বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড গঠন

18

জামাল উদ্দিন

আজ ৩ ডিসেম্বর। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের চ‚ড়ান্ত পর্বের ইতিহাস শুরু হয় এদিন। পদে পদে মুক্তিবাহিনীর হামলায় পাকিস্তানি হানাদাররা দিশেহারা হয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ের বেশে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। তারা একের পর এক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন ও ক্ষতিগ্রস্ত করে পাক সেনাদের ফাঁদে ফেলেন। এদিনে ভারতীয় পূর্বাঞ্চল কমান্ডের লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরার অধিনায়কত্বে ঘোষিত হয় বাংলাদেশের ভারত-যুক্ত কমান্ড। ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনী হলো মিত্রবাহিনী। গভীর রাতেই মিত্রবাহিনী অবরুদ্ধ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্ত এলাকায় অবস্থিত মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়। দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মরণপণ যুদ্ধরত বাংলাদেশের সশস্ত্র ও মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় মিত্রবাহিনীর নবম ডিভিশন গরীবপুর-জগন্নাথপুর হয়ে যশোর ঢাকা মহাসড়কসহ চতুর্থ ডিভিশন ষষ্ঠ ডিভিশনের বেশ কয়েকটি এলাকায় যোগাযোগ পথে (রুট) বাংলাদেশে প্রবেশ করে। যশোর কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, জেলার আরো কয়েকটি থানা মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। এদিন বিকেলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতার এক জনসভায় ভাষণদানকালে ভারতের বিমানবাহিনীর স্থাপনা ও রাডার স্টেশনগুলোতে বিমান হামলা চালায় পাকিস্তান। ভারতে জারি হয় জরুরি আইন। সে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চ‚ড়ান্তপর্ব। জাতির উদ্দেশে ভাষণে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, আজ বাংলাদেশের যুদ্ধ ভারতের যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। যুদ্ধ মোকাবিলায় দেশকে তৈরি করা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড দুর্বার বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাংলাদেশের স্বাধীনতার চ‚ড়ান্ত লড়াইয়ে। গভীর রাতে পূর্ণাঙ্গ লড়াই শুরু হয়। চতুর্দিক থেকে বাংলাদেশের দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ শুরু করল ভারতীয় সেনা, বিমান এবং নৌবাহিনী। আর মুক্ত এলাকা থেকে যোগ দিল বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী। ভারতীয় নৌবাহিনী বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী সমস্ত পাক অধিকৃত বন্দর অবরোধ করে জলপথে সরবরাহ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়। আক্রমণের প্রথমেই হানাদার বাহিনীর সাবমেরিন গাজীকে বঙ্গোপসাগরে সলিল সমাধি ঘটায়। পাকিস্তান এয়ারলাইন্স পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে সব ফ্লাইট বাতিল করে। সামরিক কর্তৃপক্ষ সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত ঢাকায় সান্ধ্য আইন জারি ও নিষ্প্রদীপ ব্যবস্থা পালনের নির্দেশ দেয়। এদিন ১১নং সেক্টরের মুক্তিবাহিনী কামালপুর বিওপি আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করে ।
এদিনেই বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সার্থক হামলায় চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় ফুয়েল ট্যাংক ও নারায়নগঞ্জ ফুয়েল পাম্প মারাতœক ক্ষতিগ্রগ্রস্থ হয়। কুমিল্লায় মেজর আইনুদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী মিয়াবাজারে পাকসেনাদের ওপর হামলা চালায়। ভারতীয় আর্টিলারী বাহিনীর সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লার মিয়াবাজার দখল করে নেয়। আখাউড়া-আজমপুর স্টেশনে দুই পক্ষই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে দিনভর যুদ্ধ চালিয়ে যায়। সিলেটের বালুগাছায় পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। নোয়াখালীতে সুবেদার মেজর লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল সোনাইমুড়ি মুক্ত করে। এরপর চৌমুহনীতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। মেজর জাফর ইমামের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী মাইজদীতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। রংপুরের পলাশ বাড়িতে ১২ জন পাকিস্তানী সেনা আত্মসমর্পণ করে। সাতক্ষীরা থেকে পিছু হটে দৌলতপুরের দিকে যায় হানাদার- বাহিনী। এদিন পাকিস্তান এয়ারলাইন্সের পূর্ব ও পশ্চিম অংশের সব ফ্লাইট বাতিল করে। হানাদার বাহিনী সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত ঢাকায় সান্ধ্য আইন জারী ও নিষ্প্রদীপ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়। ১১ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা কামালপুর বিওপি আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
৩ ডিসেম্বর বিকেলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী কলকাতায় বিশাল এক জনসভায় ভাষণদানকালে ভারতের বিমানবাহিনীর স্থাপনা ও রাডার স্টেশনগুলোতে বিমান হামলা চালায় পাকিস্তান। পাকিস্তানীদের এই অপারেশন ‘চেঙ্গীস খান’ নামে পরিচিত ছিল।
টাইম ম্যাগাজিন সূত্রে জানা যায়, এদিন নয়া দিল্লীতে সহসা অন্ধকার নেমে এলো। সন্ধ্যা ৬টায় ভারত সরকারের প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরোতে সাংবাদিকরা একত্র হয়েছিলেন বাংলাদেশের যুদ্ধের খবর সংগ্রহের নিয়মিত কাজে। তখন বিদ্যুৎ চলে গেলে প্রেস ব্রিফিংয়ে আসা কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন, এটা বø্যাক আউটের মহড়া নয়, আসল ঘটনা। এইমাত্র আমরা জানলাম পাকিস্তানী বিমানবাহিনী অমৃতসর, পাঠানকোর্ট ও শ্রীনগরে হামলা করেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী কলকাতা সফরকালে ব্রিগেড প্যারেড ময়দানের সভা সংক্ষেপ করে সন্ধ্যায় হঠাৎ দিল্লী রওয়ানা হন। রাতে জাতির উদ্দেশ্যে এক বেতার ভাষণে তিনি বলেন, পাকিস্তান আজ ভারতের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক হামলা চালিয়েছে। ভারতকে এই যুদ্ধ মোকাবিলা করতে হবে। পাকিস্তানের আক্রমণ ঐক্যবদ্ধভাবেই প্রতিহত করতে হবে। পরদিন লোকসভার অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ বিষয়ে বক্তব্য দেন। এভাবে এ দিনই পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

লেখক : মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, সাংবাদিক ও প্রকাশক