বিশ্ব মা দিবস এবং আমাদের মা

12

 

গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে একসময় সুঁই ও রঙিন সুতোর নিবিড় বুননে সাদা কাপড়ের উপর লেখা ও আয়না বাঁধানো কিছু শ্লোক বা গাঁথা শোভা পেতো। এখনো কোনো কোনো ঘরে ঝুলে ভরা এ শ্লোকগুলো লক্ষ করা যায়। বৈঠকখানা বা মেহমানদের বসার ঘরে সাধারণত এগুলো রাখা হতো। তার মধ্যে খুব জনপ্রিয় অথচ হৃদয় নাড়ানো একটি শ্লোক ছিল-
‘মা নেই গৃহে যার
সংসার অরণ্য তার
দেখিলে মায়ের মুখ
দূরে যায় সব দুঃখ।’
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি বিখ্যাত কবিতায় তিনি দীপ্ত কন্ঠে উচ্চারণ করেছেন,
‘বিশ্বে যা কিছু সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’
এ পংক্তিমালার মধ্যে দিয়ে তিনি নারীর অবদানকে পুরুষের সমান মর্যাদায় আসীন করেছেন। কিন্তু সে নারী যদি একজন মা হন তখন তাঁর মহিমা ঐ পর্যায়ে আর থাকে না। তিনি হয়ে উঠেন অপ্রতিরোধ্য শক্তি-অপ্রতিদ্বন্দ্বী, যা শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। একজন মা একটি পরিবারের অপরিহার্য খুঁটি। যাঁর অবর্তমানে একটি পরিবারে যে কোন সময় ধস নামতে পারে। নেমে আসতে পারে গভীর অন্ধকার। দেখা দিতে পারে চরম অনিয়ম ও অচল অবস্থা।
একটি সংসারে একজন মা এমনই এক শক্তি যার কোন বিকল্প নেই। একটি শিশুর কাছে মা-ই তার প্রথম ও একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়স্থল। পরিবারের সকল সদস্য একে অপরের বৈরী হতে পারে । কিন্তু মায়ের কাছে সব সন্তানই সমান। সমান মমতায় সব সন্তানকে তিনি আঁচলে ধরে রাখেন। এতে তাঁর কোনো পাওয়ার প্রত্যাশা নেই। লাভ-ক্ষতির হিসাব নেই। ফুল যেমন আপনার জন্য ফোটে না,একজন মাও তেমনি তাঁর নিজের জন্য কিছুই অবশিষ্ট রাখেন না। সবকিছুই বিলিয়ে দেন অসংকোচে-সন্তানের জন্য, সংসারের জন্য সর্বোপরি সামগ্রিক পরিবারের জন্য।
সন্তানের জন্য মায়ের অপরিসীম ত্যাগের স্বীকৃতি দিয়ে শান্তির ধর্ম ইসলামে মাকে সুমহান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহানবী (স.) বলেছেন, “আল জান্নাতু তাহতা আকদামিল উম্মাহাতি।” অর্থাৎ মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশ্ত। অন্যান্য ধর্মেও মায়ের প্রতি পরম শ্রদ্ধ দেখানো, তাঁর প্রতি সর্বাত্মক আনুগত্যের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাই মা-মানেই সকল সন্তানের কাছে পরম শ্রদ্ধার পাত্র।
সন্তান জন্ম, লালনপালন থেকে শুরু করে একটি পরিবারকে একই আঁচলে ধরে রাখতে গিয়ে একজন মায়ের যে নিরন্তর সাধনা ও ত্যাগ তার স্বীকৃতি স্বরূপ বিশ্বজুড়ে মা দিবস পালিত হয়। তবে একইদিনে নয় নানা দিনে। তবে পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশে মা দিবস পালিত হয় মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশ এদিন মাকে মমতাভরে ডাকবে, স্মরণ করবে, কাঁদবে, হাসবে। মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার মা দিবস পালিত হয় যুক্তরাষ্ট্র, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, তুরস্ক, অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, ব্রæনাই, কানাডা, চিলি, কিউবা, ক্রোয়েশিয়া, মায়ানমার, পেরু, শ্রীলংকা, সুইজারল্যান্ড, উরুগুয়ে, জিম্বাবুয়ে, বার্বাডোজ ও বেলিজ। মে মাসের ৮ তারিখ দিবসটি পালন করে আলবেনিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া। এছাড়া মে মাসরে ২৫ তারিখ প্যারাগুয়ে, ২৬ তারিখ পোল্যান্ড, ২৭ তারিখ বলিভিয়া, ৩০ তারিখ নিকারাগুয়া বিশ্ব মা দিবস পালন করে। মুসলিম বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ মা দিবস পালন করে ২১ মার্চ তারিখে। আজকের এই যে মা দিবস পালন তা কিন্তু একদিনে হয়ে উঠে নি। তার জন্য গুনতে হয়েছে বহু ক্ষণ। অপেক্ষা করতে হয়েছে বহুকাল।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে নারী শিশুকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো। ইসলামের ইতিহাসের এই যুগকে “আইয়ামে জাহেলিয়াত” বা অন্ধকার যুগ বলা হয়। এখনও পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে নারীকে খুব একটা ভাল চোখে দেখা হয় না। আজকের শিশু কন্যাই যে আগামীদিনের মা তা সভ্য সমাজ কখনো কখনো ভুলে যায়। মা যে অসীম নির্ভরতার প্রতীক, ভালবাসার অপর নাম যে মা, তা সমাজে প্রতিষ্ঠিত বা স্বীকৃতি আদায়ের ক্ষেত্রে একজন নারীকে পথিকৃৎ হিসেবে ধরা হয়। তিনি হলেন, অ্যানামেরি জারভিস। আমেরিকান এ নাগরিকের মায়ের চিন্তা ভাবনা ছিল মায়েদের সম্মানে কিছু একটা করার। ১৯০৫ সালে তিনি মারা গেলে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা জারভিস শুরু করেন সমাজে মায়ের অবদান তুলে ধরার নিরন্তর প্রয়াস। তিনি সিদ্ধান্ত নেন বিশ্বের মায়েদের জন্য এমন কিছু করবেন, যেন তা তাঁদের সম্মান বৃদ্ধি করবে, এ লক্ষ্যে তিনি ১৯০৭ সালে প্রচারণা চালানো আরম্ভ করেন। দীর্ঘ ৪ বছর ধরে জারভিসের নিরলস শ্রমে ১৯১১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সকল রাজ্যে মায়ের সম্মানে মা দিবস পালন শুরু হয়।
পৃথিবীতে নিবেদিত প্রাণ কোনো মানুষের কর্মকান্ড কখনো বিপল হয়নি। যেমনটি হয়নি জারভিসের। তিনি তাঁর মায়ের স্বপ্ন পূরণে এত বেশি দৃঢ়চেতা ছিলেন যে মাত্র নয় বছরের প্রচারণায় আদায় করে নিয়েছেন মায়ের জন্য একটা আলাদা দিবস মা দিবস। ১৯১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন, এখন থেকে মে মাসের দ্বিতীয় রোববার সারা আমেরিকায় পালিত হবে মা দিবস। তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশেও বিভিন্ন পরিবার ও সামাজিক সংগঠন মা দিবস পালন করে বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালবাসায়।
কিন্তু বড় দুঃখের বিষয় যে মা দশ মাস দশ দিন সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেছেন, নিজের রক্ত থেকে সন্তানের পুষ্টি যুগিয়েছেন আর ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সকল বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করতে বুকে আঁকড়ে রেখেছেন। একটুখানি অসুস্থ হলে উতলা মনে বিনিদ্র রজনী পার করেছেন। সুস্থ না হওয়া অবধি সন্তানের কাছ থেকে এক ইঞ্চি দূরেও যাননি, এমন অকৃত্রিম মায়ার আধার জননী সন্তান বড় হলে হয়ে যায় সন্তানের কাছে বোঝার মতো। সভ্যতার অগ্রগতি, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সুবাদে সব কিছু হাতের মুঠোয় পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হলেও মানবতার পারদ যেন ক্রমশ নিম্নমুখী হয়ে পড়েছে। ফলে বৃদ্ধ বয়সে বেশিরভাগ মা-বাবা সীমাহীন দুর্ভোগ আর অযত্ন অবহেলার মধ্যে দিনাতিপাত করছে। কোনো কোনো ধনাঢ্য পরিবার মা-বাবাকে অবলীলায় পাঠিয়ে দিচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। এসব সন্তানরা একবারও ভাবছেন না আজ যে বা যারা বৃদ্ধ মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়ার জন্যে প্ররোচিত করছে তারাও কিন্তু একদিন বৃদ্ধ হবেন। আমি, আপনি, সবাই একদিন বুড়ো হবো। আমাদের সবার শরীরের শক্তি ক্রমশ হ্রাস পাবে। সেদিন আমাদেরও একৃই অবস্থা হবে। টিট ফর টেট কিংবা প্রকৃতির প্রতিশোধ বলতে একটা কথা আছে। সেই প্রকৃতির প্রতিশোধ থেকে কেউ রক্ষা পাবে না। সুতরাং কারও কথায় প্ররোচিত না হয়ে কিংবা কাউকে খুশি করতে নিজের রক্তকে সীমাহীন দুর্ভোগের মুখে ছেড়ে দিবেন না। বুড়ো বয়সে যে কোনো মানুষের প্রিয়জনের সান্নিধ্যে বড় বেশি প্রয়োজন। ওষুধ-পত্রের চেয়ে নিজের রক্তের একটুখানি ছোঁয়া অনেক সময় অনাবিল প্রশান্তির যোগান দিতে পারে। তাই আসুন, আমরা নিজ নিজ মাকে প্রাণভরে ভালবাসি। সাধ্যমতো সকল কাজে তাঁকে সহায়তা করি এবং সবাই প্রাণ খুলে গাই ‘ মায়ের একধার দুধের দাম, কাটিয়া গায়ের চাম, পাপোষ বানাইলে ঋণের শোধ হবে না,এমন দরদী ভবে কেউ হবে না, আমার মা.আ গো…….’।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক