মৃত্যুর পূর্বে স্ত্রীর উদ্দেশে ফেসবুকে স্ট্যাটাস

114

স্ত্রীর সঙ্গে অভিমান করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের চিকিৎসক মোস্তফা মোরশেদ প্রকাশ আকাশ (৩২) আত্মহত্যা করেছেন। আকাশ চন্দনাইশ উপজেলার বরকল এলাকার মৃত আবদুস সবুরের ছেলে। তিনি এমবিবিএস শেষ করে এফসিপিএস পড়ছিলেন। গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরে নগরীর চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার নিজ বাসায় এ ঘটনা ঘটে।
ডা. মোস্তফা মোরশেদ আকাশকে সকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
আত্মহত্যার পূর্বে ডা. আকাশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের টাইমলাইনে স্ট্যাটাস, ছবি ও ভিডিও দিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির ঘটনাবলী তুলে ধরেন। তার সর্বশেষ স্ট্যাটাস ছিল ‘ভাল থেকো, আমার ভালোবাসা তোমার প্রেমিকদের নিয়ে।’ ‘আমার ভালোবাসা সবসময় ওর জন্য ১০০% ছিল। আমি আর সহ্য করতে পারিনি। আমাদের দেশে তো ভালোবাসায় চিটিং এর শাস্তি নেই। তাই আমিই বিচার করলাম আর আমি চিরশান্তির পথ বেছে নিলাম। তোমাদেরও বলছি কাউকে আর ভাল না লাগলে সুন্দরভাবে আলাদা হয়ে যাও। চিট কর না, মিথ্যা বল না। আমি জানি অনেকে বিশ্বাস করবে না, এত অমায়িক মেয়ে, আমিও এসব দেখে ভালোবেসেছিলাম। ভেতর-বাইর যদি এক হত। সবাই আমার দোষ দিবে সবকিছুর জন্য- তাই ব্যাখ্যা করলাম।

‘আমার শাশুড়ি দায়ী এসবের জন্য, মেয়েকে আধুনিক বানাচ্ছে। একটু বেশি বানিয়ে ফেলেছে। উনি চাইলে এখনো সমাধান হত।’ আরও লিখেছেন, ‘ও মা তুমি মাফ করে দিও, তোমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারলাম না। মায়ের ভালোবাসার কখনো তুলনা চলে না। বারবার বলছি- ভাল না লাগলে আলাদা হয় যাও, চিট কর না, মিথ্যা বল না বিশ্বাস ভাঙ্গিওনা। হাজার হাজার ছবি আছে আরো খারাপ খারাপ, দিলাম না। যারা বিলিভ করবে এতেই করবে, না করলে নাই। এই ৯ বছরে বয়ফ্রেন্ড স্বামী-স্ত্রীর মত আমার সাথে সবি করে গেল’।
জানা যায়, তানজিলা চৌধুরী মিতুর সাথে ২০০৯ সালে ডা. আকাশের পরিচয় হয়। ২০১৬ সালে তাদের বিয়ে হয়। মিতু কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ২০০৯-১০ সেশনের ছাত্রী। পরে ইন্টার্নশিপ করেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) থেকে। তবে বিয়ের আগে থেকেই মিতুর বিভিন্ন ছেলের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক ছিল। ব্যাপারটি তখন জানতেন না ডা. আকাশ। যখন জানতে পারেন তখন তাদের বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। নিজের মান-সম্মানের কথা চিন্তা করে আকাশ বিয়ে করেন মিতুকে।
ডা. আকাশ ফেসবুক স্ট্যাটাসে আরো লিখেছেন, প্রচন্ড ভালোবাসি ওকে। ও নিজেও আমাকে অনেক ভালোবাসে। আমরা ঘুরে বেড়াই, প্রেম করে বেড়াই। আমাদের ভালোবাসা কম-বেশি সবাই জানে। অনেকে বউ পাগলাও ডাকত। আমিতো বেঁচে থেকেও মৃত হয়ে গেলাম। তারপর ক্ষমা চাইল শবে কদরের রাতে, কান্না করে পা ধরে আর কখনো এমন হবে না। আমিও ক্ষমা করে দিয়ে ১ বছর ভালভাবেই সংসার করলাম। তারপর ও দেশের বাইরে আমেরিকা গেল। মাঝখানে একবার ঈদ পালন করতে আসল, সেপ্টেম্বরে ২০১৮-এ আবার চলে গেল। ইউএসএমএলই এর প্রিপারেশন নিচ্ছিল। ফেব্রুয়ারিতে ২০১৯-এ আমার ইউএসএ যাওয়ার কথা। আমি বারবার বলছি আমাকে ভাল না লাগলে ছেড়ে দাও, কিন্তু চিট কর না, মিথ্যা বল না।’
ডা. আকাশের মা জোবাইদা খানম বলেন, মিতুর মা সবসময় ওকে ফোনে কুমন্ত্রণা দিত। এমনকি বিয়ের পর বাচ্চাও নিতে দেয়নি। সবসময় বলত বাচ্চা নিলে পড়াশোনার ক্ষতি হবে, শরীর ভেঙে যাবে। তারপরও মিতুকে আমি নিজের মেয়ের মতো দেখতাম। এত কিছুর পরও আজ আমাকে আমার ছেলের মরা মুখ দেখতে হল’।
নিজের নাড়িছেঁড়া ধনকে অকালে হারিয়ে নিজ বাসায় বিলাপ করছিলেন জোবাইদা খানম। তাকে সান্তনা দিচ্ছিলেন আত্মীয়-স্বজন ও আকাশের বন্ধুরা। কিন্তু ছেলেহারা মায়ের মন কিছুতেই মানছিল না। ছেলের রুমের বিভিন্ন জিনিস দেখিয়ে অঝোরে কেঁদেই চলেছেন জোবাইদা।
কাঁদতে কাঁদতে জোবাইদা বলেন, বিয়ের পর থেকেই ঘরে অশান্তি। ওই মেয়ের (মিতু) অনেক ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। আমি কিছু জানতাম না। আকাশ জেনেও বুকে কষ্ট নিয়ে ঘর করেছে। কিন্তু বিয়ের পরও ওর এসব অভ্যাস যায়নি। একের পর এক ছেলেদের সঙ্গে সম্পর্ক করেছে।
তিনি বলেন, ভোররাতে এসব নিয়ে মিতুর সঙ্গে আকাশের ঝগড়া হয়। তখন আকাশ মিতুর বাবাকে ফোন করে তাকে নিয়ে যেতে বলে। ভোর সাড়ে ৪টার দিকে মিতুর বাবার বাড়ি থেকে গাড়ি আসে তাকে নিতে। সে চলে যায়। এরপর আকাশ মনমরা হয়ে সোফায় এসে বসে। মোবাইলে ফেসবুক চালাচ্ছিল। হয়ত তখনই মিতুর ছবিগুলো ফেসবুকে দিচ্ছিল। আমি এসে তার পাশে বসি। তখন আকাশ আমাকে ঘুমিয়ে যেতে বলে। এরপর আমাকে জড়িয়ে ধরে ঢলে পড়ে। হয়ত এর আগেই সে ইনজেকশন পুশ করেছে শরীরে। পরে ওর ঘরের বাথরুমে গিয়ে ইনজেকশনের সিরিঞ্জ পড়ে থাকতে দেখি।
আকাশের মা বলেন, দিনের পর দিন মানসিক অত্যাচার করে আমার ছেলেকে হত্যা করেছে মিতু। ও আত্মহত্যা করেনি, ওকে হত্যা করা হয়েছে।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আকাশের স্ত্রী মিতুর একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওতে দেখা যায়, ‘খাটে এলোমেলো হয়ে বসে আছেন মিতু। কেউ একজন তাকে তার পরকীয়া নিয়ে প্রশ্ন করছেন এবং তিনি উত্তরও দিচ্ছেন। ভিডিওতে বিভিন্ন পুরুষের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কের কথা মিতু স্বীকার করেন। ভিডিওটি ডা. আকাশের ফেসবুক আইডি থেকেই পোস্ট করা হয়।
এসব কথাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে অবশেষে আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন ৩২ বছরের এ তরুণ ডাক্তার। তাদের বিয়ের ৩ বছর অতিবাহিত হলেও কোনো সন্তান জন্ম নেয়নি। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ মাঠে প্রথম জানাজা ও বাদে মাগরিব গ্রামের বাড়ি পূর্ব বরকলের সিকদার বাড়ি এলাকায় দ্বিতীয় জানাজা শেষে তার লাশ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। মরহুমের লাশ গ্রামের বাড়িতে এসে পৌঁছলে তার বৃদ্ধা মা জোবাইদা খাতুন (৫৮) ও স্বজনদের আহাজারিতে আকাশ ভারী হয়ে উঠে।