মুক্তিযুদ্ধকালীন তাজউদ্দিন স্মৃতি

10

প্রফেসর ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া

(শেষ অংশ)
প্রথমেই জিজ্ঞেস করলাম কেমন আছেন। সবাই বললেন ভালো আছি। আমি প্রথমে আমার পরিচয় দিলাম। বললাম আমি চট্টগ্রাম কলেজে পদার্থবিদ্যার প্রভাষক। তারপর কিভাবে কোলকাতা আসলাম তার বর্ণনা দিলাম। তাজউদ্দিন সাহেব নীরবে শুনে যাচ্ছেন। তখন বললাম আমরা অনেক শিক্ষক ভারতে চলে এসেছি। আমরা কিভাবে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা দিতে পারি। প্রধানমন্ত্রী মহোদয় বললেন, প্রফেসর সাহেব সব তথ্য আমাদের আছে। উল্লেখ করতে হয় মননীয় প্রধানমন্ত্রীর ডান পার্শ্বে বা আমার বাম পার্শ্বে যে দু’জন বসেছিলেন তাঁরা হলেন আ.স.ম আবদুর রব, আবদুস কুদ্দুস মাখন আর প্রধানমন্ত্রীর বাম পাশে বা আমার ডান পাশে যে দু’জন বসেছিলেন তাঁরা হলেন- শাহজাহান সিরাজ ও নূরে আলম সিদ্দিকী। অর্থাৎ এঁরা চার খলিফা হিসেবে খ্যাত ছিলেন। টেবিলটা ছিল পড়ার টেবিলের চেয়ে একটু বড়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হাতলওয়ালা একটা কাঠের চেয়ারে বসেছিলেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন সাহেব আমার কথা খুব মনোযোগ সহকারে শুনলেন। তিনি বুঝলেন যে আমি নিজের কথা বলতে আসিনি। আমি বলতে এসেছি ভারতে অবস্থানরত সকল বাংলাদেশের শিক্ষকের কথা। উত্তরে বললেন, প্রফেসর সাহেব আমরা শিক্ষকদেরকে যুদ্ধ ক্ষেত্রে পাঠাতে পারিনা। কারণ শিক্ষকরা হচ্ছেন আমাদের সম্পদ, বুদ্ধিজীবী। আমি তখন বললাম আমাদেরকে প্রশিক্ষক হিসেবে (একাডেমিক) বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পাঠানো হোক। তিনি বললেন ইতোমধ্যে সবঠিক হয়ে গেছে। নূতন করে কিছু করা তো সম্ভব নয়। তবে তিনি বললেন আপনারা ভারতের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে ভারতীয়দের মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে জনমত গঠনে কাজ করে যান। হয় ব্যক্তিগতভাবে না হয় সমষ্টিগতভাবে। তবে এ আশ্বাস আমি আপনাকে দিতে পারি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আমরা দেশে অবশ্যই ফিরে যাবো। তখন তিনি তাঁর সামনে টেবিলে রাখা একটি চিঠি আমাকে পড়ে শোনালেন।
চিঠিটা প্রবাসী সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর কাছেই লিখা। চিঠিটা এসেছে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী থেকে। ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী ঐ চিঠিতে উল্লেখ করেছেন ভারতে বাংলাদেশের যে কোন সীমান্তে যদি ইসরাইলকে একটি এয়ার ভূমি (অরৎ ইধংব) যদি দেয়া হয় তাহলে ইসরাইল এয়ার জধরফ বা যুদ্ধের মাধ্যমে আঠার ঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীন করে দেবে। চিঠির বিষয়বস্তু শুনে আমি অসম্ভব উৎফুল্ল হয়ে পড়ি। তিনি বললেন যেহেতু ভারতের সঙ্গে ইসরাইলের কোন কুটনৈতিক সম্পর্ক নেই সেহেতু আমাদের এয়ার বন্দর দেয়ার প্রশ্নই উঠে না বা সম্ভব নয়। তারপরও ডিসেম্বরের মধ্যে দেশে ফেরৎ যাবার বিষয়ে তিনি প্রত্যয় বা দৃঢ়তার সাথে আমাকে বলেছিলেন। উল্লেখ্য যে, চার খলিফা কথোপকথনের সময় সার্বক্ষণিক নীরব ছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটা সাধারণ হাফ শার্ট পরা ছিলেন। আমাকে সব শেষে দিল্লীতে গিয়ে জনমত গঠনে সহায়তার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন। তারপর দিল্লী গেলাম। সেই দিল্লীর স্মৃতি পরে বর্ণনা নিয়ে আবার হাজির হবো। ভেতরে কম্পাউন্ডে ঘোরার সময় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জনাব এম.এ.জে ওসমানীকে দূর থেকে দেখি। মুক্তিযুদ্ধে ১৩টি সেক্টরে যুদ্ধ করতে গিয়ে ত্রিশ লক্ষ লোক শহীদ হয়েছে, দু’লক্ষ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছে, প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, রাস্তা ঘাট পুল কালভার্ট প্রায় ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে, স্কুল কলেজ বিল্ডিং ধ্বংস করেছে। চট্টগ্রাম পোর্ট ধ্বংস করেছে। আমরা স্বাধীন হলাম ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর অসাধারণ কূটনৈতিক তৎপরতা ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সহযোগিতায় এবং জাতিসংঘে রাশিয়ার ভেটো, আমেরিকার সপ্তম নৌবহরের বিপরীতে রাশিয়ার নৌবহরের আগমনে সপ্তম নৌবহরের পিছে হটা ইত্যাদি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তিরানব্বই হাজার পাকি সৈন্য আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে ইতি ঘটে। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ চিরজীবী হউক।

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা
চবি- পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান