বিলুপ্তির পথে পারিবারিক বন্ধন মূল্যবোধ চর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে

39

 

পারিবারিক বন্ধন আমাদের দেশের একটি গৌরবময় ঐতিহ্য। বহির্বিশ্বের পারিবারিক ব্যবস্থা আমাদের মতো শক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। বিশেষ করে আমেরিকা-ইউরোপের পারিবারিক ব্যবস্থা স্নেহ-মায়া-মমতার আশ্রয়ে সংহত দেখা যায় না। এদেশের সমাজে মা-বাবা-ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে যৌথভাবে বসবাস করার রীতি ছিল। বর্তমানে সে একান্নবর্তি পরিবার বিলুপ্তির প্রহর গুনছে। বাবা-মা, ছেলে-ছেলের বউ বর্তমানে একসাথে বসবাস করছে না। দেশের অধিকাংশ মানুষ অস্তিত্ববাদী চিন্তায় বিভোর। ছেলে, মা-বাবার বৃদ্ধবয়সের অসহায় অবস্থা চিন্তা করতে ভুলে যাচ্ছে। ছেলের বউ শ্বশুর-শাশুড়িকে সহ্য করতে চাচ্ছে না। ভাই সম্পত্তির লোভে বোনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করছে। মায়ের সম্পত্তি সংক্রান্ত বিষয়কে কেন্দ্র করে নানাবাড়ির সাথে ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে সম্পর্ক। অত্মীয়তার বন্ধন ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে যাচ্ছে স্বার্থপরতার কারণে। নিজে বাঁচলে বাপের নাম এমন এক বিকৃত বোধে দেশের অধিকাংশ নর-নারী পারিবারিক, সামাজিক এবং আত্মীয়তার বন্ধন এবং স্নেহ মায়া মমতার জগৎ হতে দূরে সরে যাচ্ছে। ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’ এমন মূল্যবোধ হতে আমাদের পারিবারিক-সামাজিক অবস্থা অনেক দূরে অবস্থান করছে। আত্মীয়তায় স্বার্থপরতা, প্রেম-ভালোবাসায় স্বার্থপরতা, সামাজিক বন্ধনে স্বার্থ ও রাজনৈতিক হীনচিন্তা প্রবল রূপ ধারণ করেছে আমাদের মাঝে। ব্যক্তিস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ, রাজনৈতিকস্বার্থ ধ্বংস করে দিচ্ছে শ্রেয় মূল্যবোধ। সত্য-সুন্দর নীতি, সমাজে পরিবারে খুব একটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তার কারণ সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয়। স্বার্থপরতা রাজনৈতিক চিন্তা, অপরাধ প্রবণতা, বিকৃতরুচি, দুর্নীতি, মিথ্যাচার ইত্যাদি বেড়ে গেছে পরিবারে, সমাজে এবং দেশের প্রেক্ষাপটে। এর পেছনে ধর্মীয় শিক্ষা তথা নৈতিক শিক্ষার অভাব অধিকাংশে দায়ি। এদেশে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠী বসবাস করে। প্রাশ্চাত্য তথা ইউরোপীয় প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়েছে আমাদের সামাজিক অবস্থা, শিক্ষা, সংস্কৃতি। ধর্মীয় এবং দেশিয় ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ হতে বিচ্ছ্যুত হয়ে আমরা একপ্রকার ধর্মহীনতা, অস্তিত্ববাদিতা, ফ্রয়োডিয় মনো বিকলন এবং ব্যক্তিস্বার্থের অনৈতিক লিপ্সায় মগ্ন হয়ে পড়েছি। যার কারণে মুসলিমরা ইসলাম ধর্মের নৈতিক ও নিয়মতান্ত্রিক জীবন হতে ছিটকে পড়ছে। আবার হিন্দুরাও তাদের ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার ধারে কাছে যাচ্ছে না। একইভাবে সবধর্মের লোকের মধ্যে তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চার দেখা মেলা ভার। যার কারণে সমাজে নানারকম অরুচিকর কর্মকান্ড, নিজের স্বার্থের জন্য অন্যের স্বার্থে আঘাতের প্রবণতা, অপরাধ প্রবণতা, সন্ত্রাস, হত্যা, মদ, জুয়া, ঘৃণ্য দালালিসহ মানবতা বিরোধী কর্মকান্ড বেড়েছে। পরিবারে, সমাজে সহমর্মিতা, সহযোগিতা, মানবিক ও নৈতিকতার চর্চা বন্ধ হয়ে পড়েছে। শিক্ষায় শুধু সার্টিফিকেট অর্জনের প্রতিযোগিতায় মগ্ন হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকরা মানবিকতা, নৈতিকতাকে তুলে ধরার সুযোগ পাচ্ছেনা, পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের পাস করানোতে শিক্ষকরা ব্যস্ত। যার কারণে উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেটধারীরা দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বার্থপরতা, অধর্ম, আত্মকেন্দ্রিকতায় শতভাগ নিমগ্ন।
একথা সত্য যে, দেশের সহশিক্ষা, নারীর অবাধ স্বাধীনতা, নারী অধিকার রক্ষাআইন, চাকরিতে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ এবং নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি প্রাশ্চাত্য মূল্যবোধ চর্চা পারিবারিক বন্ধন বিনষ্ঠের জন্য অধিকতর দায়ী। নিজ নিজ ধর্মীয় মূল্যবোধের বিপরীতে বেপর্দা ও নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা পরিবারিক পরিমÐকে অস্থির পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। নারীরা অধিক পরিমাণে স্বাধীন হতে গিয়ে পুরুষের ব্যক্তিত্ব ও কর্তৃত্বকে পায়ে দলিত মথিত করছে। ফলে পরিবারে নারী পুরুষের সম্পর্কের ভারসাম্য বিনষ্ট। বিনষ্টের হাত ধরে এদেশে নারীর সংসার ধর্ম অকল্পনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। দেশের নারীর অভিভাবক শ্রেণি এবং নারীর আত্মমর্যাদা কমে যাওয়ায় যৌতুক মহামারি আকার ধারণ করেছে। মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্তের কথা বাদদিলে নিম্নবৃত্ত সাধারণ পরিবারে বর্তমানে দুইলক্ষ, তিনলক্ষ, পাঁচলক্ষ টাকা নগদ দিয়ে বর কিনতে হচ্ছে। সমাজের দিকে নজর দিলেই আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট হয়ে যাবে। যৌতুক ব্যাপকভাবে বিশেষ করে বৃহত্তর চট্টগ্রামে যে রূপ লাভ করেছে তা থেকে কোন মেয়ের পিতা রেহাই পাচ্ছে না। প্রায়ই দেখা যায় যাদের জায়গাজমি কিংবা অর্থের সংস্থান নেই তারা মেয়ের বিয়েতে যৌতুক দেয়ার জন্য সমাজে চাঁদা তুলছে। ছেলেরা সহজে যৌতুকের টাকা পেতে পেতে বিয়ের পর শ্বশুর শাশুড়ির নিকট হতে নানা কৌশলে আরো টাকা দাবি করেছে। ৯০ শতাংশ মুসলিমের এই দেশে মুসলিম অভিভাবকরা হিন্দু অভিভাবকদের পর্যায়ে নেমে এসেছে। হিন্দু পারিবারিক আইনে যৌতুক স্বীকৃত। কেননা তারা বিয়ের পর পৈত্রিক সম্পত্তি পায় না। যে কারণে বিয়ের সময় যৌতুক দিয়ে মেয়ের বরকে সন্তুষ্ট করতে হয় হিন্দু অভিভাকদের। মুসলিম নারীরা সম্পত্তি পায়। মুসলিম নারীদেরকে মোহরানা দিতে হয়। মুসলিমরা নিজস্ব ধর্মীয় পারিবারিক আইন চর্চা হতে বিচ্যুত হওয়ার কারণে কষ্ট পাচ্ছে। বর্তমানে ছেলেপক্ষ শুধু বিয়ের একটা কাবিন দেয় মাত্র। একটাকা মোহরানা আদায় করতে দেখা যায় না অধিকাংশ বিবাহিত পুরুষকে। স্বামীর সাথে সমস্যা হলে নারীরা কাবিনটা সাথে নিয়ে কোর্টে দিকে দৌড়ে। এ সমাজে সাধারণ ও সার্টিফিকেটধারী নারী এবং পুরুষ তাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য থেকে দূরে সরে গিয়েছে। নারী তার মর্যাদা ও অধিকার বুঝে না, পুরুষও তার কর্তব্য, অধিকার এবং মর্যাদা ভুলে গেছে। উভয়ে প্রতিযোগিতায় সমান হতে গিয়ে , ভোগের উপর অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে বিধায় সংসার জীবনের ভারসাম্য ঠিক রাখতে পারছে না। সহযোগী এক প্রতিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায় চট্টগ্রাম শহরে প্রতিদিন গড়ে ১৫টি বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। এর পেছনে নারী এবং পুরুষ ঊভয়ের দোষ রয়েছে। শুধুমাত্র জৈবিক চাহিদার উপর ভিত্তি করে পারিবারিক সম্পর্ক টেকেনা। আত্মিক ভালোবাসার চর্চা জরুরি। ত্যাগের মানসিকতার অভাব, ভোগ বিলাসের প্রতি অতিআগ্রহ, পরকিয়াপ্রেম, লোভ আর লাভের প্রবণতা বৃদ্ধিই দেশে বিবাহবিচ্ছেদের মূল কারণ। করোনায় ঘরবন্দি স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়াকে এর জন্য দায়ি করা বোকামি। পরিবারে নারী-পুরুষের বিবেকী চর্চা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাবই এদেশে বিবাহবিচ্ছেদ বেড়ে গেছে। এ অবস্থা হতে উত্তরণে দেশের নারী ও পুরুষের মূল্যবোধ চর্চায় উদ্বুদ্ধ করার কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন।