ফুটপাত দখলে হকারের চেয়ে এগিয়ে চসিক-সিএমপি

49

ওয়াসিম আহমেদ

পথচারীদের হাঁটার ফুটপাত দখল করার ‘তকমা’ হকারদের উপরেই বর্তায় সচরাচর। সুদীর্ঘকাল থেকে এটা নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। তবে ফুটপাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনও (চসিক) ফুটপাত দখলে পিছিয়ে নেই। ফুটপাত দখলমুক্ত করে সে ফুটপাতেই রাজস্ব আয়ের দোহাই দিয়ে দোকান বরাদ্দ, যাত্রী ছাউনি ও সৌন্দর্যবর্ধন, গণশৌচাগার ও পরিচ্ছন্নকর্মীদের বিশ্রামাগারের নামে দোকান বসানোতে বেশ ‘পটু’ চসিক নিজেই। একইভাবে আলোচনায় নগর পুলিশও। সূত্র বলছে, গত পাঁচ বছরে ফুটপাত দখল করে অন্তত পাঁচ শতাধিক স্থাপনা করেছে উল্লেখিত সরকারি সংস্থাগুলো।
সূত্র জানায়, নগরীর শেরশাহ, তারাগেট ও টেক্সটাইল এলাকায় ফুটপাতের উপর ২২৮টি ও বহদ্দারহাট স্বজন সুপার মার্কেটের সামনে ৫০টি দোকান রয়েছে। বহদ্দারহাট কাঁচাবাজার বর্ধিত করার নামে ফরিদার পাড়া মুখের সড়ক দখল করে প্রায় ১০০টি দোকান, সৌন্দর্যবর্ধ, যাত্রী ছাউনি, গণশৌচাগার ও পরিচ্ছন্নকর্মীদের বিশ্রামাগারের নামে আরো অন্তত ১০০টি দোকান বরাদ্দ দিয়েছে চসিক। একইভাবে কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়াই ফুটপাতে ৩৫টি ট্রাফিক পুলিশ বক্স, দামপাাড়া পুলিশ লাইনের নিচে দুইটি দোকান বসিয়েছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)।
নগরীর নিউ মার্কেট মোড় থেকে রেলওয়ে স্টেশন, এ দুইশ মিটার ফুটপাতে শুরুতে পুলিশ বক্স, ১৫টির মত হকারের দোকান, দুই কক্ষের পরিচ্ছন্নকর্মীদের বিশ্রামাগার, ছয় কক্ষের গণশৌচাগার ও মোবাইলের দোকান বসেছে। এ ফুটপাতে হকারের চেয়ে তিনগুণ বেশি দখল করেছে সিটি করপোরেশন নিজেই। গতকাল ওই এলাকায় সরেজমিনে গেলে এমন চিত্র দেখা যায়। একই এলাকায় চারটি যাত্রী ছাউনির অনুমোদন দিয়েছে সিটি করপোরেশন। যদিও সেখানে যাত্রী উঠা-নামার বালাই নেই। এসব দোকানের সামনে লেখা হয়েছে, ‘সিটি করপোরেশন অনুমোদিত স্টল’। মূলত অধিক ভাড়া পেতে এমন ফাঁদ পেতেছে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে ফুটপাত দখলদাররা।
অন্যদিকে সিটি করপোরেশন হকারদের মধ্যে শৃঙ্খলা ফেরাতে বিভিন্ন সময় নানান উদ্যোগ নিয়েছে। সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন হকারদের তালিকা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যেখানে শুধুমাত্র নিউ মার্কেট এলাকায় ৮ হাজার ৫৯৯ জন হকারের তালিকা রয়েছে। সে হিসেবে পুরো চট্টগ্রামে অন্তত ২০ হাজারের অধিক ‘প্রফেশনাল’ হকার রয়েছে বলে দাবি হকার নেতাদের।
হকার নেতা নুরুল আলম লেদু পূর্বদেশকে বলেন, ‘মেয়র পুরো শহরজুড়ে দোকানের বর্ধিতাংশ ভাঙছেন, স্থায়ী স্থাপনা উচ্ছেদ করছেন। তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। নিউ মার্কেট এলাকায় হকারদের স্থায়ী স্থাপনা নেই। যা আছে তা সিটি করপোরেশন অনুমোদন দিয়েছে। ফুটপাত প্রশস্ত করে হকারদের বসার সুযোগ অব্যাহত রাখলে গরীব মেহনতি মানুষগুলো কোনোভাবে জীবিকা নির্বাহ করে চলতে পারবে।’
এসব বিষয়ে নিয়ে সিটি মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, সিটি করপোরেশন ফুটপাতের উপর যেসব দোকান বরাদ্দ দিয়েছে তার কোনোটাই আমার আমলে নয়। তবুও নির্ধারিত ডিজাইনের বাইরে যারা দোকান বর্ধিত করেছে, ফুটপাত দখল করেছে, তাদের সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। আর এসব বরাদ্দের সবকিছুর নির্ধারিত মেয়াদ আছে। আজীবনের জন্য দেওয়া হয়নি। ডিজাইনের বাইরে যা করা হয়েছে তা ভাঙা হবে আর মেয়াদ শেষ হলে কোনোভাবে মেয়াদ বাড়ানো হবে না। দ্বিতীয়ত পুলিশ বক্স নিয়ে আমি লিখিতভাবে আপত্তি জানিয়েছি। অনুমোদন চেয়েছিলো কিন্তু দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে পুলিশ লাইনের সীমানা দেওয়ালের সাথে যে দোকানগুলো পুলিশ বসিয়েছে তা নিয়ে সাবেক কমিশনার তানভীর সাহেবকে বলেছি। তাদের তো টাকার অভাব হয়নি, চাইলে সেখানে একটি মনমুগ্ধকর ফুলবাগান করা যেত।
ফুটপাত নিয়ে পরিকল্পনা ও উদ্যোগের বিষয়ে মেয়র বলেন, প্রতিদিন উচ্ছেদ করছি। দোকানের বর্ধিতাংশ ফুটপাতকে এত প্রকটভাবে হরণ করেছে, হাঁটার জোঁ নেই। পুরো শহরে অভিযান শেষে নিউ মার্কেট এলাকায় শৃঙ্খলা আনতে অভিযান পরিচালনা করা হবে। অভিযানের পর পুনরায় দখল হয়ে যায়। তাই পুনরায় উচ্ছেদ ও মনিটরিং বাড়াতে স্ট্রাইকিং ফোর্স করা হয়েছে। একদিনে তো পরিবর্তন আসবে না, তবে আসবে সেটা নিশ্চিত থাকেন।
ফুটপাতে হকাররা যেভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় : ফুটপাতে বসা হকারদের কাছ থেকে সাধ্যের মধ্যে তৃপ্তিসহকারে কেনাকাটা করতে পারেন সমাজের নি¤œশ্রেণির মানুষেরা। সংখ্যায় সমাজের ধনীশ্রেণির চেয়ে বেশি তারাই। ফলে হকারদের বেশ চাহিদাও রয়েছে। তাই হয়তো বারবার উচ্ছেদ করেও থামানো যাচ্ছে না। বিপরীতে প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত, কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষেরা অল্প পুঁজি নিয়ে সহজেই হকারি ব্যবসা করতে পারেন। তাই এই জগতে বিশাল একটি অংশের আগ্রহও প্রবল। ক্রেতা ও বিক্রেতার চাহিদার ঢেউকে পুঁজি করে সাম্রাজ্য পেতে বসেছে একটি চক্র।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, যুগ যুগ ধরে ফুটপাতের দখলকৃত অংশ বিক্রি হচ্ছে। যে একবার দখল করে সে নিয়মিত টাকার বদলে ভাড়া দেয়। না হয় উত্তরাধিকার সূত্রে পিতার জায়গায় পুত্র বা আত্মীয়-স্বজন বসছে। তবে বাইরের কারো বসার সুযোগ নেই। জানা গেছে, আন্দরকিল্লা থেকে পুরাতন রেলস্টেশন পর্যন্ত ফুটপাত ৬টি হকার সংগঠনের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয়। আমতল থেকে পুরাতন রেলস্টেশন পর্যন্ত ফুটপাত দখলে রয়েছে চট্টগ্রাম ফুটপাত হকার্স সমিতি, মেট্রোপলিটন হকার্স সমিতি ও চট্টগ্রাম হকার্স লীগ সংগঠন তিনটির। নির্ধারিত জায়গায় বসলেই গুনতে হয় সংগঠনের নির্ধারিত চাঁদা। আবার ওসব এলাকায় বাতি জ্বালানো, পানি সাপ্লাই ও দৈনিক সুদের ভিত্তিতে টাকা দেওয়ার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন সংগঠনের নেতারা। কেসিদে রোড থেকে লালদিঘী সিটি হকার্স লীগ এবং আন্দরকিল্লা থেকে টেরিবাজার এলাকায় আন্দরকিল্লা টেরিবাজার হকার্স সমিতির দখলে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম সম্মিলিত হকার্স লীগ নামের একটি সংগঠনও সক্রিয় রয়েছে। তবে ফুটপাত রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে নেতা বনে গেছেন নুরুল আলম লেদু, প্রবীণ কুমার ঘোষ, হারুন রশীদ, আসগর আলী, লোকমান ও হাকিম নামের কয়েকজন। তারা মূলত ফুটপাতে হকার টিকিয়ে রাখতে পুলিশের সাথে সমঝোতা ও নেতার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করেন। ডাক দিলেই ব্যাপক লোকজন নিয়ে মিটিং-মিছিলে উপস্থিত হওয়ার সক্ষমতা রয়েছে তাদের। তাই এসব কথিত হকার নেতাদের রাজনীতির মাঠে বেশ কদরও রয়েছে।
হকারদের শৃঙ্খলা ফেরাতে সিটি করপোরেশন যত উদ্যোগ: হকারদের মাঝে শৃঙ্খলা ফেরাতে সিটি করপোরেশন বেশ কয়েকবার উদ্যোগী হয়েছে। সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন হকারদের তালিকা ও পরিচয়পত্রের উদ্যোগ দিয়েছিলেন। আংশিক তালিকা হলেও পুরো নগরে ছড়িয়ে থাকা হকারদের তালিকা করতে পারেনি করপোরেশন। একইসাথে তিনি বিকাল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত হকার বসার সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। করোনাকালে সে সময় কমিয়ে বিকাল ৩টা থেকে রাত ৮টা করেছেন সাবেক চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন। মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা ও পরিচ্ছন্ন বিভাগের কর্মী দিয়ে অভিযান, স্ট্রাইকিং ফোর্স গঠন করার উদ্যোগ নিয়েছেন। তবুও স্থায়ীভাবে কোনো সমাধানের পথ উন্মোচিত হয়নি।

স্থায়ী সমাধান কি হতে পারে : হকার সমস্যা নিয়ে চিন্তা করেন এমন বেশ কয়েকজনের সাথে কথা হয়। তাদের মতে মান্ধাতা আমলের হকার পুনর্বাসন বা হকার মার্কেট করে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। কেননা দেশের অনেক জায়গায় হকার মার্কেট করা হয়েছে, কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি। তা ছাড়া হকার অধ্যুষিত এলাকায় মার্কেট করার মত জায়গা ও পরিস্থিতি নেই। তাই হকার সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন জাতীয় নীতিমালা। যেখানে হকাররা কিভাবে বসবে এবং কিভাবে পরিচালিত হবে তা নির্ধারণ করা হবে। এ আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তি প্রদানের বিধান থাকবে। নির্দিষ্ট একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা হকারদের নিয়ন্ত্রণ করবে।