প্রয়োজন মনে করেন না ৯৩ শতাংশ ভবন মালিক

74

নগরীতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নির্মিত প্রায় তিন লাখ ভবনের মধ্যে দুই লাখ ৯০ হাজার ভবনই রয়েছে অগ্নি-দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে। তার মানে, ৯৭ শতাংশ ভবনই রয়েছে আগুনের ঝুঁকিতে। এর মধ্যে ৯৩ শতাংশ ভবনের মালিক মনেই করেন না তাদের স্থাপনায় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকার প্রয়োজন আছে। মাত্র ৩ শতাংশ ভবন অগ্নিপ্রতিরোধ আইন মেনে নির্মাণ করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স কিংবা দমকল বাহিনীর এক পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে নগরীতে সম্ভাব্য অগ্নি-দুর্ঘটনার ঝুঁকির ভয়াবহ এই চিত্র।
এদিকে, সর্বশেষ গত বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে তৈরি করা দমকল বাহিনীর প্রতিবেদন অনুযায়ী নগরীতে নির্মিত তিন লাখ স্থাপনার জন্য ফায়ার স্টেশন রয়েছে সবমিলিয়ে দশটি। আবার এসব স্টেশনের মধ্যে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে অগ্নিকবলিত সর্বোচ্চ ১৮ তলা ভবনের আগুন নির্বাপনে চেষ্টা চালানোর মত সক্ষমতা আছে শুধুমাত্র একটি স্টেশনের। বাকিগুলোর সক্ষমতা আছে সর্বোচ্চ ছয় তলা পর্যন্ত। নগরবিদরা বলছেন, অগ্নি-দুর্ঘটনাজনিত ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে নগরীর জানমাল রক্ষা করতে হলে পরিকল্পিতভাবে সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়ার এখনই সময়। এক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ছাড়াও বিদ্যুৎ বিভাগ, সিডিএ, সিটি কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন ও তদারককারী প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত পদক্ষেপই অগ্নি-দুর্ঘটনার ঝুঁকি হ্রাসের মাধ্যমে নিরাপদ নগরী গড়তে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
দমকল সূত্র জানায়, ১১৭ টি ভবন নিয়ে নগরীতে গড়ে উঠেছে ভোগ্য, পোশাক ও প্রসাধনী পণ্যের বৃহত্তম পাইকারি ও খুচরা বাজার রেয়াজউদ্দিন বাজার। বাজারের ব্যবসায়ী এবং কর্মচারীদের সংগঠনগুলোর তালিকা অনুযায়ী এই বাজারে দোকান ঘর রয়েছে প্রায় ৮০ হাজার। এর বাইরে বিভিন্ন ধরণের পণ্যের দোকান, গুদাম এমনকি আবাসিক ভবনও রয়েছে ঐতিহ্যবাহী এ বাজারে। কিন্তু অগ্নি নির্বাপণের কোনও ব্যবস্থাই নেই। বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনগুলো এমন ঝুঁকিপর্ণূভাবে টানা হয়েছে যে ‘চক্ষু ছানাবড়া’ হওয়ার জোগাড়। বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই মৃত্যুপুরীতে দিন রাত পার করছেন তারা। শুধু রেয়াজউদ্দিন বাজার নয়। টেরিবাজার, খাতুনগঞ্জ, আসাদগঞ্জ, চাক্তাই, জহুর আহমেদ হকার মার্কেটসহ নগরীর ৪১ টি মার্কেটের কোনওটিতেই নেই আগুন নেভানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা।
অগ্নি প্রতিরোধ বিশেষজ্ঞ এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, অসাবধানতা এবং অসচেতনতার কারণেই অগ্নিকান্ডের ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা কিংবা হ্রাস করা যাচ্ছে না। ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও অগ্নিনির্বাপন মহড়াসহ সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচির পরও এক্ষেত্রে কাঙ্খিত ফল অর্জিত হচ্ছে না। এছাড়া, অগ্নিপ্রতিরোধ ও অগ্নিনির্বাপণ আইন-২০০৩ এর পর সরকার সর্বশেষ ২০১৪ সালে অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ বিধিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ছাড়পত্র নেয়া বাধ্যতামূলক করলেও বিধিমালার অনেক ধারাই বাস্তবে উপেক্ষিত থাকছে।
নগর পরিকল্পনাবিদ শাহীনুল ইসলাম খান মনে করেন ভবন মালিকদের অবহেলা ও উদাসীনতার পাশাপাশি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলো দায়িত্বহীনতা নগরীতে অগ্নি-দুর্ঘটনার ঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিল্ডিং কোড মেনে ভবন তৈরির পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট তদারকি সংস্থাগুলোর এখনই এ বিষয়ে সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘অসাবধানতাই অগ্নিকান্ডের প্রধান কারণ। আমরা অভ্যাসগত কারণেই অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি তৈরি করে রাখি। এছাড়া, ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিধিমালা অনুসরণ করা হয় না। যে কারণে অগ্নিকান্ড সংঘটিত হলেও তা নির্বাপণে ফায়ার কর্মীদের বেগ পেতে হয়। ফায়ার সনদ নিলেও নির্দেশনা অনুসরণে অভ্যস্থ হচ্ছে না সাধারণ মানুষ। একইভাবে অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম সংরক্ষণ করলেও প্রয়োজনীয় মুহূর্তে তা ব্যবহার করা হয় না। ভবন নির্মাণে ত্রæটি থাকায় কোনো কোনো সময় প্রাণহানি বেশি ঘটে। বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ও ভবনের ভেতরে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাও ত্রæটিমুক্ত নয়। যে কারণে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট অগ্নিকান্ডের অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে পাওয়া যায়। নগরে নির্বিচারে জলাশয় ভরাটের কারণে অগ্নি নির্বাপণে পানি সংকটে ভুগতে হয়। এক্ষেত্রে, সকলে নির্দেশনাগুলো মেনে সাবধানতা অবলম্বন করলে অগ্নিদুর্ঘটনা অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভব’।
সচেতনতা ও সতর্কতামূলক নির্দেশনা
অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ বিধিমালায় অসাবধানতাই অগ্নিকান্ডের প্রধান কারণ বলে উল্লেখ করে অগ্নিপ্রতিরোধ ব্যবস্থায় বেশকিছু নির্দেশনা মেনে চলতে বলা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে রান্নার পর চুলার আগুন নিভিয়ে রাখা, বিড়ি বা সিগারেটের জ্বলন্ত অংশ নিভিয়ে নিরাপদ স্থানে ফেলা, ছোট ছেলে-মেয়েদের আগুন নিয়ে খেলা থেকে বিরত রাখা, খোলা বাতির ব্যবহার বন্ধ রাখা, ক্রটিযুক্ত বৈদ্যুতিক তার ও সরঞ্জাম ব্যবহার না করা, হাতের কাছে সব সময় দুই বালতি পানি বা বালু রাখা, ঘরবাড়ি-অফিস আদালত ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সার্বক্ষণিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, বাসগৃহ, কলকারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নি নির্বাপণী যন্ত্রপাতি স্থাপন করা এবং মাঝে মাঝে তা পরীক্ষা করা, প্রতিটি শিল্প-কারখানায় ও সরকারি-বেসরকারি ভবনে ফায়ার সার্ভিস অধ্যাদেশ অনুযায়ী অগ্নিপ্রতিরোধ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা, কল-কারখানার কাছে পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা রাখা, গুদাম বা কারখানায় ধূমপান নিষিদ্ধকরণ ও সতর্কীকরণ পোস্টার লাগানো, স্থানীয় ফায়ার স্টেশনের টেলিফোন নম্বর সংরক্ষণ ও ফায়ার সার্ভিস থেকে অগ্নি-প্রতিরোধ ও নির্বাপণ বিষয়ে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা, অগ্নি সচেতনতা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করা, স্থানীয়ভাবে অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণের লক্ষ্যে স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গড়ে তোলা ইত্যাদি।