ানমারে গণহত্যার অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কিনা, সে বিষয়েও শুনানি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং গাম্বিয়াকে তার পূর্ণাঙ্গ আরজি পেশ করার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে। আগামী ২৩ অক্টোবরের মধ্যে গাম্বিয়াকে গণহত্যা মামলার পূর্ণ আরজি পেশ করতে বলা হয়েছে এবং মিয়ানমারকে তার জবাব দিতে হবে ২০২১ সালের ২৩ জুলাইয়ের মধ্যে। আইসিজের নির্দেশে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক পরিসরে বিশেষ চাপের মধ্যে রয়েছে। দেখার বিষয়, মিয়ানমার আইসিজের এই নির্দেশনা কতটুকু গুরুত্ব দিচ্ছে। মানবিক সংকট হিসেবে শুরু হলেও পর্যায়ক্রমে ভূরাজনৈতিক সংকটে রূপ নিচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যু। সংকটের মাত্রা এত ব্যাপক যে, এখন আর এর দ্রæত সমাধানের পূর্বাভাস দিতে পারছেন না কোনো বিশ্লেষকই। এ সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়কে সোচ্চার হতে হবে। জাতিগতভাবে নিধনের উদ্দেশে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে আসছে কয়েক দশক ধরে। কিন্তু গত ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে এবং সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে অভিযানের নামে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর অত্যাচার-নির্যাতন শুরু করে নির্মমভাবে। সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা, ধর্ষণের শিকার হয়েছে অসংখ্য রোহিঙ্গা নারী। সহিংসতার ঘটনায় প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর আগে থেকেই আরো অন্তত ৪ লাখ রোহিঙ্গা বিভিন্ন সময় পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রতি সমবেদনা এবং মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রতি সংহতি এবং রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসনের তাগিদ জানিয়ে আসছে বিশ্ব স¤প্রদায়। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়েছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য ২০১৭ সালে ২৩ নভেম্বর মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে দুদেশের মধ্যে একটি চুক্তিও স্বাক্ষর হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা শুরু হয়নি। রোহিঙ্গারা রাখাইন রাজ্যে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারের পদক্ষেপের ওপর কোনো আস্থা রাখতে পারছে না। অপরদিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতেও আন্তরিক নয় মিয়ানমার। এ পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে তাদের নিরাপত্তার জন্য মিয়ানমারের উপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের বিষয়ে জাতিসংঘে পাঁচ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। জাতিসংঘ এ মুহূর্তে রোহিঙ্গা সংকটকেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও সংকট সমাধানে গত তিন বছরে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা দৃশ্যমান হয়নি। বরং গত তিন বছরে রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা ক্রমাগত কমেছে। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে এখন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের মনোযোগ নেই বললেই চলে। সার্বিকভাবে পরিস্থিতিটা এমন জায়গায় যে, খুব শিগগিরই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু নিয়ে আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না। তবে আশা হারালে চলবে না। প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতেই হবে। মানবিক কারণেই প্রতিবেশী মিয়ানমারের নাগরিকদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের বাড়তি দায়িত্ব বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই বড় বোঝা। আন্তর্জাতিক অপরাধ কোর্ট ও আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে এ সংকটের বিচার প্রক্রিয়া চলছে। আমরা আশা করছি, দ্রুত এই সংকটের সমাধান হবে।