রোগীর সংখ্যা বাড়লেও চিকিৎসা ব্যবস্থা দুর্লভ

6

হাটহাজারী প্রতিনিধি

দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া যুবক মো. মহিউদ্দিন (৩৫)। পেশায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হলেও তিনি একজন হিমোফিলিয়া রোগী। মাত্র ৬ বছর বয়সে তার এ রোগের নাম শুনে ঘাবড়ে গিয়েছিল পুরো পরিবার। তবে তিনি থমকে যাননি। সময়ের ব্যবধানে ২০১২ সালে তিনি যোগ দেন হিমোফিলিয়া সোসাইটি অব বাংলাদেশ নামে একটি সংগঠনে। বর্তমানে তিনি এ সোসাইটি’র চট্টগ্রাম শাখার অর্থ সম্পাদক।
মো. মহিউদ্দিন জানালেন তার সংগ্রামের কথা। গতকাল মঙ্গলবার মহিউদ্দিন জানান, তিনি হাটহাজারী উপজেলার ধলই ইউনিয়নের নুরা টেন্ডল বাড়ির মৃত কবির আহমদের একমাত্র ছেলে। পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। তিনি শৈশবকাল থেকে হিমোফিলিয়া রোগের সাথে যুদ্ধে করে আসছেন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পরের বছর ২০০৯ সালে তার পিতা (মসজিদের মুয়াজ্জিন) কবির আহমদের মৃত্যুর পর থেকে তিনি ৪ কন্যা সন্তানকে নিয়ে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলছেন।
মহিউদ্দিন বলেন, হিমোফিলিয়া হচ্ছে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণজনিত জন্মগত রোগ। এটি ছেলেদের হয়। আর মেয়েরা হয় বাহক, অর্থাৎ মেয়েরা জিন বহন করে। মায়ের কাছ থেকে সন্তানদের মধ্যে এর বিস্তার হয়। ছেলেদের বেলায় রোগটির প্রকাশ পায়। তবে রোগটি ছোঁয়াচে নয়। তবে আমাদের মত হতদরিদ্র রোগীদের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা পরিবারের পক্ষে কষ্টসাধ্য।
তিনি আরও জানান, এ রোগের চিকিৎসা বাবদ প্রতিটি ফ্যাক্টর এইট বা নাইন ইনজেকশনের মূল্য দুই হাজার ৭শ টাকা থেকে তিন হাজার টাকা। কখনও কখনও এর চেয়েও চড়া মূল্যে ক্রয় করতে হয় এ ইনজেকশন। এ ইনজেকশন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিনামূল্যে সরবরাহ করা হলেও বাংলাদেশে এটি দুষ্প্রাপ্য ও ব্যয়বহুল। এ ইনজেকশন সময়মতো রোগীকে দিতে না পারলে রোগীর পঙ্গুত্ববরণ বা অকাল মৃত্যুও হতে পারে। চিকিৎসা ব্যবস্থাও খুবই ব্যয় বহুল হওয়ায় এ রোগ নিয়ে চাপা কান্নায় আছেন হিমোফিলিয়া রোগীদের পরিবারগুলো। তাই আমাদের একটাই দাবি, আমরা আদর্শ মানের চিকিৎসা এবং ওষুধের ব্যবস্থা চাই। আমরা হিমোফিলিয়া রোগীরা প্রতিবন্ধী বা সমাজের বোঝা হয়ে বাঁচতে চাই না, সুস্থ এবং কর্মক্ষম হয়ে বাঁচতে চাই।
জানা গেছে, দেশে ক্রমেই হিমোফিলিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়লেও চিকিৎসা ব্যবস্থা এখনও দুর্লভ। এর মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হেমাটলজি বিভাগে স্বল্প পরিসরে চিকিৎসা প্রদান করা হলেও রোগ নির্ণয়ে দারস্থ হতে হয় ঢাকা কিংবা দেশের বাইরে। এ রোগের প্রয়োজনীয় ওষুধের দুষ্প্রাপ্যতা ও উচ্চমূল্যের কারণে রোগেীরা চিকিৎসা নিতে পারছেন না। রোগীরা সরকারি হাসপাতাগুলোতে বিনামূল্যে চিকিৎসার দাবি জানিয়েছেন। যদিও দূরারোগ্য এ রোগে আক্রান্তদেরকে প্রায় দুই যুগ ধরে বিনামূল্যে জীবন রক্ষাকারী ফ্যাক্টর এইট বা ফ্যাক্টর নাইন ইনজেকশন প্রদান করে আসছে বাংলাদেশ হিমোফিলিয়া সোসাইটি। ১৯৯৪ সালের ১৮ মার্চ এ সেবাদানকারী সংস্থাটি যাত্রা শুরু করে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারি স্কুলের এক সহকারী শিক্ষিকা বলেন, অভিভাবকদের সব সময় সতর্ক থাকতে হয়, যাতে সন্তান কোনভাবেই ব্যথা না পায়। আর ব্যথা পেয়ে গেলে বা উপসর্গ দেখা দিলে অপেক্ষা করার সময় থাকে না। বিনামূল্যে ইনজেকশন সব সময় পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও সেই ইনজেকশন কে পুশ করবেন, তা নিয়েও চিন্তার শেষ থাকে না। এছাড়া এ রোগে দুটি চিকিৎসা পদ্ধতি আছে। একটি হচ্ছে, রোগীর যে ঘাটতি, তা পূরণে নিয়মিত চিকিৎসা করে যাওয়া। আরেকটি হচ্ছে উপসর্গ দেখা দিলে তার চিকিৎসা করা। খরচের কথা চিন্তা করে বেশির ভাগ অভিভাবককেই উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা করাতে হচ্ছে।
হিমোফিলিয়া সোসাইটির তথ্যমতে, এ পর্যন্ত সারাদেশে ৩ হাজার ৬শ ৬০ জন হিমোফিলিয়া রোগী রয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে রয়েছে ৯২১ জন। এছাড়া দেশে বর্তমানে স্বল্প সংখ্যক হেমাটোলজিস্ট চিকিৎসক আছেন। তাদের পক্ষে এসব রোগীর চিকিৎসা করা সম্ভব না। ফিজিওথেরাপিস্টসহ পুরো একটি দলের মাধ্যমে চিকিৎসা দেওয়া প্রয়োজন হয়, যা দেশের রোগীরা পাচ্ছেন না।
হিমোফিলিয়া সোসাইটি অব বাংলাদেশ চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন যে পরিমাণ রোগী বাড়ছে, সেই পরিমাণ চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি চট্টগ্রামে। চমেক হাসপাতালের হেমাটলজি বিভাগে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হলেও পূর্ণাঙ্গ রোগ শনাক্তের জন্য নেই তেমন কোন যন্ত্রপাতি। বলা চলে এ রোগের ব্যাপারে চিকিৎসক ও রোগীরা সচেতন হলেও রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা ব্যবস্থা এখনও দুর্লভ। এছাড়া উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে এসব রোগীর সচেতনতায় মূল কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। তাই এ বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে।
চিকিৎসকরা বলছেন, এ রোগে আক্রান্তদের শরীরের কোন অংশ কেটে গেলে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয় না। কোন কারণ ছাড়াই যে কোন সময় রোগীর মস্তিষ্ক, ঘাড়, গলা ও হাড়ের সংযোগস্থলে ফুলে যাওয়া বা রক্তক্ষরণ হতে পারে। আর তখনই রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে অন্যান্য ওষুধের পাশাপাশি জরুরিভিত্তিতে ফ্যাক্টর এইট, ফ্যাক্টর নাইন ইনজেকশন ও ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা (এফএফপি বøাড) দিতে হয়। কিন্তু চিকিৎসার এ উপকরণগুলো সরকারি জেলা হাসপাতালগুলোতে না থাকায় রোগীকে জরুরি ভিত্তিতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল অথবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে পাঠানো হয়।
এ ব্যাপারে চমেক হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ হেমাটোলজিস্ট ও হেমাটলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক গোলাম রব্বানী জানান, দেশে বর্তমানে ১৬০-১৭০ জন হেমাটোলজিস্ট চিকিৎসক আছেন। সারাদেশে শনাক্তকৃত সাড়ে ৩ হাজার হিমোফিলিয়া রোগী রয়েছে। এছাড়া রোগটি সঠিকভাবে নির্ণয় করা গেলে শনাক্তকৃত রোগীর চেয়ে ৫-৬ গুণ বেশি রোগী পাওয়া যাবে। অথচ এত স্বল্প সখ্যংক চিকিৎসকের পক্ষে এসব রোগীর চিকিৎসা সেবা দেওয়া সম্ভব নয়। তার মধ্যে এ রোগে আক্রান্ত রোগীদের জরুরি চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ ফ্যাক্টর এইট, ফ্যাক্টর নাইন ইনজেকশন ও ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা বিভাগীয় শহরগুলোতে সহজলভ্য নয়।
তিনি আরও জানান, আমরা মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ক্রিওপ্রিসিপিটেটেড অ্যান্টিহেমোফিলিক ফ্যাক্টর ও ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা (এফএফপি বøাড) দিয়ে রোগীকে সুস্থ করার চেষ্টা করি। এ ধরনের রোগীর দেহে রক্ত দেওয়া ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার থাকে না। মাঝে-মধ্যে হিমোফিলিয়া বিশ্ব ফেডারেশন থেকে ফ্যাক্টর এইট, ফ্যাক্টর নাইন ইনজেকশন পাওয়া যায়, যা দিয়ে বেশি গুরুতর রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকি।
সরকারের পাশাপাশি এ বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় যথাযথ চিকিৎসা না পেলে হিমোফিলিয়া রোগী পঙ্গুত্ব বরণ করবে। যা পরিবারের জন্য সে বোঝা এবং দেশে প্রতিবন্ধীর পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করেন তিনি।