বলার অধিকার রুদ্ধ করে চলার অধিকার

53

মনিরুল ইসলাম মুন্না

শারদীয় দুর্গোৎসবে সংঘটিত ঘটনার প্রতিবাদে চট্টগ্রামে বিক্ষোভ সমাবেশ, সম্প্রীতি পুনরুদ্ধার মহাসমাবেশ অব্যাহত রয়েছে। এ সমস্ত সমাবেশে বাঙালির, বিশেষত চট্টগ্রামের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি-ঐতিহ্যের কথা উল্লেখ করে দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহŸান জানানো হচ্ছে। সে সাথে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনরুদ্ধারে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্যও সকলের প্রতি আহŸান জানানো হয়।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে এ সমস্ত সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কিন্তু নগরবাসীকে এ সমস্ত সভা-সমাবেশ চলাকালে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভয়াবহ যানজট ও জনজটের দুঃসহ অভিজ্ঞতা বহন করতে হয়। সড়ক দখল করে সভা-সমাবেশের কারণে এবং ওই বিশেষ এলাকা দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখার ফলে নগরবাসীকে দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে।
এহেন পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশেরও অনেক সময় হিমশিমের মধ্যে পড়তে হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত নগরীর বেশ কয়েকটি এলাকায় ছিল তীব্র যানজট ও জনজট। শুধু গতকাল নয় এর আগেও বেশ কিছুদিন ধরে এমন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন নগরবাসী। পুলিশ বলছে, সভা-সমাবেশ কমে এসেছে। কয়েকদিনের মধ্যে সব বন্ধ হয়ে যাবে। গত সপ্তাহের তুলনায় এ সপ্তাহে অনেক কম ছিল।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, রাস্তায় সভা-সমাবেশ করা আইনের কোথাও নেই। এছাড়াও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও মানুষকে কষ্ট দেয়া অনুচিত বলে উল্লেখ করা আছে।
এদিকে শারদীয় দুর্গোৎসবে সংঘটিত ঘটনার পর এক-দুইদিন পর পর সমাবেশ আয়োজন করছে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন।বাদ পড়েনি ছাত্র-শিক্ষক, চিকিৎসক, নানা রাজনৈতিক দলও। সকলে ব্যানার নিয়ে রাস্তায় সভা-সমাবেশ করার কারণে দুর্ভোগে পড়েছেন চলাচল করা পথচারী ও যাত্রী সাধারণ।
কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নেজাম উদ্দিন পূর্বদেশকে বলেন, যেসব স্থানে জনদুর্ভোগ তৈরি হয় সেখানে সিএমপি’র পক্ষ থেকে অনুষ্ঠান করার অনুমতি দেয়া হয় না। কেউ কেউ অনুমতি না নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়েন। এতে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়। আমরা এমনও দেখেছি, সিএমপি’র পক্ষ থেকে অনুমতি না নিয়ে একটি সংগঠনের নামে ব্যানার টাঙিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়েছে। তাৎক্ষণিক আমরা ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠিয়ে অনুমতি নেয়ার জন্য নির্দেশনা প্রদান করি। অনুমতি পাওয়া গেলে তাদেরকে প্রোগ্রাম করতে দেয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, সংগঠনগুলো অনুমতি নেয়ার পরেও যদি রাস্তায় যানজট ও জনজট তৈরি করে। তবে আমরা অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করে পথচারী, যাত্রী ও চালকদের চলাচলের ব্যবস্থা করি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আমরা ডাইভারশনের ব্যবস্থা নিই। তবে দুর্গাপূজা শেষ হওয়ার পর থেকে যেসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল, বর্তমানে তা অনেকটা কমে এসেছে। গত এক সপ্তাহ আগে যেরকমভাবে রাস্তার উপর অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল, এ সপ্তাহে তেমন হয়নি। কয়েকদিন পর একেবারেই কমে আসবে।
দুপুর একটায় আইস ফ্যাক্টরি রোড থেকে জামালখানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন একটি প্রাইভেট ক্লিনিকের চিকিৎসক রোমেল জামান। তিনি বলেন, নন্দনকানন থেকে ডিসি হিল বৌদ্ধ মন্দির সড়ক হয়ে গন্তব্যে যাবো। কিন্তু রোড ব্লকড। অগত্যা ফিরতে হলো পেছনে, এবার আমতল-জুবিলি রোড হয়ে এগোবার চেষ্টা। সামনে পেছনে গাড়ি আর মানুষের সারি। ২ ইঞ্চি ৪ ইঞ্চি করে এগোতে এগোতে ৩ টায় কোনো রকম জামালখান এলাম। আমার কথা হলো, হামলার প্রতিবাদ বা বলার অধিকার তো আছেই, তা সড়ক দখল করে, বন্ধ করে, মানুষের দুর্ভোগ সৃষ্টি করে কেন এবং টানা এ দুর্ভোগ কতদিন সইবে মানুষ। বলার অধিকার যেমন আছে, চলার অধিকারও তো আছে আমাদের। এক অধিকার আরেক অধিকারকে গ্রাস করবে কেন?
সরেজমিনে নগরীর নিউ মার্কেট, আন্দরকিল্লা, নবাব সিরাজউদ্দৌলা সড়ক, জামালখান প্রেস ক্লাব এলাকা, নন্দনকানন, কাজীর দেউড়ি, চকবাজার, মুরাদপুর, জিইসিসহ কয়েকটি এলাকা ও মোড়ে অসহনীয় যানজটের চিত্র চোখে পড়ে। আবার প্রেস ক্লাব এলাকা, চেরাগী পাহাড় মোড়, নন্দনকানন এলাকায় কোনো একটা সমাবেশ বা বিক্ষোভের আয়োজন হলে রাস্তাসহ বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে যানবাহন চলাচল তো দূরের কথা, সাধারণ মানুষও চলাচল করতে পারে না। পুলিশের পক্ষ হতে বিকল্প পথে যাতায়াতের পরামর্শ আসে।
দুপুর তিনটার দিকে চকরিয়া থেকে এ্যাম্বুলেন্সে করে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগী আনছিলেন চালক মো. মঞ্জুর আলম। কোতোয়ালী মোড় থেকে আন্দরকিল্লা মোমিন রোডে আসতে তার ৪০ মিনিট সময় লেগে যায়। তিনি বলেন, ‘পটিয়া থেকে শহরে আসতে লেগেছে ২০ মিনিট অথচ কোতোয়ালি থেকে আন্দরকিল্লা আসতে লেগেছে ৪০ মিনিট। এখন যদি রোগীর বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যায়, তবে এর দায় নিবে কে? এখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে কতক্ষণ লাগে একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন।
চেরাগী পাহাড় থেকে এনায়েত বাজারে যাবেন মো. ফোরকান উদ্দিন। প্রথমে রিকশা দরদাম করলেও রাস্তা বন্ধ থাকায় রিকশাতেও উঠতে পারেননি তিনি। পরে পায়ে হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু ডিসি হিলের মোড়ে গিয়ে দেখেন রাস্তা বন্ধ। পুলিশ আর সামনের দিকে যেতে দিচ্ছেন না। পুলিশের পক্ষ থেকে উনাকে বলা হয়, আন্দরকিল্লা দিয়ে ঘুরে যেন এনায়েত বাজার যান।
রাস্তা ডাইভারশনের বিষয় নিয়ে নগর ট্রাফিক পুলিশের উপ-কমিশনার মো. আলী হোসেন দৈনিক পূর্বদেশকে বলেন, রাস্তায় যখন কোনো সভা-সমাবেশের আয়োজন করা হয় অনেক সময় আমরা অবগত হতে পারি না। এরপরও যাতে যান চলাচলে ব্যাঘাত না হয় তাই আমরা বিকল্প রাস্তা ব্যবহারের পরামর্শ দিই। এরমধ্যে জরুরি সেবা পরিবহনের গাড়ি যেমন এ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস, সংবাদ মাধ্যমের গাড়ি নির্বিঘেœ চলাচলের জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হয়। আমরা চাই নাগরিক, পথচারী ও যাত্রীরা যেন দুর্ভোগের শিকার না হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা হবে।
সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ড. মুহাম্মদ মাসুম চৌধুরী বলেন, রাস্তা দখল করে, উচ্চ স্বরে মাইক বাজিয়ে মানুষকে কষ্ট দেয়া উচিত নয়। এটা আইনেও বলা নেই। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ যে ধর্মের মানুষ হোক না কেন মানুষকে কষ্ট দিয়ে কোনোকিছু করতে পারবে না। রাস্তা দখল করে অবরোধ করে সমাবেশ করলে সাধারণ মানুষের কষ্ট হয়। এটিকে আমি অপরাধ মনে করি। পুলিশ ও প্রশাসনের উচিত রাস্তার উপরে এসব সভা-সমাবেশের অনুমতি না দেয়া। এছাড়াও ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকেও বলা আছে, কষ্ট দেয়া হারাম। কাজেই আমাদের এসব বিষয় থেকে বেরিয়ে এসে মানুষের প্রতি ভালবাসা ও সহানুভূতি জাগাতে হবে।