বাজার ভরা গরু, ক্রেতা নেই

171

কর্ণফুলী পশুরহাটে বিক্রেতাদের অভিযোগ, গাড়ি পার্কিং থেকে শুরু করে পশু রাখতেও দিতে হয় চাঁদা
এম এ হোসাইন ও মনিরুল ইসলাম মুন্না
সর্বনিম্ন বিশ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ২৫ লাখ টাকা মূল্যের পশু এসেছে কর্ণফুলী পশুরহাটে। নগরীর নূরনগর হাউজিং এস্টেটের ইলিয়াছ ব্রাদার্সের মাঠ পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে কোরবানির পশুতে। যদিও এখনো বেচাকেনা একেবারেই নেই বললে চলে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বেপারিরা অনেকটা অলস সময় পার করছেন। এরই মধ্যে অব্যবস্থাপনা ও চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে ইজারাদারের বিরুদ্ধে।
নূরনগর হাউজিং এস্টেটে দশদিনের জন্য অস্থায়ীভাবে কর্ণফুলী পশুরহাটের ইজারা দিয়ে থাকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। শুধু পশুরহাট বসানোর জন্য এ অস্থায়ী বাজারটি ইজারা নেওয়া হলেও সেখানে গাড়ি পার্কিং ও খুটির ব্যবসা থেকে শুরু করে নানাভাবে চাঁদাবাজিতে নিয়োজিত ইজারাদার। অথচ সিটি কর্পোরেশনের শর্ত অনুযায়ী ইজারাদার শুধুমাত্র বিক্রিত পশুর মূল্যের উপর ৫ শতাংশ হাসিল আদায় করা অধিকার রাখে। পশুরহাটের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ইজারাদারের পক্ষ থেকে করার কথা। অথচ প্রতিটি গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য টাকা আদায়, তাবুর ভিতরে রাখলে গরু প্রতি ১ হাজার টাকা করে আদায় এমনকি বিদ্যুৎ- শৌচাগার ব্যাহারের জন্যও আদায় করা হচ্ছে টাকা।
নওগাঁ থেকে আসা গরু ব্যবসায়ী রমজান আলী বলেন, তাবুতে রাখতে প্রতিটি গরুর জন্য এক হাজার টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। আরো কিছু খরচ আছে। গ্রাম থেকে এখানে আনা ও অন্যান্য সবমিলিয়ে প্রতিটি গরুর পেছনে ৫ হাজার টাকা করে খরচ হয়। এসব খরচ স্বাভাবিকভাবে গরু দামের সাথে যুক্ত হয়। যার কারণে দাম একটু বেড়ে যায়।
অব্যবস্থাপনা ও চাঁদা আদায়ের অভিযোগের বিষয়ে জানতে ইজারাদার মো. সাইফুল আলমের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ‘বাজারে যথেষ্ট গরু এসেছে। দশ-বিশ বা পঞ্চাশ হাজার গরু এসেছে সেটা আমি বলবো না। পর্যাপ্ত জায়গাজুড়ে বাজার জমে উঠেছে’ বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরবর্তীতে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
বুধবার বিকেলে কর্ণফুলী পশুরহাট ঘুরে দেখা যায়, বাজারে সর্বনিম্ন ২০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা দামের গরু রয়েছে। রয়েছে বিভিন্ন দামের ছাগলও। এরমধ্যে ২৫ লাখ টাকা দামের ‘বিজয়’ নামের গরুটিকে ঘিরে উৎসাহী মানুষের ভিড় দেখা যায়। মোহাম্মদ আজিজের এই গরুটির ওজন ১১৫০ কেজি। কর্ণফুলী পশুরহাটের সবচেয়ে বড় গরু এটি।
‘বিজয়’ এর মালিক মোহাম্মদ আজিজ বলেন, গরুটি আমি ছোট থেকে লালনপালন করে বড় করেছি। বায়েজিদের খোন্দকিয়াতে ভাড়াবাসায় ৩ বছর পালন করে এটিকে বড় করেছি। আমি এটির ২৫ লাখ টাকা দাম দিয়েছি। ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে চাচ্ছে ক্রেতারা। কাছাকাছি দাম পেলে বিক্রি করে দিব।
কর্ণফুলী পশুরহাটে কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, মেহেরপুর ছাড়াও চট্টগ্রামের আনোয়ারা, চন্দনাইশ, বাঁশখালী, সাতকানিয়া, পটিয়াসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে গরু ও ছাগল নিয়ে এসছেন বিক্রেতারা। হাটে আসা পশুগুলোর অধিকাংশই নিজস্ব খামারের। ছোট থেকে মাঝারি, বড় সবধরনের পশু আছে বাজারে। বিক্রেতারা দাম বেশি নয় দাবি করলেও ক্রেতাদের দাবি দাম একটু বেশি। ফলে এখনো সেভাবে বেচাবিক্রি শুরু হয়নি।
ফরিদপুর থেকে আসা বিক্রেতা রমজান মোল্লা বলেন, ৩০টি গরু নিয়ে শুক্রবার বাজারে এসেছি। একটিও বিক্রি হয়নি। গতবারের চেয়ে এবার বাজারের অবস্থা খারাপ। গতবার এ সময়ে কিছু গরু বিক্রি হয়েছিল, এবার একদম বিক্রি নেই। শুক্রবার থেকে হয়তো বিক্রি শুরু হবে।
বাদুরতলার ক্রেতা আমিনুল হক বলেন, মূলত বাজার যাচাই করতে আসা। গতবারের চেয়ে দাম অনেক বেশি। দু-একদিন পর দাম কমতে পারে। বিক্রেতারা এখনো দাম ধরে রাখার চিন্তায় আছেন, বললেন এই ক্রেতা।
সাতকানিয়ার চরতী থেকে ১২টি গরু নিয়ে বাজারে এসেছেন বাবুল সওদাগর। তিনি বলেন, নিজের পালিত ১২টি গরু নিয়ে এসেছি। এসব গরুর প্রতিটির ৩ থেকে ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত দাম চেয়েছি। এখনো বেচাবিক্রি হয়নি। তবে অনেক ক্রেতা এসে দেখছেন। আশা করছি, আমি ভালো দাম পাবো।
সাগরিকা বাজার :
নগরীর বৃহত্তম গরু বাজার সাগরিকায় প্রচুর গরু আসলেও এখনও বেচাকেনা পুরোদমে শুরু হয়নি। ক্রেতারা বাজারে এসে দাম যাচাই করে ফিরে যাচ্ছেন। বিক্রেতরা পশুর দাম বেশি হাঁকাচ্ছেন বলে জানালেন কয়েকজন ক্রেতা। বাজারে বিভিন্ন জাতের বড় বড় গরু দেখা গেছে। বিক্রেতারা এক-একটার দাম হাঁকাচ্ছেন পাঁচ থেকে দশ লাখ টাকা পর্যন্ত। তবে বেচাকেনা চোখে পড়েনি।
গতকাল বুধবার বেলা দুইটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত সরেজমিনে সাগরিকা বাজার ঘুরে এমন চিত্রের দেখা মেলে।
জানা যায়, কুমিল্লা, ঢাকা, কুষ্টিয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, দিনাজপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর ও বরিশালসহ বিভিন্ন স্থান থেকে গরু এসেছে এ বাজারে। হাটে মাঝারি সাইজের দেশি গরুর পাশাপাশি আছে দেশীয় খামারের অস্ট্রেলিয়া, মিয়ানমার, ভারত ও নেপালি জাতের বড় বড় গরু।
বোয়ালখালী উপজেলার শাকপুরা থেকে জার্সি জাতের গরু নিয়ে এসেছেন সাজিদ এগ্রো ফার্ম। তারা প্রতিটি গরুর দাম হাঁকাচ্ছেন ২০ লাখ টাকা। উৎসুক ক্রেতারা ভিড় জমালেও আট লাখের বেশি দাম উঠেনি। তারা দেখতে সুন্দর আর মোটাতাজা ২২টি গরু বাজারে এনেছে। তবে গতকাল পর্যন্ত একটাও বিক্রি হয়নি।
ফরিদপুরের টেংরাখোড়া থেকে ২০টি গরু নিয়ে এসেছেন মো. নুর নবী বেপারি। বাজারের ভেতরে জায়গার ভাড়া বাবদ দেড় লাখ টাকা দিলেও বিক্রি করতে পারেননি একটি গরুও। অনেকটা হতাশ এ বেপারি জানালেন, শুক্রবার গরু নিয়ে এসেছি। পাঁচ দিন চলে গেলো, একটি গরুও বেচতে পারিনি। সবাই বলাবলি করছে শুক্রবার থেকে বিক্রি হবে, সেই আশা নিয়েই বসে আছি।
এদিকে প্রতিদিন ট্রাকে ট্রাকে গরু আসলেও রাখার মত পর্যাপ্ত জায়গা নেই বাজারে। বাজারের বাইরে সাগরিকা মোড় থেকে স্টেডিয়ামের আগ পর্যন্ত রাস্তার দু’ পাশেও গরু রাখা হয়েছে সারিবদ্ধভাবে। তবে এরজন্য ভাড়া দিতে হচ্ছে জায়গার মালিককে।
গরু বেপারি রিফাত জানালেন, বাজারের ভেতরে জায়গা না পেয়ে রাস্তার পাশে গরু রেখেছি। এতে ক্রেতারা আসা-যাওয়ার সময় গরুগুলো দেখছে।
তবে এ বাজারের ক্রেতাদের অভিযোগেরও শেষ নেই। তারা জানালেন, এবার ভারত- মিয়ানমার থেকে গরু না আসায় দ্বিগুণ দাম চাইছে ক্রেতারা। মোস্তাফিজ নামে এক ক্রেতা বলেন, এবার বিদেশি গরু না আসায় দাম বেশি।
এদিকে বিক্রেতারা জানান, বাজারে গরু রাখার জন্য খুঁটি ভাড়া ও পথে চাঁদা দেয়া থেকে শুরু করে খাদ্য কেনা পর্যন্ত সব মিলিয়ে দাম কিছুটা বেড়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের মো. লালচাঁন্দ মিয়া বলেন, ভারত, মিয়ানমার ও নেপাল থেকে গরু আসলে আমরা বড়ধরনের লোকসানের মুখে পড়ব।
ক্রেতা শিহাব বলেন, মাঝারি সাইজের দুইটি গরু দেখলাম, দাম দিচ্ছে সাড়ে ছয় লাখ টাকা। অথচ গত বছর এ মানের গরুর দাম ছিল চার লাখ টাকা পর্যন্ত। দেখে চলে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) ৭ কোটি ৮১ লাখ টাকায় এক বছরের জন্য ইজারা দেয় সাগরিকা হাট। সপ্তাহের প্রতি সোম ও বুধবার এ হাট বসে। তবে অন্যান্য দিনগুলোতেও এখানে পাওয়া যায় ছাগল, গরু ও মহিষ। কোরবানকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় লক্ষাধিক গরু আসে এ বাজারে। কিন্তু এবার এসেছে ২০ হাজারের মতো। তবে আজ-কালের মধ্যে আরো গরু আসার সম্ভাবনা আছে বলে জানালেন ইজারাদার।
চট্টগ্রাম গবাদি পশু ব্যবসায়ী সমিতির সচিব আমিনুল ইসলাম বলেন, গরুর বাজারে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রতিদিন থানা পুলিশের পাশাপাশি নিরাপত্তায় ৬০ জন অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য নিয়োজিত থাকেন। দুই শতাধিক স্বেচ্ছাসেবকও রয়েছেন।
তিনি বলেন, বাজারের পুরনো গরু ব্যবসায়ীরা তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা কিছু জায়গা নতুন ব্যবসায়ীদের ভাড়া দিয়েছেন। এটিকে অনেকে খুঁটি বাণিজ্য বলছে। এটা সত্যি নয়। জায়গা যে দিয়েছে তার প্রাপ্য ভাড়াই সে নিচ্ছে। এর অতিরিক্ত কোনও টাকা নেয়ার সুযোগ নেই। বেশি ভাড়া নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে সমিতির পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ইজারাদার সাইফুল হুদা মনে করছেন, গরু বিক্রি শুরু হবে বৃহস্পতিবার (আজ) থেকে। গত শুক্রবার থেকে তেমন গরু বিক্রি হয়নি। হাজার হাজার মানুষ আসে, কিন্তু দেখে চলে যায়।
এখনও পর্যন্ত কোরবানির পশু বেচাকেনা পুরোদমে শুরু না হওয়া প্রসঙ্গে তিনি পূর্বদেশকে বলেন, এখন বর্ষাকাল চলছে, তার ওপর শহরে যারা কোরবানি করেন গরু রাখার মতো তাদের জায়গা নেই। তাই তারা কোরবানির ঈদের তিন-চারদিন আগে থেকে গরু কেনা শুরু করেন।
তিনি আরও বলেন, বাজারে পর্যাপ্ত গরু আসছে আরও আসবে। এখানে আমরা গরু প্রতি ৫ শতাংশ হারে হাসিল নিচ্ছি।