প্রত্যাবাসন সোনার হরিণ!

20

তুষার দেব

মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নির্যাতন ও গণহত্যার মুখে বাস্তুচ্যুত হয়ে সীমান্ত পেরিয়ে দেশের কক্সবাজার জেলার শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন যেন সোনার হরিণে পরিণত হয়েছে। রোহিঙ্গা ঢলের বিগত পাঁচ বছরে তাদেরকে নিজভূমে ফিরিয়ে নেয়ার কাজে দৃশ্যমান কোনও অগ্রগতিই হয়নি। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো ক্যাম্পে শরণার্থীদের দেখভাল করে যেতে যতটা আগ্রহী, তাদের প্রত্যাবাসন কার্যক্রম নিয়ে ততটাই উদাসীন। এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রকাশ্যে ও গোপনে সশস্ত্র সংগঠনের তৎপরতা বাড়ছে। আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে ঘটছে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত। শরণার্থী ক্যাম্প ও ক্যাম্পের বাইরে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা।
সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায় থেকে বলা হয়েছে, মানবিক কারণে আশ্রিত রোহিঙ্গারা এখন বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভৌগলিক অবস্থানসহ নানা প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ধীরে ধীরে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। এ সঙ্কটের উৎস মিয়ানমারে। তাই সমাধানও রয়েছে সেখানেই। বাংলাদেশ কেবলই ভুক্তভোগী। শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনই হচ্ছে রোহিঙ্গা সঙ্কটের একমাত্র ও শান্তিপূর্ণ সমাধান। তবে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে শরণার্থীদের মৌলিক অধিকার রক্ষা করা নিয়ে যতটা তৎপর থাকতে দেখা যায়, রোহিঙ্গা পুনর্বাসন ও প্রত্যাবাসন প্রশ্নে তারা রহস্যজনকভাবে নির্লিপ্তই থাকছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর অব্যাহত হামলার মুখে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় লাখ লাখ রোহিঙ্গা। এরপর থেকে রোহিঙ্গাদের দেখাশোনা করছে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন। এর মধ্যে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে বর্তমানে ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। এর বাইরে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা। শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে ক্যাম্প ইনচার্জ হিসেবে একজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তা ও আইনশৃংখলা রক্ষার জন্য তিন ব্যাটালিয়ন আর্মড পুলিশ বা এপিবিএন সদস্যদের নিযুক্ত করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, প্রতিদিন শরণার্থী ক্যাম্প থেকে শত শত রোহিঙ্গা বাইরে বেরিয়ে এসে কক্সবাজার জেলার স্থানীয় লোকজনের সাথে মিশে যাচ্ছে। তাদের অনেকেই কক্সবাজার অঞ্চলে মাটি কাটার কাজ, প্যাডেল রিকশা, টমটম, সিএনজি অটোরিকশা চালানো ও সাগরে মাছ ধরার ট্রলারের শ্রমিকের কাজ করছে। আবার অনেকে মাদক পাচার, ডাকাতি, ছিনতাই খুনোখুনির মত অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে। রোহিঙ্গা অপরাধমূলক কর্মকান্ড উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাদের অনেকে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র পর্যন্ত বানিয়ে ফেলছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা নানা অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে তাদের সুনির্দিষ্ট কোনও পরিচয়পত্র বা ফিঙ্গারপ্রিট নেই। তাই ভয়ঙ্কর অপরাধ করলেও তাদের শনাক্ত করা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে একপ্রকার কঠিন। অথচ তারা শরণার্থী হিসেবে ক্যাম্পে সমস্ত সুযোগ-সুবিধাও ভোগ করছে।
কক্সবাজার নাগরিক আন্দোলনের সদস্যসচিব এইচ এম নজরুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজার অঞ্চলের লোকরাই এখন নিজভূমে পরবাসী হওয়ার উপক্রম হয়েছে। প্রত্যাবাসনের মধ্যেই রোহিঙ্গা সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ সমাধান নিহিত। কিন্তু গত পাঁচ বছরে প্রত্যাবাসন নিয়ে দৃশ্যমান কোনও অগ্রগতিই পরিলক্ষিত হয়নি। উল্টো দিন দিন সেটা যেন জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে।
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মো. এমদাদুল ইসলাম পূর্বদেশকে বলেন, আসলে শরণার্থীদের লালন-পালন করাই তো অনেক বিদেশি সংস্থার ব্যবসা হয়ে গেছে। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগণের নিজভূমে টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের মাধ্যমেই কেবল এ সঙ্কটের স্থায়ী সমাধান হতে পারে। এটাই বাস্তবতা। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিগত পাঁচ বছরে উল্লেখ করার মত কোনও ভূমিকাই পালন করেনি। বিশ্বজুড়ে শরণার্থী সমস্যার উদ্ভব হলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও বেসরকারি সংগঠনগুলোর কাছে চাকরি, বেতন-ভাতা, ব্যবসা বেশি প্রাধান্য পেয়ে থাকে। তেমনি শরণার্থী সমস্যার সমাধানে তাদের নির্লিপ্ততাও সমানভাবে দৃশ্যমান।