রেল কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ও সমন্বয়হীনতাই দায়ী!

18

১৯১৪ সালে প্রথম বিশ^যুদ্ধকালীন কর্ণফুলী নদীর ওপর কালুরঘাট রেলসেতুটি নির্মাণের প্রয়োজন দেখা দেয় । সে সময় ব্রিটিশরা বার্মায় সৈন্য আনা-নেওয়ার কাজে এটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৩০ সালে নির্মাণকাজ শেষ হয়। এ সেতুর মাধ্যমে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাথে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থায় ঐতিহাসিক পরিবর্তন আসে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাঙ্গু নদীর অববাহিকায় দোহাজারী পর্যন্ত চালু হয় ট্রেন। কিন্তু এ সেতুর মেয়াদ শেষ হয়েছে প্রায় বিশ বছর অতিক্রম হয়েছে, সেতুটি পুনঃনির্মাণ বা নতুন একটি সেতু নির্মাণের কথা ক্ষণে ক্ষণে শোনা গেলেও কখন নাগাদ সেই সেতু হবে, তা নিয়ে নিশ্চিত কোন সংবাদ কেউ দিতে পারছেন না। রেল কর্তৃপক্ষ জোড়াতালি দিয়ে কোনরকমে চালু রেখেছে এ সেতুটি। ঝুঁকি নিয়ে বোয়ালখালী-পটিয়ার প্রায় লক্ষাধিক মানুষ ২ জোড়া রেল ও একজোড়া ডেমো ট্রেনসহ কয়েকহাজার গণপরিবহন ও পণ্যবাহী ট্রাক এ সেতু দিয়ে পার হচ্ছে। এ অবস্থায় দোহাজারী থেকে কক্সবাজার ঘুমধুম পর্যন্ত রেল লাইনের কাজ চলছে দ্রুতগতিতে। মঙ্গলবার দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সরকার এই রেললাইনের বিস্তৃতি চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছে। পর্যটন ও অর্থনীতির দ্বার উন্মোচনে নেয়া স্বপ্নের এ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৫৪ শতাংশ। ইতোমধ্যে রামুর ঈদগাঁর পানিরছড়া এলাকায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসানো হয়েছে রেলট্র্যাক। প্রকল্পে যুক্ত থাকা সেতু, কালভার্টের ৮৫ শতাংশ কাজ শেষ। আইকনিক স্টেশনসহ ৯টি স্টেশনের নির্মাণকাজও শেষ পর্যায়ে। এত অগ্রগ্রতিতেও অতৃপ্তি রয়েই যাবে। কালুরঘাট সেতু না হওয়ায় দোহাজারী-ঘুমধুম রেললাইন প্রকল্পের সুফল সহসাই মিলবে না। প্রতিবেদনে বলা হয়, যখানে দোহাজারী-ঘুমধুম রেললাইন প্রকল্প ২০২২ সালে শেষ করার চিন্তাভাবনা চলছে সেখানে কালুরঘাট সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরুতেই থমকে আছে। নকশা প্রণয়ন, সেতুর উচ্চতা, ব্যয়বৃদ্ধি ও সেতুর পরিধি নির্ধারণেই সময়ক্ষেপণ চলছে কালুরঘাট সেতুর। কালুরঘাট সেতু প্রকল্পের পরিচালক ও রেলওয়ের পরিচালক (প্রকিউরমেন্ট) গোলাম মোস্তফার উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, কালুরঘাট সেতু ১২ দশমিক দুই মিটার উচ্চতায় নির্মিত হবে। এতে ব্যয় হবে চার হাজার কোটি টাকা। সেতুর দৈর্ঘ্যও বাড়বে। মূল সেতু এক কিলোমিটার হলেও পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে এ সেতুর পরিধি। নতুন নকশা প্রণয়ন কাজ চলছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী এক বছরের মধ্যেই মাঠ পর্যায়ের কাজ শুরুর চিন্তাভাবনা আছে। অর্থাৎ যখন কক্সবাজার রেল লাইন প্রায় সম্পন্ন হবে, তখন কালুরঘাট সেতুর মাঠ পর্যায়ের কাজ শুরু হতে পারে। ফলে ধরে নেয়া যায়, দীর্ঘ প্রতিক্ষিত শহর চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার ঘুনধুম পর্যন্ত রেলে চড়ে যাতায়াতের ভোগান্তি রয়েই যাচ্ছে। এটি আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যই বলা যায়। যদিও রেল কর্তৃপক্ষের অনেকে মনে করছেন দোহাজারী-কক্সসবাজার-ঘুনধুম প্রকল্প শেষ হওয়ার সাথে সাথে রেল যোগাযোগ শুরু হবে। তা হতে পারে দোহাজারী থেকে সরাসরি অথবা চট্টগ্রাম শহর চট্টগ্রাম থেকেও হতে পারে। আমরা মনে করি, ‘যদি’ বা ‘হতে পারে’ এ শব্দগুলো ব্যবহার না করে শহর চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল যোগাযোগ ২০২২ সালে শুরু করার পরিকল্পনা নিলে এবং দোহাজারী-ঘুনধুম ও কালুরঘাট সেতু প্রকল্প পরিচালকদের মধ্যে সমন্বয় হলে শেষ সময়ে এসে সন্দেহ ও সংশয় প্রকাশ করার অবকাশ থাকতনা। এখানে রেল কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ও সমন্বয়হীনতা নেই বললে দায় এড়ানো যাবে না। এরপরও আমরা আশা করি, যথা শিগ্গির সম্ভব কালুরঘাট রেল সেতুটি পুনঃনির্মাণের কাজ শুরু করা হবে। অন্যথায় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের অগ্রাধিকারে থাকা এ রেল প্রকল্পটি সরকার ও জনগণ কেউ সুফল পাবেনা। উল্লেখ্য যে, মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় রেলওয়ে সেতুটিকে ২০০১ সালে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে। এরপর ২০১১ সালে চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) একদল গবেষকও এটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা দেয়। সেতুর পূর্বপাশে দুটি সাইনবোর্ড দিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। একটিতে লেখা ‘১০ টনের অধিক মালামাল পরিবহন নিষেধ।’ অপরটিতে লেখা, ‘এই সেতুর ওপর দিয়ে সাধারণ মানুষের চলাচল নিষেধ। আদেশ অমান্যকারীকে ফৌজদারিতে সোপর্দ করা হবে।’ এসব বিধিনিষেধ কিছুই মানা হচ্ছে না। ঝুঁকি নিয়ে সাধারণ মানুষ যেমন পারাপার করে তেমনি অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই ট্রাকও চলছে। সেতুর মাঝপথে গাড়ি বিকল হয়ে গেলে অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হয়। চট্টগ্রামের বোয়ালখালী, পূর্ব পটিয়া, দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া, শহরের চান্দগাঁও ও মোহরা এলাকার প্রায় ২০ লাখ মানুষ এই সেতুর ওপর নির্ভরশীল। কালুরঘাট সেতুর পশ্চিম পাশ (শহর এলাকা) থেকে বোয়ালখালী সদর গোমদন্ডির দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। কিন্তু ১০ মিনিটের এই পথ যেতে এখন সময় লাগে এক থেকে দেড় ঘণ্টা। সেতুতে ওঠার জন্য সব সময় দুদিকে গাড়ির দীর্ঘ সারি থাকে।