যাকাত : ফযীলত, উপকারিতা ও মাসায়েল

4

সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী

যাকাত একটি ফরয তথা অত্যাবশ্যকীয় ইবাদত এবং ইসলামের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিধান ও ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম। ঈমান ও নামাযের পরেই যাকাতের স্থান। যার অস্বীকারকারী বা তুচ্ছ তাচ্ছিল্লকারী কাফির ও মুরতাদ এবং অনাদায়কারী ফাসিক ও ভয়াবহ শাস্তিযোগ্য অপরাধী। কুরআন শরীফে আল্লাহ তা’আলা যখনই নামায আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন; পাশাপাশি অধিকাংশ ক্ষেত্রে যাকাত আদায়েরও নির্দেশ দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে ৩২ জায়গায় যাকাত আদায় করার ব্যাপারে আলোচনা এসেছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, “আর তোমরা নামায কায়েম কর, যাকাত আদায় করো এবং রুকু কর রুকুকারীদের সঙ্গে।’ (সূরা বাকারা : ৪৩)
তিনি আরও ইরশাদ করেন, “আর আল্লাহ যাদেরকে তাঁর অনুগ্রহ থেকে যা দান করেছেন তা নিয়ে যারা কৃপণতা করে তারা যেন ধারণা না করে যে, তা তাদের জন্য কল্যাণকর; বরং তা তাদের জন্য অকল্যাণকর। যা নিয়ে তারা কৃপণতা করেছিল; কিয়ামত দিবসে তা দিয়ে তাদের বেড়ি পরানো হবে। আর আসমানসমূহ ও যমীনের উত্তরাধিকার একমাত্র আল্লাহরই জন্য। আর তোমরা যা আমল কর সে ব্যাপারে আল্লাহ সম্যক জ্ঞাত”। (সূরা আলে-ইমরান:১৮০)
যাকাতের পরিচয়: ‘যাকাত’ এর শাব্দিক অর্থ বৃদ্ধি পাওয়া, পবিত্রতা লাভ করাও প্রাচুর্য বা বরকতমন্ডিত হওয়া। যাকাত দ্বারা যাকাতদাতার সম্পদের যেমন পবিত্রতা ও বৃদ্ধি আসে তেমনি আত্মারও পরিশুদ্ধতা লাভ হয় বিধায় যাকাতকে যাকাত বলা হয়। আর ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত সম্পদের একাংশ মুসলিম দরিদ্র ব্যক্তিকে বিনা শর্তে ও বিনা স্বার্থে প্রদান করে মালিক বানিয়ে দেয়ার নাম ‘যাকাত’।
যাকাত আদায়ের উপকারিতা: যাকাতের অন্যতম উপকারীতা হলো, যাকাত মানুষকে কৃপণতা থেকে বিরত রাখে। মানুষকে পরোপকারী, অন্যের ব্যথায় সমব্যথী, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতিশীল ও সহমর্মী হতে সাহায্য করে। যাকাত আদায়ের মাধ্যমে মুসলমানদের মনোবল বৃদ্ধি পায়। মান-মর্যাদা অক্ষুন্ন থাকে এবং আত্মমার্যাদা ও সম্মানবোধ বৃদ্ধি পায়। যাকাত আদায়ের মাধ্যমে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ভালোবাসা ও সৌহার্দ্যরে সেতুবন্ধন রচিত হয়। দূর হয় পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ। কারণ গরিবরা যখন ধনীদের সম্পদ দ্বারা উপকৃত হয় এবং তাদের সহানুভূতি লাভ করে, তখন তাদের সহযোগিতা করে এবং তাদের স্বার্থ ও সম্মান রক্ষায় সচেষ্ট হয়।
যাকাত একটি দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও গতিশীলতাকে স্বাভাবিক রাখার নিশ্চয়তা বিধান করে। যাকাত ভিত্তিক অর্থব্যবস্থাই বর্তমান অর্থব্যবস্থার সব প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি ও নানাবিধ সমস্যার যথোপযুক্ত সমাধান।
যাকাত আদায়ের অন্যন্য উপকারিতার মধ্যে রয়েছে,
> গরীবের প্রয়োজন পূরণ ও অভিশপ্ত পুঁজিতন্ত্রের মূলোৎপাটনের মাধ্যমে সম্পদ কুক্ষিগত করার মানসিকতাকে নির্মূল করে সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য সৃষ্টি করা।
> মুসলমানদের সামগ্রিক শক্তি বৃদ্ধি করে দারিদ্র্য বিমোচনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
> চুরি-ডাকাতি-ছিনতাইসহ সব রকম অভাবজনিত অপরাধের মূলোৎপাটন করে গরীব-ধনীর মাঝে সেতুবন্ধন সৃষ্টি করা।
> সম্পদের বরকত ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি লাভ করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,“যাকাতের সম্পদ কমে না। (মুসলিম:৬৭৫৭)
> সম্পদের উপকারিতার পরিধি বৃদ্ধি করা। কেননা সম্পদ যখন যাকাতের মাধ্যমে অভাবীদের মাঝে বণ্টিত হয়, তখন এর উপকারিতার পরিধি বিস্তৃত হয়। আর যখন তা ধনীর পকেটে কুক্ষিগত থাকে, তখন এর উপকারিতার পরিধিও সঙ্কীর্ণ হয়।
> যাকাত প্রদানকারী দান ও দয়ার গুণে গুণান্বিত হয়ে অভাবীদের প্রতি মায়া-মমতায় আগ্রহী হয়।
> যাকাতপ্রদানকারী কৃপণতার ন্যায় অসৎ গুণ থেকে নিজেকে পবিত্র করে।
> সর্বোপরি আল্লাহর বিধান পালন করার মাধ্যমে ইহকাল ও পরকালে তাঁর নৈকট্য লাভ করা।
যাকাত পরিশোধ না করার পরিণাম: যারা যাকাত আদায় করে না তাদের ব্যাপারে কঠোর শাস্তির সংবাদ এসেছে পবিত্র কুরআন ও হাদীসে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, “আর যারা স্বর্ণ ও রূপা জমা করে রাখে এবং তা ব্যয় করে না আল্লাহর পথে, তাদের কঠোর আযাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন। সে দিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে (সেদিন বলা হবে), এগুলো যা তোমরা নিজেদের জন্যে জমা রেখেছিলে, সুতরাং এক্ষণে আস্বাদ গ্রহণ কর জমা করে রাখার। (আত তাওবা-৩৪-৩৫)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “যে কোন স্বর্ণ বা রুপার মালিক যদি আপন সম্পদের যাকাত আদায় না করে, তার এ সম্পদকে জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করে কিয়ামতের দিন তা দ্বারা পিঠ, পার্শ্ব এবং কপালে ছ্যাকা দেয়া হবে। আর যখনই তা ঠান্ডা হবে সাথে সাথে আগুনে পুণরায় উত্তপ্ত করা হবে। এমন দিনে তাকে শাস্তি দেয়া হবে যে দিনটি হবে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। আর বান্দার বিচারকার্য শেষ হওয়া পর্যন্ত এভাবে চলতে থাকবে। অত:পর সে দেখতে পাবে তার গন্তব্য হয় জান্নাতের দিকে নয়তো জাহান্নামের দিকে।’ (মুসলিম-৯৮৭)
তিনি আরো ইরশাদ করেন, “আল্লাহ তা‘আলা যাকে সম্পদ দিয়েছেন অথচ সে তার যাকাত আদায় করে না, কিয়ামত দিবসে তার সম্পদকে দুই চোখ বিশিষ্ট বিষাক্ত সাপে পরিণত করা হবে। তারপর সাপটিকে কিয়ামতের সে দিবসে তার গলায় জড়িয়ে দেয়া হবে। সাপ তার দুই মুখে দংশন করতে করতে বলবে, আমি তোমার বিত্ত, আমি তোমার গচ্ছিত সম্পদ।’ (বুখারী-১৪০৩)
যে সব সম্পত্তিতে যাকাত ওয়াজিব হয়: যে সব সম্পত্তিতে যাকাত ওয়াজিব হয় তা হলো,
প্রথমত. জমিনে উৎপাদিত ফসল, ফল ও বীজের ওপর যাকাত ওয়াজিব।
দ্বিতীয়. গবাদি পশু যেমন- উট, গরু, ছাগল ইত্যাদির ওপর যাকাত ওয়াজিব। এসব জীব-জন্তুর যাকাত ওয়াজিব হবে যখন মুক্ত বিচরণকারী এবং নিসাব পরিমাণ হয়।
তৃতীয়. স্বর্ণ, রৌপ্যেও যাকাত ওয়াজিব। স্বর্ণের পরিমাণ কমপক্ষে সাড়ে সাত তোলা এবং রৌপ্যের পরিমাণ সাড়ে বায়ান্ন তোলা হতে হবে।
চতুর্থ. ব্যবসার মালামালের মধ্যে যাকাত ওয়াজিব। জমি, গবাদি পশু, খাদ্য-পানীয় ইত্যাদি সবকিছুতেই যাকাত ওয়াজিব যদি ব্যবসার উদ্দেশ্য থাকে। সুতরাং মালিককে বছর শেষে হিসাব করে এসবের যাকাত পরিশোধ করতে হবে।
যাকাত কাকে দেবেন? আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, “যাকাত কেবল নি:স্ব, অভাবগ্রস্থ ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, দাস মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্থদের জন্য, আল্লাহর পথে জিহাদকারী ও মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময় (আল কুরআন, আত তাওবা:৬০)।
এ খাতের বাইরে অন্য কোন খাতে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে না।
কার উপর যাকাত ফরয? ‘নেসাব’ তথা ৭.৫ ভরি স্বর্ণ বা ৫২.৫ ভরি রূপা অথবা সমমূল্যের নিত্য প্রয়োজনোতিরিক্ত সম্পদের মালিক হলে এবং এ অবস্থায় এক বছর অতিক্রান্ত হলে। তাই কারো যদি নেসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর পর্যন্ত থাকে, তাহলে তার উপর যাকাত ফরয হবে। বর্তমান হিসাব অনুযায়ী যদি ১ ভরি রূপা ১০০০ টাকা হয়, তাহলে ৫২.৫ ভরি রূপার দাম হবে- ৫২,৫০০ টাকা। তাকে শতকরা ২.৫ টাকা হিসেবে যাকাত আসে।
কোন কোন সম্পদের যাকাত দিতে হবে ? ১. নগদ টাকা-পয়সা, ব্যাংক ব্যালেন্স, বন্ড ও অন্যান্য ফাইন্যানশিয়াল ইন্সট্রুমেন্টস ২. সোনা-রূপা; অর্নামেন্ট, বার যা-ই হোক; তা নিত্যব্যবহার্য হলেও। ৩. ব্যবসার সম্পদ; যা ব্যবসার উদ্দেশে ক্রয়কৃত; কিংবা ব্যবহারের উদ্দেশে ক্রয়ের পর বিক্রয়কৃত। ব্যবসার কাঁচামাল, উৎপাদিত বস্তু, বা উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে থাকা বস্তু। শেয়ারও এ পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত। ৪. অন্যান্য প্রয়োজনোতিরিক্ত সম্পদ।
যে সকল সম্পদে যাকাত দিতে হবে না : জমি, বাড়ী-ঘর, দালান, দোকানঘর, কারখানা, কারখানার যন্ত্রপাতি, অফিসের আসবাবপত্র, গাড়ী, নৌকা, লঞ্চ, জাহাজ, বিমান ইত্যাদি।
যাদের যাকাত দেয়া যাবেনা : আপন দরিদ্র পিতা-মাতা, দাদা-দাদী তথা ঊর্ধ্বস্থ সকল নারী-পুরুষ। অনুরূপ ভরণ- পোষণে নির্ভরশীল পুত্র-কন্যা এবং স্বামী স্ত্রীকে যাকাত প্রদান করা জায়েয নাই। যাকাত বহির্ভুত সম্পদের দ্বারা তাদের ভরণ-পোষণ করা ওয়াজিব। অনুরূপ প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রকৃত বংশধরদের সম্মান ও মর্যাদার কারণে যাকাতের অর্থ দ্বারা সাহায্য করা জায়েয নয়। একমাত ঐচ্ছিক দানের অর্থ দ্বারাই তাদের খেদমত করা জরুরী।
মসজিদ, মাদ্রাসা, রাস্তা-ঘাট ইত্যাদি নির্মাণের জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা নিষেধ। সাধারণ আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করাও জায়েয নয়। তবে আশ্রয় প্রার্থীদের ব্যক্তি মালিকানাধীন ঘর-বাড়ী নির্মাণ করে দিলে আদায় হয়ে যাবে। কারণ যাকাত পরিশোধ হওয়ার জন্য ব্যক্তিকে মালিক বানিয়ে দেওয়া শর্ত। সুতরাং যাকাতের অর্থে মৃত ব্যক্তির দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করাও জায়েয নয়।
সম্পদ উপার্জনের যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার দিক থেকে মানুষের মধ্যে তারতম্য কমিয়ে ধনী-গরিবের মাঝে ভারসাম্য আনার জন্য মহান আল্লাহ যাকাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। যাতে ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দূর হয় এবং হিংসা-বিদ্বেষ, ফিতনা-ফাসাদ ও হত্যা-লুণ্ঠন মুক্ত সুশৃংখলা ও স্থিতিশীল সমাজ গঠিত হয়।

লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, খতীব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ