ভোগান্তির শঙ্কা ঈদযাত্রায়

19

তুষার দেব

সিয়াম সাধনার মাস রমজান শেষ হওয়ার সাথে সাথে ঘনিয়ে আসছে পবিত্র ঈদুল ফিতর। আর ঈদকে ঘিরে বাড়ি ফিরতে উন্মুখ পরিবার-পরিজন ছেড়ে শহরে আসা সাধারণ মানুষেরা। আর এই উন্মুখতায় নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে আসছে নির্বিঘেœ ঘরমুখো মানুষের চাপ সামাল দেয়া। এ বছর ঈদুল ফিতরে বিগত দু’বছরের তুলনায় বেশি মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়ি যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নাড়ির টানে বাড়ি ফিরতে উদগ্রীব মানুষদের পরিবহনের জন্য প্রহর গুণছে শতাধিক ফিটনেসহীন বাস। ঘরমুখো মানুষের বাড়তি চাহিদা সামাল দিতে শেষ মুহূর্তে এসব বাস সড়কে নামানোর পরিকল্পনা রয়েছে বাস মালিকদের। ঈদকে সামনে রেখে ‘জীবনকাল’ পেরিয়ে যাওয়া ইঞ্জিনসমৃদ্ধ পুরনো বাসের বডি পরিবর্তন করে নজরকাড়া নানা রংয়ের প্রলেপ দিয়ে এসব বাস পুনরায় যাত্রী পরিবহনের উপযোগী করা হলেও এগুলোর একটিরও ফিটনেস সনদ নেই।
এদিকে, ফিটনেসহীন ও ত্রæটিপূর্ণ যানবাহন ঈদে ঘরমুখো মানুষের বিড়ম্বনার পাশাপাশি দুর্ঘটনার ঝুঁকিও অনেকাংশে বাড়িয়ে দেবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন পরিবহন-সংশ্লিষ্টরা। ফিটনেসহীন এসব বাস যাত্রাপথে বিকল হয়ে অপ্রত্যাশিত যানজট সৃষ্টিরও অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাছাড়া ফিটনেসহীন বাসগুলোই সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে রয়েছে বলেও তারা মনে করছেন। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন ঈদে ঘরমুখো যাত্রীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীর শাহ আমানত সেতু সংযোগ সড়ক ও পোর্ট কানেক্টিং রোড ছাড়াও শহরতলীর বড় দীঘির পাড়, কালুরঘাট এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুন্ড অংশে থাকা গ্যারেজগুলোতে পুরনো বাসগুলোর জীবনকাল পেরিয়ে যাওয়া ইঞ্জিন মেরামত করে বডিতে নতুন রংয়ের প্রলেপ দেয়ার কাজ চলছে জোরেশোরে। এসব এলাকায় থাকা গাড়ির গ্যারেজগুলোর কর্মীদের এখন চোখে ঘুম নেই। দিনরাত খেটে ঈদের ছুটি শুরু হওয়ার অন্ততপক্ষে তিনদিন আগেই এসব বাসের মেরামত কাজ সম্পন্ন করতে তাদের প্রাণান্তর চেষ্টা চলছে। তারপর বাসগুলো যাত্রী-পরিবহনের জন্য সড়ক-মহাসড়কে নামানো হবে।পরিবহন ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত সূত্রগুলো জানায়, চট্টগ্রাম থেকে সড়কপথে ৪৯ রুটে যাত্রী পরিবহণের জন্য সহস্রাধিক বাস থাকলেও ঈদের মৌসুমে গণপরিবহনের বাড়তি চাহিদাকে পুঁজি করে শেষ মুহূর্তে জোড়াতালি দিয়ে চলাচলের উপযোগী করা ফিটনেসহীন কিছু বাস সড়ক-মহাসড়কে যাত্রী পরিবহনের কাজে নামায় কতিপয় বাস মালিক। পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নেতা এবং বিআরটিএ-এর অসাধু কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করেই ফিটনেসহীন বাসগুলো দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে যাত্রী পরিবহন করে থাকে। চট্টগ্রাম থেকে তিনটি প্রধান সড়ক-মহাসড়কের অন্ততঃ ৪৯ টি রুটে যানবাহনে যাত্রী পরিবহন করা হয়ে থাকে। নগরীর অক্সিজেন অস্থায়ী বাস টার্মিনাল থেকে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, হাটহাজারী, নাজিরহাট, ফটিকছড়ি, হেয়াকোঁসহ উত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের যানবাহনগুলো পরিচালিত হয়। একইভাবে কর্ণফুলী তৃতীয় সেতু (শাহ আমানত সেতু) সংলগ্ন অস্থায়ী বাস টার্মিনাল এবং বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা সদর, কক্সবাজার, কাপ্তাই, পার্বত্য জেলা বান্দরবানসহ ২৩টি রুটের যানবাহন পরিচালিত হয়। এছাড়া, নগরীর কদমতলী ও শুভপুর বাস টার্মিনাল থেকে ফেনী, ছাগলনাইয়া, নোয়াখালী, কানকিরহাট, শুভপুর, কুমিল্লাসহ ঢাকামুখী যানবাহনগুলো পরিচালিত হয়। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার, ঢাকা-চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম-রাঙামাটি ও চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়ক পথেই এসব যানবাহনে যাত্রী পরিবহন করা হয়ে থাকে।
তিনটি টার্মিনাল থেকে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি ছোট-বড় বাসে যাত্রী পরিবহণ করা হয়ে থাকে। ঈদে বাড়তি চাহিদার কারণে নির্ধারিত এসব যানবাহন দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায় না। এর বাইরে এস আলম, শ্যামলী, সৌদিয়া, শাহ আমিন, বিআরটিসি’র মত সরকারি-বেসরকারি সংস্থার বাসেও যাত্রী পরিবহন করা হয়ে থাকে। এসব রুটে ঈদে অন্ততঃ পাঁচ হাজার যানবাহনের চাহিদা রয়েছে উল্লেখ করে পরিবহন সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, আন্তঃজেলার বিভিন্ন রুটে ছোট আকারের যানবাহন নিয়মিত বাড়লেও বাসসহ বড় আকারের যানবাহন সে তুলনায় বাড়ছে না। এ কারণে ঈদের মত বিশেষ উৎসবের প্রাক্কালে সৃষ্টি হয় সঙ্কট। আর সঙ্কট সামাল দিতে একপ্রকার বাধ্য হয়েই পুরনো ও লক্কর-ঝক্কর মার্কা বাসগুলো শেষ মুহূর্তে যাত্রী পরিবহনের জন্য সড়কে নামানো হয়ে থাকে।
জানতে চাইলে আন্তঃজেলা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মঞ্জুরুল আলম মঞ্জু পূর্বদেশকে বলেন, ঈদে ঘরমুখো যাত্রীর অত্যধিক চাপ থাকে। চাহিদার তুলনায় গণপরিবহনের সঙ্কট থাকায় তুলনামূলক পুরনো যানবাহনও মেরামত করে সড়কে নামানো হয়। তবে এ ধরণের বাসগুলোর ক্ষেত্রে যাত্রী পরিবহনে (ট্রিপে) সময় একটু বেশি লাগলেও দুর্ঘটনার নজির তেমন বেশি নেই। সাধারণত দক্ষ চালকদের মাধ্যমেই এগুলো পরিচালনা করা হয়ে থাকে।
আঞ্চলিক সড়ক পরিবহন মালিক গ্রæপের সভাপতি মো. মুছা পূর্বদেশকে বলেন, সড়ক-মহাসড়কে নানা সমস্যার স্থলপথে যাত্রীর পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে কমে যাচ্ছে। ঝক্কি-ঝামেলা মোকাবেলা করার চেয়ে মানুষ আনন্দদায়ক ভ্রমণেই বেশি আগ্রহী। কিন্তু আমাদের গণপরিবহন খাতে পর্যাপ্ত যানবাহনের সঙ্কট রয়েছে। মানুষ যে করেই হোক বাড়ি যেতে চায়। তাই কিছু সংখ্যক বাস পুনরায় চলাচল উপযোগী করে তৈরির পর শেষ মুহূর্তে ফিটনেস সনদ সংগ্রহের সুযোগ থাকে না। তার মানে এই নয় যে, এগুলো যাত্রী পরিবহনে অক্ষম কিংবা চলাচলের উপযোগী নয়।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া পূর্বদেশকে বলেন, রাস্তাঘাটে কিংবা টার্মিনালে যাত্রীরা তো আর ফিটনেস সনদ দেখে গাড়িতে চড়েন না। যারা এসব দেখার দায়িত্বে রয়েছেন, মানে হাইওয়ে পুলিশ কিংবা বিআরটিএসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা- তারা কার্যত জেগে ঘুমায়। অতএব সড়কে যা ঘটার তাই ঘটে। যাত্রীদের প্রাণ সপে দিয়ে চলাফেরা করাই এখন নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।