রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব পাস জাতিসংঘে

20

পূর্বদেশ ডেস্ক

জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রুশ আগ্রাসনের নিন্দা জানানো হয়েছে। পাশাপাশি ইউক্রেন থেকে সেনা প্রত্যাহারেরও আহব্বান জানানো হয়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর প্রতিবাদে বুধবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ডাকা জরুরি অধিবেশন সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সমর্থনে এই প্রস্তাব পাস হয়। প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত ছিল বাংলাদেশ।
এদিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে আইসিসি। ৩৯টি সদস্য রাষ্ট্রের অনুরোধে এ বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে। বিমান ও রকেট হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভ। দক্ষিণের শহর খেরসনের সড়কে রাশিয়ান সেনারা উপস্থিত হয়েছে বলে জানায় শহরটির মেয়র। রাতজুড়েই রাজধানী সহ বড় শহরগুলোতে বিমান হামলার সতর্কী সাইরেন চলেছে। ইউক্রেন- রাশিয়ার যুদ্ধ দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রবেশ করলো। দুই সপ্তাহে এই যুদ্ধ ইতিমধ্যে কয়েক হাজার মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে, ইউক্রেন ছেড়েছে ১০ লাখ শরণার্থী।
ইউক্রেনের আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে হামলা বন্ধ করে রুশ সেনাদের সরিয়ে নিতে সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবে ১৯৩ সদস্য দেশের মধ্যে প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় ১৪১টি দেশ। বাংলাদেশ, ভারত, চীন, পাকিস্তানসহ ৩৫টি দেশ ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল। প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয় রাশিয়াসহ পাঁচটি দেশ।
প্রস্তাবের পক্ষে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভোট দিয়েছে নেপাল। রাশিয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়ে সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে মস্কোর মিত্র হিসেবে পরিচিত চার দেশ বেলারুশ, উত্তর কোরিয়া, ইরিত্রিয়া ও সিরিয়া। চীনের সঙ্গে ভোটদানে বিরত ছিল মস্কোর দীর্ঘদিনের মিত্র কিউবা ও নিকারাগুয়া। ভেনেজুয়েলা চাঁদার অর্থ না দেওয়ায় ভোট দিতে পারেনি। তবে দেশটির প্রেসিডেন্ট নিকোলো মাদুরো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুটিনকে কয়েক দিন আগে ফোনে ইউক্রেন ইস্যুতে সব সময় রাশিয়ার পাশে থাকবে বলে জানিয়েছেন।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, সাধারণ পরিষদের আজকের (বুধবার) প্রস্তাবে একটি সত্যের প্রতিফলন ঘটেছে। সেটা হলো, বিশ্ব ইউক্রেনের ভয়ংকর মানবিক যন্ত্রণার অবসান চায়। অবিলম্বে শত্রুতা বন্ধ করতে এবং শান্তির জন্য জরুরি আলোচনায় অবদান রাখার জন্য আমি আমার ক্ষমতার সবকিছুই করে যাব।
গত সোমবার সাধারণ পরিষদের তিন দিনের বিশেষ জরুরি অধিবেশন শুরু হয়। ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন বন্ধের প্রস্তাবে বুধবার অবিলম্বে ও শর্তহীনভাবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইউক্রেনের সীমানা থেকে রাশিয়ার সব ধরনের সেনা সদস্যদের সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে নেওয়ার আহŸান জানায় জাতিসংঘ। বৈঠক শুরুর পরদিন মঙ্গলবার বিতর্কে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ জাতিসংঘ মহাসচিবের নেতৃত্বে সংলাপের মাধ্যমে সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের ওপর জোর দেয়। এবং জাতিসংঘ সনদে বর্ণিত সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় অখন্ডতার নীতির প্রতিও সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে বাংলাদেশ।
এর আগে ইউক্রেন প্রশ্নে নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকে নিন্দা প্রস্তাবে রাশিয়ার ‘ভেটোর’ কারণে তা বাতিল হলে বিষয়টি আলোচনার জন্য সাধারণ পরিষদে আসে। বৈঠকের প্রথম দিনে আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, যথেষ্ট হয়েছে, ইউক্রেনে হামলা এখনই বন্ধ করতে হবে।

বাংলাদেশ জাতিসংঘে বিতর্কে যা বলেছে : বিতর্কের দ্বিতীয় দিন জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের উপপ্রধান মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেন তার বক্তব্যে কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণের জন্য জাতিসংঘ মহাসচিবকে আহব্বানের পাশাপাশি যুদ্ধপীড়িত অঞ্চল থেকে সরে যেতে আগ্রহীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহব্বান জানান।
এ সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন নিউইয়র্কে অবস্থান করলেও জাতিসংঘের এই বিতর্কে অংশ নেননি। তিনি একটি স্থানীয় বাংলা টিভিতে বাংলাদেশের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘আমরা সব রকম যুদ্ধের বিরুদ্ধে। জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্যোগে এ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান হোক, আমরা সেটাই চাই। ক্ষুদ্র দেশ হিসেবে সব রকম যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক সংকট বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন।
ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে তদন্ত শুরু আইসিসির : ইউক্রেনে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)।
আইসিসির ৩৯টি সদস্য রাষ্ট্র এ বিষয়ে তদন্তের অনুরোধ জানানোর পর বুধবার আইসিসির অভিশংসক করিম খান জানান, অবিলম্বে বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করবেন তিনি।
২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে পূর্ণ মাত্রার আক্রমণ শুরু করে রাশিয়া। এরপর এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও কিয়েভের ভলোদিমিরি জেলেনস্কি সরকারকে উৎখাত করতে পারেনি তারা। কিন্তু এরই মধ্যে কয়েক হাজার মানুষ হতাহত হয়েছে বলে উভয় দেশের কর্মকর্তা ও জাতিসংঘের তথ্য থেকে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।
এক টুইটে করিম খান বলেছেন, ৩৯টি সদস্য রাষ্ট্রের সুপারিশ পাওয়ার পর ইউক্রেনের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করা হয়েছে।
সদস্য রাষ্ট্রগুলোর এই সুপারিশের কারণে দ্য হেগের আদালতের অনুমোদন এড়িয়ে সরাসারি তদন্ত শুরু করার সুযোগ পেলেন অভিশংসক খান। আদালতের অনুমোদন নেওয়ার প্রক্রিয়ায় গেলে কয়েক মাস সময় লেগে যেত বলে বার্তা সংস্থা রয়টাসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এক বিবৃতিতে খান বলেছেন, ইউক্রেইনের ভূখন্ডের কোনো অংশে কোনো ব্যক্তি কর্তৃক কোনো যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ বা গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার পূর্ববর্তী ও বর্তমান অভিযোগগুলোর বিষয়ে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করতে শুরু করবে অভিশংসকের দপ্তর।

যা বলছেন বিশ্বনেতারা : যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক ঐক্যে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন রয়েছে। তা অটুট রাখতে ইউক্রেনের সরকার ও জনগণের পাশে রয়েছে ওয়াশিংটন।’ তিনি আরও বলেন, পরিস্থিতির কূটনৈতিক সমাধানের ব্যাপারে পুতিনের কোনো আগ্রহ নেই।
হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি জেন সাকি বলনে, ‘রুশ আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। জেন সাকি আরও জানান, ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের জবাব দিতে মিত্রদের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রæত ও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউক্রেনের দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলে নতুন বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও অর্থায়ন নিষিদ্ধ করে নির্বাহী আদেশে সই করেছেন বাইডেন।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র জানান, ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা এবং ভৌগোলিক অখÐতার প্রতি জাতিসংঘের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। একই সঙ্গে দেশটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃত সীমান্তের প্রতিও জাতিসংঘের সমর্থন রয়েছে। রাশিয়ার এমন উদ্যোগ জাতিসংঘ সনদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর প্রধান জেন স্টলটেনবার্গ বলেছেন, এটা মিনস্ক চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। অথচ ওই চুক্তিতে রাশিয়া ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখন্ডতার রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। রুশ আগ্রাসন মিনস্ক চুক্তি ও ইউক্রেনের ভৌগোলিক অখন্ডতার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন’ বলে মন্তব্য করেছেন ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন দে লিয়েন।
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার নিন্দা জানিয়েছেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নেতারা। তারা বলেছেন, ব্যবস্থা নেওয়া হবে মস্কোর বিরুদ্ধে।
জার্মান সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন এবং তাকে সমর্থন জানিয়েছেন। জার্মানির বাণিজ্যমন্ত্রী রবার্ট হাবেক বলেন, এ হামলার ঘটনা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেন, ‘বিনা উসকানিতে’ এ হামলার ঘটনায় আমি ‘শঙ্কিত’ এবং ব্রিটেন এর জবাব দেবে।
ইতালির প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘি বলেন, এ হামলার ঘটনা অন্যায় এবং অযৌক্তিক। ঐক্য ও সংকল্পবদ্ধ হয়ে ইউরোপ ও ন্যাটোর মিত্রদের সঙ্গে দ্রæত প্রতিক্রিয়া দেখানোর জন্য আমরা কাজ করছি।
অপরদিকে পোল্যান্ড সরকারের মুখপাত্র পিওতর মুলার বলেন, এখন পূর্বাঞ্চলে ন্যাটোর শক্তিবৃদ্ধির সময়। খবর : রয়টার্স, বিবিসি ও দ্য গার্ডিয়ানের।