বায়ান্নর নারী-বহ্নিশিখা

33

নারীকে কখনো অবলা-অচলা, কখনো প্রেমময়ী, প্রেমের অধিষ্ঠাত্রী দেবীরূপে কল্পনা করা হয়েছে। নারীকে পুরুষের প্রেষণাদায়ীও ভাবা হয়। কিন্তু যুগে যুগে নারী পুরুষেরও অধিক শক্তিরূপে প্রমাণ করেছে কতবার। সেদিকটায় আমরা কম দৃষ্টিপাত করি।
মাতৃভাষার অধিকার রক্ষা চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনেও দাপিয়ে, হাঁকিয়ে, অগ্নিঝরা শ্লোগানে রাজপথ কাঁপিয়েছিলেন।পঞ্চাশের দশকে রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের মিছিল,মিটিং এর জন্যে ঘরের বাইরে যাওয়া দুরূহ ছিল। কেবল বাংলা মায়ের হাজার বছরের লালিত ভাষাকে রক্ষার জন্যেই তাঁরা রক্ষণশীলতার ব্যুহভেদ করে।
১৯৪৮ সালে করাচীতে পাকিস্তান গণপরিষদের বৈঠকে উর্দু ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী উত্থাপন হলে তা নাকচ হয়ে যায়। একই সালের ২ মার্চ ফজলুল হক মিলনায়তনে এর প্রতিবাদে এক বৈঠক হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন দুজন নারী-আনোয়ারা খাতুন ও লিলি খান।
১৯৫১ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতি হিসেবে বর্তমান রোকেয়া হলে ক্যাম্পেইনিং হতো। এতে হালিমা, রোকেয়া ও সুফিয়া খান থাকতেন। হালিমা খাতুন কেবল আন্দোলনের জন্যই ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং মেয়েদেরকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার কাজ করেন।
১৯৫২ সালে এ আন্দোলন রুদ্র রূপ ধারণ করে। ২১ ফেব্রæয়ারি আন্দোলনের দিনক্ষণ নির্ধারণ হলে ২০ তারিখেই পাকিস্তানসরকার ১৪৪ ধারা জারি করে সভা,সমাবেশ, মিছিল নিষিদ্ধ করে। ঐ দিন প্রথম যে দল ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল বের করে-তার নেতৃত্ব দেন ড.শাফিয়া খাতুন। সঙ্গে ছিলেন ড.সুফিয়া, মাহফিল আরা, খোরশেদী খানম, ড. হালিমা, সুরাইয়া, সারা তৈফুর। অন্যএক জায়গায় জুলেখা, নূরী ও সেতারার নাম পাওয়া যায়। পুলিশের ব্যরিকেড ভাঙ্গা আরো দুজন সাহসী নারী-রওশনারা বাচ্চু, শামসুন্নাহার প্রমুখের নাম পাওয়া যায়। সেদিন পুলিশের লাটি ও টিয়ারশেলের আঘাতে অনেকেই আহত হয়েছিলেন, গ্রেফতার হয়েছিলেন। পুলিশের গুলিতে মানুষের মাথার খুলি উড়ে যাবার দৃশ্যের একটি গুরুত্ববহ ছবি ছিল। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হালিমাও রাবেয়া রাতের আঁধারে বুকের ভেতর করে পুলিশের সামন দিয়েই ছবিটি নিয়ে আসেন।
নারায়ণগঞ্জের মর্গান হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মমতাজ বেগম নারায়ণগঞ্জে আন্দোলনের পটভূমি তৈরি করেছিলেন। তাই সরকারি পুলিশবাহিনী ২৯ ফেব্রæয়ারি তারিখে তাঁকে স্কুল তহবিল তছরুপের মিথ্যে মামলায় গ্রেফতার করে। মুক্তির শর্ত হিসেবেতাঁকে বন্ডসই করতে বলায় তিনি রাজি হননি,সেজন্যে তাঁকে স্বামীর তালাক নিতে হলো। তবু তিনি পিছু হটেননি ভাষার মর্যাদা রক্ষায়।
ইলা বকশী, বেনুধর ও নাদেরা বেগম ভাষার জন্যে কারাভোগ করেন।
রাজধানীতে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে যেসব নারী ভাষা আন্দোলনে জড়িয়েছিলেন তাদের অন্যতম একজন সিলেট-মৌলভী বাজারের রওশন আরা বাচ্চু। রওশন আরা বাচ্চুর জন্ম ১৯৩২ সালে মৌলভী বাজার জেলায়। ১৯৪৭ সালে বরিশাল বি.এম. কলেজথেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হয়েওবিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হলে রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবিতে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। রওশন আরা বাচ্চু ১৯৫২ সালের ভাষাআন্দোলনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। তখন তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। তিনি সলিমুল­াহ মুসলিম হল, ওমেন্স স্টুডেন্টস রেসিডেন্সের হল ইউনিয়ন সদস্যও ছিলেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্র-ছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে যে মিছিল বের করে সেই মিছিলে অংশ নিয়ে পুলিশের লাঠিচার্জে তিনি আহত হন। সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে তার একটি স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, “সকাল দশটার দিকে দেখি একটি জিপ ও ৩/৪টি ট্রাক এসে দাঁড়ালো এবং পুলিশ বাহিনী পজিশন নিল, ইউনিভার্সিটির গেটটা ঘেরাও করলো। পুলিশ আমাদের মিছিলে লাঠিচার্জ করে।অনেক মেয়ে আঘাত পেলো, আমিও আঘাত পেয়েছি। আমরা দৌড়ে তখন এ্যাসেম্বলীর দিকে যাচ্ছিলাম, আমাদের উদ্দেশ্য ছিলো স্মারকলিপি পৌছে দেয়া। কিন্তু মেডিকেলের মোড়েই দেখি শেল পড়ছে, চারদিকে কাদুনে গ্যাস। বেলা তিনটার দিক, তখন আবার গুলির শব্দ পেলাম। এরপর তার কাটার বেড়া পার হয়ে ওসমান গনি সাহেবের বাড়িতে গেলাম। গিয়ে দেখি সারা তৈফুর, সুফিয়া ইব্রাহিম, বোরখা শামসুন। তারা আমার এ রক্তাক্ত অবস্থা দেখে এগিয়ে এল।” তিনি কুলাউড়া গালর্স স্কুল, ঢাকার আনন্দময়ী গালর্স স্কুল, নজরুল একাডেমীসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন সুনামের সাথে।
ঢাকার পাশাপাশি সিলেটের নারীদেরও ভাষা আন্দোলনে চোখে পড়ার মতো ভূমিকা ছিল। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে সিলেটে ভাষা আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দেন তাদের মধ্যে ছিলেন ছাত্রসমাজ, মহিলা সমিতি এবং মুসলিম লীগের প্রগতিশীল গোষ্ঠী। বছরটির শুরু থেকেই সিলেটের মহিলারা বিভিন্ন তৎপরতার মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনে অবদান রাখেন। ঐ বছর ১১ জানুয়ারি পাকিস্তানসরকারের যোগাযোগ মন্ত্রী আব্দুর রব সিলেটে এলে স্থানীয় মহিলাদের একটি প্রতিনিধি দল তার সঙ্গে দেখা করে বাংলাকেরাষ্ট্রভাষা করার জোরালো বক্তব্য তুলে ধরেন। ফেব্রæয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে সিলেট জেলা মহিলা মুসলিম লীগের সভানেত্রী জোবেদা রহিম চৌধুরী, সহ-সভানেত্রী সৈয়দা শাহার বানু চৌধুরী (অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের জননী), সম্পাদিকা সৈয়দা লুৎফুন্নেছা খাতুন, সিলেট সরকারী অগ্রগামী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মিসেস রাবেয়া খাতুন বিএবিটি, মিসেস জাহানারা মতিন, মিসেস রোকেয়া বেগম, মিসেস শাম্মী কাইসার রশীদ এমএ,বিটি, নূরজাহান বেগম, মিসেস সুফিয়া খাতুন, মিসেস মাহমুদা খাতুন, মিসেস শামসুন্নেছা খাতুন, সৈয়দা নজিবুন্নেছা খাতুন (শেখঘাটের এহিয়াভিলার গৃহবধূ) সহ সিলেটের বিশিষ্ট মহিলারা মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। এ স্মারকলিপিতে তারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান।
এ স্মারকলিপি পাঠানোর জের ধরে এ সময় সিলেটে উর্দু সমর্থক পত্রিকা ইস্টার্ন হেরাল্ড একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধে মহিলা নেত্রী জোবেদা রহিম ও স্মারকলিপি সম্পর্কে অশোভন মন্তব্য প্রকাশ করে। এই অশোভন বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন স্মারকলিপিতে স্বাক্ষরদানকারী সৈয়দা নজিবুন্নেছা খাতুন। ৮ মার্চের গোবিন্দচরণ পার্কের সমাবেশে হামলার প্রতিবাদে সিলেটের মহিলারা ১৯৪৮সালের ১০ মার্চ গোবিন্দ পার্কে একটি সভা আহবান করেন। কিন্তু সভা আয়োজনের আগেই সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এম. ইসলাম চৌধুরী সমগ্র সিলেটে সভা সমাবেশ আয়োজনে ১৪৪ ধারা জারি করেন। তখন সিলেটের জেলা প্রশাসক ছিলেন এম. খুর্শেদ। পাকিস্তানের স্থপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। তিনি২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে তাকে দেয়া সংবর্ধনা সভায় ও ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের বক্তৃতায়উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে তার অভিমতকে পুনর্ব্যক্ত করেন। সিলেটের মহিলারা জিন্নাহ সাহেবকেও তারবার্তাপ্রেরণ করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানান। ১৯৫২ সালে আন্দোলন যখন একেবারে চরমে, ২১ ফেব্রæয়ারি তারিখে ঢাকায় পুলিশের গুলিতে ছাত্র, জনতা হত্যার প্রতিবাদে সিলেটের নারী সমাজ আবারো প্রতিবাদে ফেটে পড়ে এবং ২২ ফেব্রæয়ারি প্রতিবাদসভার আয়োজন করে। ২৩ ফেব্রæয়ারি অনুষ্ঠিত মিছিলে সিলেটের বহু মহিলা স্বতস্ফুর্তভাবে অংশ নেয়। ১১টায় শুরু হয়ে প্রধানপ্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে মিছিলটি গোবিন্দ চরণ পার্কে এসে শেষ হয়। এখানে একটি জনসভাও অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তৃতাকরেন মাহিলা ও ছাত্রী নেত্রীবৃন্দ। ঐদিন বিকেলে জিন্নাহ হলেও (বর্তমানে শহীদ সুলেমান হল) এক মহিলা সমাবেশ হয়। বিকেলে গোবিন্দচরণ পার্কে সিলেট মহিলা কলেজের অধ্যাপক আবদুল মালেকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় এক জনসভা।
ভাষা আন্দোলনে মহিলাদের মধ্যে সিলেটে আরো যারা ভূমিকা রাখেন, তারা হলেন, হাজেরা মাহমুদ, রাবেয়া আলী, ছালেহাবেগম, লুৎফুন্নেছা বেগম প্রমুখ। নওবেলাল পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদ আলীর স্ত্রী হাজেরা মাহমুদ একজন বামপন্থী নেত্রী ছিলেন এবং ভাষা আন্দোলনে বিভিন্নভাবে তিনি অবদান রাখেন। রাবেয়া আলী ছিলেন সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর স্ত্রী।সরকারি চাকুরে হয়েও স্বামীর মতো ভাষা আন্দোলনের পক্ষে ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালে তিনিও অবদান রাখেন। লুৎফুন্নেছা বেগমেরস্বামী সেনা বিভাগের কর্মকর্তা হওয়া সত্তে¡ও তিনি ভাষা আন্দোলনে অবদান রাখেন। স্কুলে কালো পতাকা উত্তোলনের জন্যসিলেটের মেয়ে ছালেহা বেগমকে ডেপুটি কমিশনার এর আদেশক্রমে তার স্কুল থেকে ৩ বছরের জন্য বহিস্কার করা হয়।কুলাউড়ার মেয়ে ছালেহা বেগম ভাষা আন্দোলনের সময় ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্রী ছিলেন। ভাষাশহীদদের স্মরণে তিনি স্কুলে কালো পতাকা উত্তোলন করেন। বলা বাহুল্য, ছালেহার আর পড়াশুনা হয়নি।
নাম না জানা কতো নারী সেদিন আপন জাতিসত্তার ও মায়ের মুখে শুনা প্রথম বুলির অধিকার রক্ষায় ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনকে জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন। অনল ঝরা, স্বাধীনচেতনাধারী, জীবন বাজিরাখা, অরুণদ্যুতি সেইসব অসীমসাহসী নারীদের বিজয় কেতন উড়–ক যুগ-যুগান্তর।