মহাবিশ্বের মহানবী (দ.)’র উত্তম আদর্শ

16

 

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষকে হিদায়তের জন্য শত শত নবী-রাসুল (দঃ) এই পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ প্রেরিত হয়েছে বিশেষ সম্প্রদায়কে হিদায়তের জন্য। কেউ কেউ এসেছে কোন এক বিশেষ অঞ্চল কিংবা জনপদের মানুষকে আলোর পথ দেখাতে। প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (দঃ) অন্যান্য নবী রসুলগণের মতো কোনো নির্দিষ্ট কওম, অঞ্চল কিংবা নির্দিষ্ট জনপদের মানুষের হিদায়তের জন্য পৃথিবীতে তশরীফ আনেন নি, তিনি এসেছেন, সমগ্র মানব জাতির জন্য, মহাবিশ্বের জন্য। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক তাঁকে উদ্দেশ্য করে ইরশাদ করেন, “আপনি বলুন, হে মানব জাতি, আমি তোমাদের সকলের জন্য রাসুলুল্লাহ।” পবিত্র কোরআনে অন্যত্র ইরশাদ আছে, “কত মহান তিনি (আল্লাহ) যিনি তাঁর বান্দার প্রতি ফুরকান (কোরআনের আরেক নাম) নাযিল করেছেন যাতে তিনি (হযরত মুহম্মদ) (দঃ) বিশ্বজগতের জন্য সতর্ককারী হতে পারেন। (সূরা ফুরকান : আয়াত-১) মহানবী হযরত মুহম্মদ (দঃ) শুভ আগমন করেছেন মানব জাতিকে সিরাতুল মোস্তাকিমে পরিচালিত করতে। আল্লাহর মনোনীত দ্বীন ইসলামকে পরিপূর্ণ করতে। আল্লাহ জাল্লাশানুহু ইরশাদ করেন, “আজ তোমাদের জন্য। তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম, আমার নিয়ামতরাজি তোমাদের প্রতি সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের ধর্ম হিসেবে অনুমোদন দান করলাম।” (সূরা মায়দা : আয়াত-৩) আল্লাহ তা’লা সমগ্র মানব জাতিকে পথ প্রদর্শন করতে প্রিয়নবী (দঃ) কে প্রেরণ করেন। তাঁকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে বর্ণনা করেছেন, “আমি তো আপনাকে প্রেরণ করেছি সমগ্র মানব জাতির জন্য সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারী রূপে” (সূরা সাবাঃ আয়াত-২৮) প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (দঃ) মানবতার সকল গুণের অধিকারী আল্লাহর রাসুল। তাঁর আদর্শ মনে প্রাণে গ্রহণ করে বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটিয়ে এবং যথার্থভাবে অনুসরণ ও অনুকরণের মধ্য দিয়েই কেবল সত্যিকার মানুষ ও মুমিন বান্দা হওয়া সম্ভব। আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন, “তােমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে রয়েছে সুন্দরতম আদর্শ উসওয়াতুন হাসানা।” (সূরা : আহযাব : আয়াত : ২১)। মহানবী (দঃ) আদর্শিক জীবন যাপন করতে। পার্থিক আরাম আয়েশ পছন্দ করতেন না। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বলেন, আমি একদিন দেখলাম যে, রাসুলুল্লাহ (দঃ) একটি খেজুরের পাতার তৈরী মাদুরের উপর শুনে আছেন। মাদুরের দাগ তাঁর শরীর মোবারকে লেগেছে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল (দঃ) যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি এর উপর কিছু বিছিয়ে দিতাম। তিনি বললেন, পার্থিব আয়েশ দিয়ে কি করবো, একজন মুসাফির বৃক্ষ ছায়ায় ক্ষণিক বিশ্রাম নেয় এবং চলে যায়, পৃথিবীর সাথে আমার সম্পর্ক তো তেমনটাই।
পবিত্র ইসলাম শান্তির ধর্ম। অশান্তি, অত্যাচার, হিংস্রতার বিরুদ্ধে ইসলামের আবির্ভাব। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে আল্লাহ পাক মুসলমান স¤প্রদায়কে উদ্দেশ্য করে ঘােষণা করেছেন, “যারা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এগিয়ে আসে তোমরা তাদের সাথে আল্লাহর পথে যুদ্ধ চালিয়ে যাও। কিন্তু সাবধান! সীমা লঙ্ঘন করো না, কারণ আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করে না। (সূরা বাকারা, আয়াত ১৯০)। প্রিয় নবী ছরকারে দো-আলম হযরত মুহম্মদ (দঃ) শান্তি ও সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে মদীনায় অবস্থানকারী বনু কুরাইজা, বনু নাজির ও বনু কাইনুকা গোত্রের ইহুদী ও পৌত্তলিক প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করে একটি চুক্তি সম্পাদন করেন। ইসলামের ইতিহাসে এই চুক্তি ‘মদিনার সনদ‘ নামে পরিচিত। এই চুক্তির মাধ্যমেই প্রথম ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা হয় । সমান অধিকার নিয়ে ইহুদী, খ্রিস্টান, পৌত্তলিক ও মুসলমান ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি সাধারণ জাতি গঠনই ছিল মদিনার সনদের মূলমন্ত্র। সকল ধর্মের অনুসারীগণ নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। কেউ কারো উপর হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। বহিঃশত্রু কর্তৃক কোন স¤প্রদায় আক্রান্ত হলে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করবে। জগতের রহমত মাহবুবে খোদা হযরত মুহম্মদ (দঃ)-এর রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, সামাজিক ও অসা¤প্রদায়িক দূরদর্শিতায় মুগ্ধ হয়ে ঐতিহাসিক উইলিয়াম মুর বলেছেন, মদিনার সনদ মুহম্মদ (দঃ)-এর অসাধারণ মহত্ত¡ ও মননশীলতা শুধু তৎকালীন যুগেই নয় বরং সর্বকালের মানুষের জন্যে শ্রেষ্ঠত্বের পরিচায়ক।” প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (দঃ) অমুসলিমদের উপর আক্রমণ করতে কখনো নির্দেশ দেননি বরং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা তিনি নিজেই করে গেছেন। ৬ষ্ঠ হিজরীতে সিনাই পর্বতের নিকট সেন্ট ক্যাপারিন গির্জার শর্ত ছিল (১) কোন খ্রিস্টানকে ধর্ম ত্যাগে বাধ্য করা হবে না (২) কোন ধর্ম যাজককে তার উপসনালয় থেকে বিতাড়ন করা হবে না (৩) খ্রিস্টানদের ওপর অন্যায় ট্যাক্স চাপিয়ে দেওয়া হবে না (৪) মসজিদ নির্মাণ করতে কোন খ্রিস্টান চার্চ ধ্বংস করা যাবে না বরং মুসলমানগণ প্রয়োজনে সাহায্য প্রদান করবে।
সততা, ভদ্রতা, নম্রতা ও উত্তম চরিত্র নিয়ে মাহবুবে খোদা, তাজেদারে মদিনা, ছরকারে দো আলম হযরত মুহম্মদ (দঃ) পৃথিবীতে শুভ আগমন করেন। এ জন্যই মহান আল্লাহ রাব্বল আলামীন সূরা হাসরের ৭ নং আয়াতে ইরশাদ করেন, রাসুল (দঃ) তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তা গ্রহণ কর আর তিনি যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাক।” এই আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, মানব জীবনের চারিত্রিক এমন কোন দিক নেই যার সম্পর্কে নবী করীম (দঃ)-এর পক্ষ থেকে কোন দিকনির্দেশনা নেই। রাসুল (দঃ)-এর বিখ্যাত সাহাবীদের বর্ণনা অনুসারে নবী করীম (দঃ) ম্র স্বভাবের, সুন্দর চরিত্রের, সৎলােক ছিলেন। তাঁর চেহারা মুবারক সদা হাস্যোজ্জ্বল থাকত, গুরুগম্ভীর স্বরে কথা বলতেন,কারো মনোকষ্টদায়ক কোন কথা বলতেন না। মানুষের সাথে সাক্ষাতে সালাম ও মুসাফাহ্ করতেন। (আবু দাউদ, তিরমিযী) একবার বাদশাহ নাযাশীর নিকট থেকে একজন দূত আসল। নবী করীম (দঃ) সাহাবীদের পরিবর্তে তিনি নিজে দূতের সেবা করলেন এবং বললেন, এরা আমার বন্ধুদের সেবা করেছে,সুতারাং আমি নিজে এদের সেবা করতে চাই।
একবার মদীনায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। আবাদ ইবনে শুরাহবিল ক্ষুধার তাড়নায় এক বাগানে ঢুকে কিছু খেজুর খেয়ে সেলেন, বাগানের মালিক তাকে ধরে নিয়ে হুজুর (দঃ)-এর দরবারে হাজির করলেন এবং তার গায়ের চাদরখানা খুলে নিয়ে গেলেন। হুজুর ঘটনা শুনে বললেন, লোকটি মূর্খ, আইন কানুন জানে না, তাকে প্রথমে এ সম্পর্কে অবগত করানো উচিৎ ছিল। সে ক্ষুধার্ত ছিল তাকে কিছু খাবার দেয়া দরকার ছিল, এই বলে তিনি মালিককে তাঁর চাদর ফেরত দিতে বললেন এবং বেশকিছু খেজুর দিয়ে তাকে বিদায় করলেন (আবু দাউদ)।
একবার এক ব্যক্তি নবী করীম (দঃ)-এর সাক্ষাতপ্রার্থী হন। হযরত আয়েশা (রঃ) বললেন, লোকটি ভাল নয় তারপরও তার সাথে তিনি ভাল ব্যবহার করলেন। নবী করীম (দঃ) বললেন, আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তি অধিক ঘৃণ্য যার দুর্ব্যবহারের কারণে লোকজন তার সাথে সাক্ষাত ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। (বুখারী ও আবু দাউদ) একদিন নবী করীম (দঃ)-এর দুধপিতা আসলে তাঁকে চাদরের কিছু অংশ বিছিয়ে বসতে দিলেন। কিছুক্ষণ পর দুধমাতা আসলে তার জন্য বাকি অংশটুকু বিছিয়ে দিলেন। এরপর তাঁর দুধভাই আসলে তিনি দাঁড়িয়ে উঠে তাঁকে সামনে এনে বসালেন (আবু দাউদ)। নবী করীম (দঃ)-এর নিকট কারো কাজকর্ম অপছন্দের হলে সে ব্যক্তিকে তা সরাসরি না বলে পরােক্ষভাবে বলতেন যাতে ঐ ব্যক্তি মনে কষ্ট না পায়। এ ধরনের হাজারো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সমাহার ছিল নবী করীম (দঃ)-এর জীবন।

লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক