রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরার আকুতি

17

রাসেল চৌধুরী, কক্সবাজার

মিয়ানমারে ২০১৭ সালে সংঘটিত গণহত্যার বিচার ও পূর্ণ নাগরিক অধিকার দিয়ে মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের দাবিতে শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছেন রোহিঙ্গারা। বাস্তুচ্যুত হয়ে জীবন নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে আসার পাঁচ বছরের মাথায় গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে উখিয়া-টেকনাফের ২০টি ক্যাম্পে পৃথকভাবে আয়োজিত মানববন্ধন ও সমাবেশ এ দাবি জানিয়েছেন রোহিঙ্গারা।
‘গো ব্যাক হোম’- এই প্রতিপাদ্যে অনুষ্ঠিত মানববন্ধন ও সমাবেশে গণহত্যার বিচার ও পূর্ণ নাগরিক অধিকার দিয়ে মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের দাবিতে বক্তব্য রাখেন ক্যাম্প ও বøকভিত্তিক কমিউনিটি রোহিঙ্গা নেতারা। এসময় উপস্থিত সাধারণ রোহিঙ্গাদের হাতে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ লেখা একবাক্যের প্ল্যাকার্ড দেখা গেছে। রোহিঙ্গা নেতাদের বক্তব্যে ছিল স্বদেশে ফেরার আকুতি
অনুমতি ছিল শ’খানেক রোহিঙ্গা হাজির হয়ে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করার। কিন্তু সকাল সাড়ে দশটা থেকে বেলা বাড়ার সাথে সাথে গণহত্যার বিচার ও প্রত্যবাসনের দাবিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানববন্ধনে জড়ো হন হাজার হাজার রোহিঙ্গা। এতে মানববন্ধন সমাবেশে রূপ নেয়। এসময় রোহিঙ্গা নেতারা তাদের নিরাপদ আশ্রয় দেয়ায় বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানান ।
রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, আমরা বিশ্বের সকল নাগরিকের কাছে দাবি জানাচ্ছি ২০১৭ সালে মিয়ানমারে সংঘটিত রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার করুন। আমাদের মা-বোনদের ধর্ষণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার করুন। আর আমাদের নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন। আমাদের সহায় সম্বল ফিরিয়ে দিন। এসব দাবিতে সোচ্চার ছিলেন সমাবেশে অংশ নেয়া রোহিঙ্গারা। সকাল থেকে লোকজন কুতুপালং খেলার মাঠে জড়ো হতে শুরু করেন। সমাবেশে পুরুষদের পাশাপাশি রোহিঙ্গা নারী-শিশুরাও যোগ দেন। পোস্টার, প্ল্যাকার্ডে গণহত্যা ও দমন-পীড়নের বিচার এবং পূর্ণ নাগরিক অধিকারসহ মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার দাবি তোলেন রোহিঙ্গারা। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার শোয়াইব, মাস্টার নুরুল আমিন, মাস্টার মোহাম্মদ জোবায়ের, মোহাম্মদ ইউসুফ, মাস্টার কামাল প্রমুখ। সমাবেশের শেষদিকে মোনাজাত পরিচালনা করা হয়। মোনাজাত চলাকালে অত্যাচার-নিপীড়নের বিচার চেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুরা। কুতুপালং ছাড়াও বালুখালী, পালংখালী, থাইংখালীর তাজনিমারখোলাসহ ২০টি ক্যাম্পে এ সমাবেশ ও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ক্যাম্পে নিরাপত্তায় নিয়োজিত ৮ এপিবিএন’র -উপ অধিনায়ক কামরান হোসেন বলেন, আমাদের আওতাধীন ১৬, ১৩ নম্বর ক্যাম্পসহ ১১টি ক্যাম্পের ২০টি পৃথক স্থানে রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফেরার আকুতি জানিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে। তাদের কর্মসূচিকে ঘিরে নিরাপত্তা জোরদার ছিল।
এদিকে রোহিঙ্গা ‘গণহত্যা’র পাঁচ বছর পূর্তিতে উখিয়ার ১, ৩, ৫, ৭, ৮, ৯, ১২, ১৩, ১৯, ২০, নম্বর ক্যাম্পেও পৃথকভাবে কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। এসব কর্মসূচি থেকে মিয়ানমারে গণহত্যার বিচার ও দ্রæত প্রত্যাবাসনসহ কয়েকটি দাবি তুলে ধরা হয়েছে। দাবিগুলো হলো- মিয়ানমারের পার্লামেন্টে রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি, মিয়ানমার ট্রানজিট ক্যাম্পে সীমিত সময় রেখে সকল রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন, সেফজোন, নিজস্ব সহায়-সম্বল ফেরত ও রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী হিসেবে উত্থাপন না করা ইত্যাদি। এছাড়া প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, ওআইসি, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন ও বাংলাদেশসহ দাতা সংস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবিও রয়েছে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সেই দেশের রাখাইন অঞ্চলের মংডু, বুচিথং ও রাসেথং জেলার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর নির্বিচারে হত্যা ও নির্যাতন শুরু করে। ওই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নামে। তখন সীমান্ত পেরিয়ে অন্তত সাত লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারে এসে আশ্রয় নেন। ওই দিনটিকে স্মরণ করে কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা ‘রোহিঙ্গা জেনোসাইড রিমেম্বার ডে’ পালন করে আসছে। এর আগে ২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট ক্যাম্পে প্রথমবারের মত বৃহৎ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মুহিবুল্লাহ। পরে তিনি ক্যাম্পের ভেতরেই নিজের সংগঠনের কার্যালয়ে বসা অবস্থায় সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। এবারের সমাবেশে সেভাবে কেউই নেতৃত্বে ছিলেন না। কমিউনিটি নেতা বা মাঝিরাই রোহিঙ্গাদের জড়ো করেন।