বন্যায় মানবিক বিপর্যয়-আসুন পাশে দাঁড়াই

18

বাসুদেব খাস্তগীর

বর্ষা এলেই বাংলাদেশের কোনো না কোনো অঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হয়। আমরা জানি বাংলাদেশ নদী বিধৌত সমতল বদ্বীপ অঞ্চলের একটি দেশ। এক তথ্য মতে, ছোট বড় প্রায় ২৫০টির মত নদী জড়িয়ে রেখেছে বাংলাদেশকে। এ দেশকে ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে প্রায়ই নানা প্রাাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে থাকতে হয়। শীত, খরা, ঘূর্ণিঝড়, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, দারিদ্র্য ও অভাবের মতো বন্যাও যেন এদেশের মানুষের কাছে প্রতিবছর অনিবার্যভাবে এসে পড়ে। বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলের অনেক লোককে বন্যার সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করেই যেন বেঁচে থাকতে হয়। সাগরের কোল ঘেঁষে জেলাগুলোর মানুষ যেমন প্রতিবছরই ঘূর্ণিঝড়ের মত দুর্যোগের শঙ্কায় থাকে তেমনি কিছু জেলার মানুষের কাছে বন্যা যেন অতি স্বাভাবিক একটি ঘটনা। সাগরের কোল ঘেঁষে জেলাগুলোও বন্যাকবলিত হয় প্রায় সময়ই। এদেশে অতীতে অনেক সময় বড় বড় বন্যা হবার রেকর্ডও আছে। বন্যা সাধারণত দুটো কারণেই আমাদের সামনে পরিদৃষ্ট হয়। একটি প্রাকৃতিক কারণ বা অতিবৃষ্টি অন্যটি মনুষ্যসৃষ্ট কারণ। বর্ষাকালে স্বাভাবিকভাবে বৃষ্টি হবেই। কিন্তু বৃষ্টির মাত্রা যখনই সীমা অতিক্রম করে তখন বন্যা দেখা দেয় এবং সেখানে যদি মানুষসৃষ্ট কারণগুলো যোগ দেয় তাহলে বন্যার মাত্রা তীব্র আকার ধারণ করে। বাংলাদেশে এই সময় বন্যার কবলে পড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলবীবাজার, হবিগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, লালমনির হাট, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, নীলফামারী, নেত্রকোণা, রংপুরসহ অনেক জেলা এখন বন্যায় চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। বিশেষ করে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের বন্যার চিত্র দেখে দেশের মানুষ স্তম্ভিত। এ রকম বন্যা সিলেটের মানুষ আর দেখেনি। অনেক জায়গার খবর পাওয়া যাচ্ছে না, অনেক জায়গায় পৌঁছাও সম্ভব হয়নি। আবার অনেক জায়গায় ত্রাণ সামগ্রীই পৌঁছানো যায়নি। খাদ্য নেই, পানি নেই, বিদ্যুৎ নেই, গ্যাস নেই, মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। তার ওপরে ঘরবাড়ি ছেড়ে আসা মানুষের ঘরে লুটপাট ও ডাকাতের হামলা। আশ্রয়কেন্দ্রে জায়গা নেই। গাদাগাদি করে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছেন অনেকেই। জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। সব মিলিয়ে এক ভয়াবহ অবস্থা। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এখন বন্যার খবর নিয়েই ব্যস্ত। করোনা পরবর্তী সময়ে দেশে এত বড় বন্যার প্রকোপ যেন ‘মড়ার ওপর খাড়ার ঘাঁ।’ দেশের দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এসময়ে বন্যার পদধ্বনি মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। সমাজের বিত্তবান ও এলাকার জনপ্রতিনিধিদের এখন এগিয়ে আসা দরকার বন্যার্তদের পাশে।
বাজারে গেলেই দেখা যায় সমাজে মনে হয় এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে এখনও অভাববোধ বলতে কিছু নেই। বাজারের এই অবস্থায়ও তাদের খাওয়া দাওয়া আনন্দ জৌলুসে কোনো কমতি নেই। দেশে এক শ্রেণির মানুষ বিত্তবান থেকে ক্রমাগত বিত্তবান হয়েছে এবং কিছু মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়েছে। বন্যা কবলিত মানুষের মধ্যে অধিকাংশই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র শ্রেণির নিপীড়িত জনগোষ্ঠী। তাদের ওপর করোনার খর্গ নামার পর বন্যার মত একটি দুর্যোগ ঘাড়ে চেপে বসেছে। বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যার পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় এদেশে বড় বন্যাগুলো হয়েছিল ১৯৭৪, ১৯৭৭, ১৯৮০, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৮৯, ১৯৯৪, ২০০৪ ও ২০০৭ সালে। ১৯৮৮ সালের বন্যা ছিলো সবচাইতে আলোচিত ও দীর্ঘস্থায়ী বন্যা। এরপর এ বছরের বন্যা এখন পর্যন্ত দেশে আলোচিত বন্যা হয়েই আছে। দেশের বৃহৎ নদীগুলো পাহাড়ি বৃষ্টিপাত ও হিমালয়ের বরফগলা পানি বয়ে এনে প্রায় প্রতিবছরই এদেশে বন্যা ঘটায়। এদেশের নিরীহ মানুষগুলোর জীবন করে তোলে যন্ত্রণাময়। প্রতিবছর বন্যা দেশের মানুষের প্রাণহানি ও ধনসম্পদের ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে। আর আমাদের মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের উত্তরে আসাম, মেঘালয়ের মত রাজ্যগুলোতে যখন প্রচুর বৃষ্টিপাত সে পানিগুলো প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে নিচের অববাহিকায় নদী হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং বন্যার সৃষ্টি করে। পৃথিবীর বেশি বৃষ্টিপাতের অঞ্চল ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জি আর তার ওপরে হিমালয় তো আছেই। সুতরাং বন্যা যেন বাংলাদেশের বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি অনিবার্য পরিণতি। ভারতের আসাম মেঘালয়েও প্রচুর বন্যা হয় প্রতিবছর। তবে এসব প্রাকৃতিক কারণের বাইরেও এদেশে ভারতের ফারাক্কার বাঁধ ও তিস্তা বাঁধের প্রভাবেও বন্যার সৃষ্টি হয়। এ সময়ে বন্যায় দেশের অনেক জেলা কমবেশি প্লাবিত হয়েছে। মানুষ এখন পানিবন্দি হয়ে নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছে। করোনার প্রভাবে দেশের অর্থনীতির অবস্থা এমনিতেই নাজুক। কলকারখানায় উৎপাদন কমেছে। বহু মানুষ চাকরি হারিয়ে গ্রামে ফিরে গেছে। জীবন বাঁচানোর তাগিদে পেশা বদলের চিন্তায় নিমগ্ন কর্মহারা মানুষগুলো এখন আরেকটি মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। মধ্যবিত্তরাও আছে চরম কষ্টে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পড়েছে সংকেটে। এসএসসি পরীক্ষা পেছানো হয়েছে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাও নির্দিষ্ট সময়ে হবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। করোনা এমনিতেই শিক্ষাক্রমকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এসএসসি ও এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে এইচএসসি পরীক্ষা নেয়ার যে রীতি ছিলো করোনা তা এলোমেলো করে দিয়েছিলো।
সরকার চেষ্টা করছিলো পর্যায়ক্রমে পরীক্ষাগুলোকে আবার সে জায়গায় ফিরিয়ে নিতে। কিন্তু বন্যা সে পরিকল্পনাকে আবার দূরে নিয়ে যাচ্ছে। এখন দেশের প্রায় সবকটি বড় নদ-নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে বা অতিক্রম করার কাছাকাছি অবস্থান করছে। পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার ফলে দেশে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। উজান থেকে নেমে আসা পানির আধিক্য এবং অতিবৃষ্টিই বন্যার মূল কারণ। বন্যা শুধু মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তা কিন্তু নয়, গোটা দেশের অর্থনীতিকেই বিপর্যস্ত করে ফেলে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনও কৃষিনির্ভর। বন্যায় সেই কৃষির ইতিমধ্যে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গ্রামীণ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ সাধারণ জীবনে অভ্যস্ত। বন্যায় রাস্তাঘাট সবকিছু ডুবে তাদের আয়-রোজগারের পথ অনেকটায় বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বন্যাকবলিত এলাকায় খাদ্যের অভাবে মানুষগুলো এখন মানবেতর জীবনযাপন করছে। বন্যার করালগ্রাসে অনেক মানুষের ঘরবাড়ি, কৃষিজমি, বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বহু মানুষ ভূমিহীন হয়ে পড়েছে। এবারের বন্যার প্রভাব দেখে বুঝা যাচ্ছে এর ক্ষতির পরিমাণ আরো ব্যাপক। বহু মানুষ ইতোমধ্যে তাদের সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব এবং বাকরুদ্ধ। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত তাদের জীবন। শুধু প্রকৃতিগত কারণেই দেশে যে বন্যা হয়ে থাকে, তার বেশি এখন সবচাইতে বেশি আলোচিত মনুষ্যসৃষ্ট কারণগুলো। প্রশাসনের নাকের ডগায় ক্ষমতাশালী মানুষগুলো দেশের খাল-বিল, ছোট ছোট নদী-নালা, পুকুর- ডোবা ভরাট করে নানা স্থাপনা গড়ে তোলে। ফলে পানি নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থার অভাবে বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি উপচে পড়ে বন্যা ঘটাচ্ছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক খাল-বিল, নদী-নালা, পুকুর-ডোবা ভূমিদস্যুরা ভরাট করে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করেছে। এসব যেন দেখার কেউ নেই। তার ওপরে প্রবল বর্ষণে ঘটে পাহাড় ধসের মত ঘটনা। বর্ষাকাল এলেই হয় উচ্ছেদ অভিযান। তার আগে কিভাবে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ ঘরবাড়ি তৈরি করা হয় তা বোধগম্য নয়। ষড়ঋতুর এ দেশে বন্যার সাথেই আমাদের বসবাস করতে হবে। কিন্তু সত্যি যে তা প্রতিরোধ কিংবা এর মাত্রা কমানোর ক্ষেত্রে আমাদেরও দায়িত্বশীল ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু দেখা যায় বর্ষাকাল এলেই চারিদিকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ভাঙন, নদী শাসনের মত করা কাজগুলো বছর যেতে না যেতেই ভেঙে পড়ে। পত্রপত্রিকা, সোশ্যাল মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এসব খবর প্রচারিত হয়। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আঙুল ওঠে। এ যেন প্রতিবছরের প্রাত্যহিক একটি চিত্র। তারপর বর্ষা গেলে এসব ঘটনা কোথায় যেন হারিয়ে যায়। এখন ঢাকা চট্টগ্রামসহ দেশের বড় শহরগুলো অল্পবৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার সম্মুখীন হয়। তাই বন্যা যতটা না প্রাকৃতিকভাবে ঘটে, তাতে মানুষের সৃষ্ট কারণগুলো যোগ হলে বন্যা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। আমাদের ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বন্যা রোধ করা আমাদের পক্ষে মোটেই সম্ভব নয়। তাবে বন্যার ক্ষতিকর প্রভাব যতটুকু পারা যায় ততটুকু কমানোর চেষ্টা আমাদের করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। দুর্নীতি এক্ষেত্রে বড় একটি বাধা। বৃহত্তর সিলেটসহ দেশের অনেক জায়গার মানুষ এখন বন্যার কবলে পড়ে মানুষ ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সস্মুখীন। এসব নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানো এখন সময়ে দাবী। পানিবন্দি এসব মানুষ এখন পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্রের অভাবে মানবেতর দিনযাপন করছে। তাঁদেরকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে খাদ্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তায় আনা জরুরি। এই সময়ে টাকা পয়সা দেবার চাইতে তৈরি খাবার দিয়ে জীবন রক্ষার পদক্ষেপ নিতে হবে। অনেকের কাছে সবকিছু থাকলে চালচুলো ঘরবাড়িতে পানি ওঠার কারণে কিছুই তারা করতে পারছেন না। ছোট ছোট শিশু ও বাড়ির গৃহপালিত পশুদের জীবন এখন চরম হুমকিতে। বন্যাকবলিত মানুষদের খাদ্য-পানীয় সরবরাহ নিশ্চিত করতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ অতীব জরুরি। এক্ষেত্র এখন সেনাবাহিনির কার্যক্রম প্রশংসার দাবীদার। সাথে নৌ বাহিনি , বিমান বাহিনি, র‌্যাব, বিজিবি ও পুলিশের ভূমিকাও প্রশংসনীয়। মানবিক এ বিপর্যয় ঠেকাতে মানুষই যদি মানবিক না হয়ে ওঠে তাহলে মানুষেরই লজ্জা। আসুন সবাই মানবতাকে সামনে তুলে ধরে বন্যা কবলিত মানুষের পাশে দাঁড়াই।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বি এম সি ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম