বাঙালির প্রেম ও উপহার আমদানি

18

শেখ রিফাদ মাহমুদ

বাঙালিরা প্রেম ভালোবাসায় বিশেষভাবে দুর্বল বলেই প্রতারিত হয় বিভিন্নভাবে। সচরাচর দেখা যায় বিভিন্ন আত্মহত্যার ঘটনা। বেশিরভাগ আত্মহত্যার কারণও প্রেম। হয়তো প্রেমিক-প্রেমিকার বিচ্ছেদ, নয়তো পরিবার থেকে মেনে না নেওয়া এসব কারণে আবেগতাড়িত হয়ে কেউ কেউ করে বসেন আত্মহত্যা, প্রেমের কারণে বিসর্জন দিয়ে দেন নিজের জীবনের।
প্রেম নিবেদনের দিক থেকে বাঙালিরা যেকারোও থেকে অবশ্যই এগিয়ে থাকবে। কেননা প্রেমের টানে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে ভিনদেশ থেকে বাংলাদেশে আসা তরুণ-তরুণীর সংখ্যা কম নয়। তবে প্রেমের টানে বাংলাদেশে আসলেও তবে এ ধরনের বিয়েগুলোর পরবর্তী গল্প কেমন হয়? অনেকে তো বছর কেনো মাস না পেরোতেই ফিরে যান নিজ দেশে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট টাঙ্গাইলের সখীপুরের যুবক মনিরুলের কাছে প্রেমের টানে চলে আসেন মালয়েশিয়ান নারী জুলিজা বিনতে কামিস। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মনিরুলের প্রেমের সর্ম্পক হয়। প্রায় ছয় মাস সম্পর্কের পর ওই নারী মনিরুলের কাছে চলে আসে। সেসময় তরুণী জানিয়েছিলেন, তিনি পড়াশোনা শেষ করে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে বাবার বেকারির ব্যবসা পরিচালনা করেন। মনিরুলকে মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাবেন বলে কথাও দিয়েছিলেন। এরপর মনিরুলের পরিবারের সম্মতিতে দু’জন বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন। প্রায় ১মাসের ভিসায় আসা তরুণী ১৫ দিন সংসারের পর নিজ দেশে ফিরে যান। হঠাৎ করেই জানা যায়, মালয়েশিয়ায় জুলিজার স্বামী ও দুই সন্তান রয়েছেন।
সেসময় ওই তরুণীর পেছনে ১৭ দিনে মনিরুলের পরিবার ধার-দেনা করে প্রায় ৮০ হাজার টাকা খরচ করেন। এখনও সেই ঋণের টাকার বোঝা টানছে মনিরুলের পরিবার। মনিরুল এখন পড়াশোনা বাদ দিয়ে রাজমিস্ত্রির কাজ করছে।
এবছরই ভালোবাসার টানে ইতালি থেকে এসে আলী সান্দ্রে চিয়ারোমিন্তে নামে এক যুবক বিয়ে করেন ঠাকুরগাঁওয়ের বালীয়াডাঙ্গীর তরুণী রতœা রানী দাসকে। সনাতন ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী দুজন বিবাহবন্ধনেও আবদ্ধ হন। বিয়ের একমাস না পেরোতেই আলী সান্দ্রে চলে গেছেন নিজ দেশ ইতালিতে। পরে জানা যায়, আলী সান্দ্রের ইতালিতে রয়েছেন স্ত্রী ও ১০ বছরের একটি ছেলে সন্তান।
তবে ব্যতিক্রম ম্যালকম আরনল্ড ও হালিমা বেগম দম্পতির গল্প। ২০০১ সালে বাগেরহাট হালিমার সাথে অস্ট্রেলিয়ান চিত্রশিল্পী ম্যালকমের সাথে মোংলায় পরিচয় হয়। কিছুদিন পরে হালিমা অসুস্থ হয়ে পড়লে ম্যালকমকে চিঠি পাঠান এবং ২০০৩ সালে ম্যালকম বাংলাদেশে এসে হালিমার চিকিৎসা করান। পরে ম্যালকম হালিমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে হালিমা ম্যালকমকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কথা বলেন এবং ম্যালকম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ২০০৪ সালের ৮ ফেব্রæয়ারি হালিমাকে বিয়ে করেন।
দীর্ঘ ১৮ বছর তারা একত্রে খুলনায় ভাড়াবাড়ীতে বসবাস করছেন। অসুস্থতা ও চরম অর্থকষ্টেও ম্যালকম হালিমাকে ছেড়ে নিজ দেশে ফিরে যাননি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব প্রেমের শুরু হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর মধ্যে। প্রেমের টানে যারা বাংলাদেশ আসছেন এবং বিয়ে করছেন তাদের বেশিরভাগই মাস না পেরোতেই নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ নিজ দেশে ফিরে যেয়ে যোগাযোগও বন্ধ করে দিচ্ছেন, কারোও কারোও বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যাচ্ছে সেখানেও তাদের সংসার রয়েছে। প্রথমে আলোচিত হলেও পরে কপাল পুরছে অনেকেরই, সর্বস্বান্তও হচ্ছেন অনেকেই।
বাঙালিদের মধ্যে এক প্রকার ধারণা প্রচলন আছে; ভিন দেশের নাগরিক মানেই যেনো কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ সম্পদের মালিক। কেউ কেউ লোভের বসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন প্রেমে জড়িয়ে যাচ্ছেন। যার দরুণ হতে হচ্ছে প্রতারিত।
বেশ কিছুদিন ধরেই সংবাদ পত্রে দেখা যাচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিদেশিদের দ্বারা বিভিন্নভাবে প্রতারিত হবার খবর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কখনও নারী কখনও পুরুষ আবার কখনও আমেরিকান সেনা কর্মকর্তা সেজে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের মানুষকে বন্ধু বানাচ্ছে একদল প্রতারক চক্র। বন্ধু বানানোর পরে কারোও কারোও সম্পর্ক গড়াচ্ছে প্রেমে। বন্ধুত্ব কিছুটা ঘনিষ্ঠ পর্যায়ে পৌঁছালে প্রতারকরা দেখায় বিভিন্ন লোভ। এরপর স্বর্ণের গহনা, মোবাইল ফোন, ডলার ও দামি বিভিন্ন জিনিসপত্রের ছবি তুলে জানান বিদেশ থেকে তিনি এগুলো পাঠাতে চান। বাংলাদেশি যার সাথে কথা হচ্ছে তার থেকে নাম, ঠিকানা ইত্যাদি তথ্য নেন। সর্বশেষে ভুয়া পার্সেলের ওপর বাংলাদেশ থেকে যিনি রিসিভ করতে চান তার নাম, নাম্বার, ঠিকানা ইত্যাদি লিখে পুনরায় ছবি পাঠিয়ে জানিয়ে দেন আসলেই তিনি উপহার পাঠিয়েছে।
এদিকে উপহার বক্সের ওপর নিজের নাম, নাম্বার, ঠিকানা ইত্যাদি দেখে এ প্রান্তে থাকা ভালোবাসার মানুষও যেনো খুশিতে আত্মহারা। স্বপ্ন দেখেন উপহার পাবার পরে সেসব অর্থ সম্পদ দিয়ে কি করবেন। এসব ভাবতে ভাবতেই সময় গড়িয়ে যায়, হঠাৎই আসে ফোন। কাস্টমস ইন্সপেক্টর পরিচয় দিয়ে যোগাযোগ করে বলা হয়, আপনার গিফট এসেছে, গিফট বক্সে স্বর্ণ, ডলার ইত্যাদি থাকায় কাস্টম থেকে বক্সটি ছাড় করাতে লক্ষাধিক টাকা কাস্টম ডিউটি লাগবে। ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা ভালোবাসার মানুষ ভাবতে থাকতে এত্তো এত্তো সোনাদানা, ডলার, মোবাইল ফোন এগুলোর বিনিময়ে লক্ষাধিক টাকা কোনো ব্যাপারই না। কাস্টমস কর্মকর্তা পরিচয়ে কল করা ব্যক্তি পাঠিয়ে দেন ব্যাংক একাউন্ট নাম্বার, সেই সাথে জানিয়ে দেন দ্রæত টাকা পাঠিয়ে অমুক দিক এসে রিসিভ করুন আপনার উপহার বক্সটি। ভালোবাসার মানুষটি নিশ্চিতে টাকা পাঠিয়ে দিনক্ষণ গণনা করতে থাকেন; কবে আসবে সেদিন, যেদিন গিয়ে তিনি উপহার বক্স গ্রহণ করবেন। অতঃপর আসে সেই মোক্ষম দিন। ভালোবাসার মানুষ পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে সোজা চলে যান কাস্টমস কর্মকর্তার দেওয়া ঠিকানায়, গিয়ে খোঁজ করে জানতে পারেন; আসলে তার নামে কোনো পার্সেলই আসেনি, তিনি যাকে টাকা পাঠিয়েছেন সবই ভুয়া। সর্বশেষে ভালোবাসার মানুষটি বুঝতে পারেন তিনি প্রতারিত হয়েছে। এখানে রূপক অর্থে লক্ষাধিক টাকা ব্যবহার করা হলেও বাস্তবে চার, পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেয় প্রতারক চক্র।
কথায় আছে ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’। এই কথাটিই যেনো নির্মম সত্য। লোভের ফাঁদে পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যার প্রতি দুর্বল হচ্ছেন আনার তার দ্বারাই প্রতারণার শিকার হচ্ছে। ঘটনাগুলো বর্তমান সময়ে ব্যাপকহারে দেখা দিচ্ছে। লোভের কারণে মানুষ এসব প্রতারণার শিকার হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংঘটিত হওয়া প্রেমের বিশ্বস্ততা তেমন মজবুত নয়। যার ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রয়েছে প্রতারিত হবার আশঙ্কা। সব জেনে বুঝেও আবেগের বসে অনেকেই বিয়ে করে বসেন। সর্বশেষে প্রতারিত হবার পরে কপাল চাপড়ান।
প্রেমের টানে যারা বাংলাদেশে আসছেন তাদের থাকতে পারে বিভিন্ন অসাধু লক্ষ্য। রয়েছে মানবপাচারের সম্ভাবনাও। কেননা এ পদ্ধতিতে যে কাউকে বিদেশে নিয়ে পাচার করলেও কারও সন্দেহ থাকবেনা। কারণ স্বামী-স্ত্রী বলে কথা! ভালোবেসে নিজ দেশে নিয়ে যাচ্ছেন। এসব ভার্চুয়াল প্রেম ও বিদেশি বন্ধুদের উপহারের বিষয়ে সচেতন হতে হবে সবাইকে। গ্রোতে গা না ভাসিয়ে ভাবতে হবে বাস্তবতার কথা। সেইসাথে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেও জোড়ালো ভূমিকা পালন করতে হবে।

লেখক : উপদেষ্টা পর্ষদ সদস্য, গেøাবাল স্টুডেন্ট ফোরাম