মানুষের স্বপ্ন ও সাধনাকে সেলুলয়েডে বন্দি করে ভালো চলচ্চিত্র

12

সুপ্রতিম বড়ুয়া

চলচ্চিত্র একটি অমিত শক্তিশালী গণমাধ্যম। চলচ্চিত্র মানুষকে আনন্দ দেয়, ইতিহাস-ঐতিহ্য, আশা-আকাক্সক্ষা তুলে ধরে মানুষকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করে। একটি ভালো চলচ্চিত্র মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটায়। মাটি ও মানুষের কথা বলে এবং মানুষের স্বপ্ন ও সাধনাকে সেলুলয়েডে বন্দি করে পর্দায় ফুটিয়ে তোলে। বিনোদনের পাশাপাশি চলচ্চিত্র একটি সমাজের দর্পণ স্বরুপ। একটি দেশের সংস্কৃতি, নাগরিকদের আচার, ব্যবহার, পছন্দ, রুচি, অভ্যাস জানা যায় চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, চলচ্চিত্র কালের সাক্ষীও বটে। চলচ্চিত্র বিভিন্ন সময় সামাজিক, রাজনৈতিক অসঙ্গতি, শোষন-নীপিড়ন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সমালোচনা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ভূমিকা রেখে এসেছে। যেমনঃ কিংবদন্তি জহির রায়হানের “জীবন থেকে নেয়া” চলচ্চিত্রে রূপকের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে তৎকালীন স্বৈরশাসনের তীব্র সমালোচনা। ২০০২ সালে তারেক মাসুদ “মাটির ময়না” ছবিটি নির্মাণের মাধ্যমে সা¤প্রদায়িকতার সমালোচনা তুলে ধরেছেন এবং দীর্ঘদিন টিকে থাকা সামাজিক সমস্যার বিরুদ্ধে যুক্তির সাথে বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে দর্শকদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে চেষ্টা করেছেন। এছাড়াও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে গ্রামীণ বাংলার সহজ সরল জীবনধারার চিত্রও উঠে আসে যা মনকে পুলকিত করে। আমরা পর্দায় দেখেছি জীবিকার সন্ধানে বিদেশে পাড়ি দেওয়া শ্রমিক ও তাদের পরিবারের করুণ কাহিনী নিয়ে নির্মিত তৌকীর আহমেদের পরিচালনায় চলচ্চিত্র ‘অজ্ঞাতনামা’। ঔপন্যাসিক ড. আজাদ বুলবুল এর কাহিনি অবলম্বনে অভিনেতা তৌকির আহমেদের পরিচালনায় নির্মিত হালদাপাড়ের জেলে স¤প্রদায়ের সংকট এবং হালদার ক্রমাগত দূষণ এবং একটি প্রেমের গল্প, জীবনের গল্প নিয়ে ‘হালদা’ চলচ্চিত্র। দেখেছি অস্কারে মনোনিত ফারুকীর ‘ডুব’ চলচ্চিত্রটি। বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে প্রতিযোগিতার জন্য অস্কারের ৯১তম নির্বাচিত হয়েছে ‘ডুব’ চলচ্চিত্রটি। আরও দেখেছি কথাসাহিত্যিক সাংবাদিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী রচিত ‘চট্টগ্রাম এর গণহত্যা’ এবং স্বৈরাচারবিরোধী লড়াই -সংগ্রামের কাহিনি অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকার বাংলাদেশ সিনেমা অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের শিক্ষক পংকজ পালিত নির্মিত ‘একটি না বলা গল্প’ চলচ্চিত্র। অর্থাৎ এককথায় বলতে হয় কিছু ভালো মানের চলচ্চিত্র আমাদের দেখার সুযোগ হয়েছে এবং চলচ্চিত্রগুলো দর্শকের হৃদয়স্পর্শ করেছেও। ইতিহাস দিকে তাকালে দেখা যায়, ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প, বাণিজ্য, ত্রাণ ও দূর্যোগ কল্যাণমন্ত্রী থাকা অবস্থায় প্রাদেশিক পরিষদে চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন গঠনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সেই সূত্রে ২০১২ সাল থেকে এই বিশেষ দিনটিকে সরকারিভাবে জাতীয় চলচ্চিত্র দিবস ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) এর প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। চলচ্চিত্র হতে পারে বিনোদনের সুষ্ঠু মাধ্যম, বহন করতে পারে জাতীয় পরিচয়, তৈরী করতে পারে মনস্তত্ব এবং জনপরিসরে পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হতে পারে। কিন্তু চলচ্চিত্রের গল্পে দেশীয় চিন্তা, দেশীয় সংস্কৃতি, ও মৌলিকত্ব না থাকলে এ সম্ভাবনা খুবই কম। আমাদের চলচ্চিত্রের সুন্দর অতীত থাকলেও গত দুই দশক ধরে চলচ্চিত্রে ভিন্নধারা পরিলক্ষিত হচ্ছে। পূর্বে আলোর মিছিল, হাঙ্গর নদী গ্রেনেড, ওরা ১১ জন, আগুনের পরশমণি ইত্যাদি সিনেমার মতো জীবনধর্মী সিনেমা নির্মিত হলেও বর্তমানে বাস্তবধর্মী সিনেমা নির্মাণের সংখ্যা খুবই কম। বাংলা চলচ্চিত্র আজ অনেকটাই ভিনদেশী সংস্কৃতির গ্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। জীবনবোধের চিত্র, নিজস্ব সংস্কৃতি, বাস্তবধর্মী প্রেক্ষাপট এসব কমই খুঁজে পাওয়া যায় স¤প্রতি নির্মিত সিনেমাগুলোতে। আজকাল নির্মিত সিনেমার অধিকাংশই বাবা, মা বা পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে বসে উপভোগ করার মতো নয়।
আধুনিকতার নামে যেন অশ্লীলতাই বেশী পরিলক্ষিত হয়। তাই আজকালের সিনেমাগুলোর অধিকাংশই ব্যবসায়িক সফলতা পাচ্ছে না কিংবা দর্শক প্রিয় হচ্ছে না বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের আঁতুড়ঘর ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফডিসি)’ এর উন্নয়নের দিকেও নজর দিতে হবে। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন আধুনিকায়ন করতে হবে। জাতীয়ভাবে সিনেপ্লেক্স নির্মাণের উদ্যোগ দ্রæত বাস্তবায়ন করতে হবে। বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের প্রশাসক ‘প্রযোজক সমিতি’ এর বিরাট ভূমিকা রাখতে হবে। চলচ্চিত্র শিল্পকে বিশ্বের সাথে সমান তালে এগিয়ে নিয়ে যেতে দুই /একটা বা টুকটাক ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেই হবে না, বছরজুড়ে ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে। সিনেমার গল্পে মৌলিকত্ব আনতে হবে। সেই গল্পের মাধ্যমে নিজের দেশ, নিজের মাটি, নিজের মানুষকে তুলে ধরার চেষ্টা করতে হবে। তবেই মানুষ প্রাণভরে সিনেমা উপভোগ করতে পারবে।

লেখক : কলেজ শিক্ষক, শিশুসাহিত্যিক