পোড়া চিনির বর্জ্য কর্ণফুলী নদীর জলজ জীব-বৈচিত্র্যের জন্য হুমকি

6

মোহাম্মদ মঞ্জুরুল আলম চৌধুরী

সোমবার ৪ মার্চ বিকাল ৩টা ৫৩ মিনিটে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানা এলাকার এস আলম সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ চিনিকলে আগুন লাগে। অবশেষে ৬ দিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে অগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে। আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, সেনাবাহিনী ও কোস্টগার্ড। সাধারণত আমাদের দেশে নদীর পাড়ে যত ধরনের বাণিজ্যিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে সেগুলি কোনো ধরনের প্রোটেকশন বা দূষিত বর্জ্য যথাযথভাবে পরিশোধন না করেই তা সরাসরি বিভিন্ন নদীতে ফেলে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী এবং মৎস্য ভান্ডার হালদা নদীও এর ব্যতিক্রম নয়।তবে জোয়ার–ভাটার নদী হওয়ায় কিছুটা রক্ষা। দুঃখজনক বিষয়, ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফার জন্য খরচ বাঁচাতে দেশের জীব ও জলজ-জীব বৈচিত্র্য, প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রতিবেসের ওপর নির্দয় নিষ্ঠুর আচরণ করেই চলেছে।পাশাপাশি দেশের তদারককারি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর অবহেলা গাফিলতিও সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। পত্রিকায় প্রকাশিত বিবরণ থেকে জানা যায়, এস আলম রিফাইন্ড সুগারের চিনির কাঁচামালের আগুনে পোড়া বর্জ্য কারখানার ড্রেন দিয়ে পড়ছে কর্ণফুলী নদীতে।বর্জ্যের কারণে এ এলাকায় নদীর পানি লাল নীল বর্ণ ধারণ করেছে। এতে করে পরিবেশ দূষণের আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।একটি গুদামে থাকা অপরিশোধিত চিনি পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগুন লাগা গুদামটিতে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না। ঘটনাস্থলে থাকা বান্দরবান ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক পূর্ণ চন্দ্র মুৎসুদ্দি বলেন, গুদামে যে পরিমাণ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকার কথা ছিল, এখানে তা নেই।যে কারণে আগুন লাগার পর নেভানো সম্ভব হয়নি। ‘বিডিনিউজ জানায়, এস আলম সুগার রিফাইন্ডে আগুনে পোড়া গুদাম থেকে গলে যাওয়া অপরিশোধিত চিনি গিয়ে পড়ছে পাশের কর্ণফুলী নদীতে।একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, বেশিমাত্রায় পোড়া চিনি নদীতে মিশে গেলে দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব পড়তে পারে।সে কারণে পোড়া বর্জ্যগুলো সরাসরি নদীতে পড়া ঠেকানো দরকার।তবে এস আলম গ্রæপের কর্মকর্তারা বলছেন, অপরিশোধিত চিনির বর্জ্যে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না’ (সূত্র: দৈনিক আজাদী, ৬ মার্চ ’২৪)। এস আলম গ্রুপের কর্মকর্তার বলা কথাটি আদৌও সত্য নয়। কেননা সুগার মিলের পোড়া চিনির কারণে কর্ণফুলী নদী আজ ভয়াবহ রকমের বিপর্যয়ের মুখ পড়েছে। পতেঙ্গার কাছাকাছি থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত পুরো নদীই মূলত দূষিত হয়ে পড়েছে। সংঘটিত অগ্নিকান্ডের ঘটনার জেরে আগুনে পোড়া চিনি ও ক্যামিকেলের হাজার হাজার লিটার তামাটে বর্ণের বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে ফেলায় তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। পুরো এলাকা ভরে গেছে দুর্গন্ধে।অনেকটা গুড় পোড়া গন্ধের মতো চারদিকের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। নদীর পানিতে পোড়া তেল ও ফেনার মতো চিনির বর্জ্য ভাসছে।বর্জ্যের করুণ শিকার হওয়া কর্ণফুলীর মাছসহ প্রাণীকুল মারাত্মক রকমের অক্সিজেন স্বল্পতায় ধুকে ধুকে মরতে শুরু করেছে। মরা মাছ ভাসতে দেখা যায়। আবার বহু মাছ অসুস্থ হয়ে ভাসতে থাকে। জ্যান্ত মাছগুলো হাত দিয়ে ধরা যাচ্ছিল। স্থানীয় শত শত মানুষ এসব মাছ ধরতে শুরু করে। মৎস্য অধিদপ্তর জানায়, বিভিন্ন প্রজাতির মাছ,কাঁকড়াসহ প্রায় এগার প্রজাতির মাছ ব্যাপকভাবে মারা পড়েছে।
নদী গবেষক অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়ার বিশ্লেষণ খুবই প্রণিধানযোগ্য, তিনি জানান, শুধু মাছ নয়, যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাতে কোন জলজপ্রাণীই সেখানে থাকতে পারছে না।কাঁটাজাতীয় মাছ যেগুলো খুবই স্বল্প অঙিজেনে থাকতে পারে সেগুলোও ভেসে উঠছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পোড়া চিনির যে দ্রবণ নদীতে ফেলা হচ্ছে তাতে পানির অঙিজেনের পরিমাণ শূন্য হয়ে যাচ্ছে। যা জীববৈচিত্র্যের বেঁচে থাকার পথে বড় ধরনের অন্তরায়।তিনি বলেন, নদীর পানিতে কেমিকেল পড়ার কারণে পানি ঘোলা হয়ে গেছে।এতে পানিতে অঙিজেন উৎপাদনের যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া তাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বর্জ্যরে কারণে নদীর পানিতে একটি সেপটিক পরিবেশ তৈরি করেছে বলে মন্তব্য করে অধ্যাপক মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, এই আবহে কোন জলজ প্রাণী বেঁচে থাকতে পারবে না। তবে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আর যদি বর্জ্য ফেলা না হয় তাহলে প্রতিদিনের দুবারের জোয়ার ভাটার কারণে পরিস্থিতি কয়েকদিনের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে যাবে।তবে এলাকার মাটি ও নদী দূষিত হওয়ার আশঙ্কা পরিবেশ অধিদপ্তরের।যা জাতির জন্য ভয়াবহ দুর্যোগ দুর্ভোগ ভোগান্তি এবং পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতির কারণ। ‘এদিকে এস আলম গ্রæপের একজন কর্মকর্তা নদীতে কিছু বর্জ্য পড়ার কথা স্বীকার করে বলেন, আমরা আগুন নিভানোর কাজে ব্যস্ত। যাতে অন্যান্য গুদামে আগুন ছড়িয়ে না পড়ে।তিনি বলেন, এটি একটি বড় ধরণের দুর্ঘটনা।এই ধরণের ঘটনার জন্য আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমাদের ৩০টি ডাম্পট্রাক রাতে দিনে গলিত র’সুগার আমাদের নিজস্ব জায়গায় ডাম্পিং করছে।বর্জ্য যাতে নদীতে না পড়ে সে জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। এর পরও ফায়ার সার্ভিসের ছিটানো কিছু পানি গড়িয়ে নদীতে পড়েছে। এতে আমাদের দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেন’ {সূত্রঃ দৈ/আজাদী, ৭ মার্চ, ২০২৪}।
কর্তৃপক্ষ দুঃখ প্রকাশ করার পাশাপাশি আত্ম-পক্ষ সমর্থনে ফায়ার সার্ভিসের ছিটানো কিছু পানি গড়িয়ে নদীতে পড়ছে বলে অসত্য তথ্য প্রদান করেছেন। কেননা, ‘সেখানে কথা হয় এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের এক শ্রমিকের সঙ্গে।তিনি ১২ বছর ধরে এ কারখানায় কাজ করেন।নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, আগুন লাগার পর যে কালো পানিটা বের হচ্ছে, সেটা এখানে নদীতে ছাড়া হচ্ছে।অন্য সময়ও চিনি তৈরির পর যে ময়লা অবশিষ্ট থাকে সেগুলো এ নালা দিয়ে নদীতে ফেলা হয়।নালাটা করা হইছে ময়লা নদীতে ফেলার জন্য’ {সূত্রঃ দৈ/আজাদী,৬ মার্চ, ২০}। অথচ শিল্প কারখানার বর্জ্য পরিশোধনের সুনির্দিষ্ট আইন আছে।আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কতিপয় বিবেক বিবর্জিত অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে বাণিজ্যিক, শিল্প-কারখানা এবং ক্লিনিক ও হাসপাতালের অপরিশোধিত বিষাক্ত বর্জ্য দেশের প্রকৃতি পরিবেশ জীব জন্তু জলজ প্রাণি এবং মানবদেহের জন্যে বিরাট হুমকি। এবং দেশের জন্যে অশনি সঙ্কেত। দুঃখের বিষয়, অল্প বয়সেই মানুষ বিভিন্ন জটিল অনিরাময়যোগ্য এবং ব্যায়বহুল রোগ ব্যাধিতে ভুগছে। পাশাপাশি পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. কামরুল হাসান বলেন, ‘পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে এস আলম গ্রুপের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, নদীতে বর্জ্য ফেলা বন্ধ করার জন্য বলা হয়েছে বর্জ্য বালি দিয়ে চাপা দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তারা সেটা করবে বলে আশ্বস্ত করেছে’।
ইনস্যুরেন্স ক্লেইম এবং চিনির দাম বাড়িয়ে শিল্প প্রতিষ্ঠানটি তাঁদের আর্থিক এবং অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নেবেন তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। জাতির কাছে তাঁরা দুঃখ প্রকাশ করেছে, ভালো কথা। অগ্নি নির্বাপণের জন্য কর্তৃপক্ষ যথাযথ এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না রেখে যে অবহেলা গফিলতি করেছে তার মাশুল কে দেবে। এ-কথা অনস্বীকার্য এবং দিবালোকের মতো সত্য যে, তারা শাস্তিযোগ্য এবং দন্ডনীয় অপরাধ করেছেন। পাশাপাশি জাতির প্রকৃতি পরিবেশ প্রতিবেশ জীব এবং জলজ জীব বৈচিত্রের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তা কিভাবে পূরণ হবে তা আমাদের বোধগম্য নয়। দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি, প্রকৃতির বিরূপ রুদ্র আচরণসহ বহুমাত্রিক সংকটে নিপতিত। একটা জোয়ার ভাটার প্রবাহমান নদী আজ তাঁদের অপরিণামদর্শী কর্মকান্ডের জন্যে অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। যেসমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতি অবহেলা গাফিলতির জন্যে দেশের আর্থিক এবং সার্বিক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে সেসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিন্তিত করে তাঁদেরকে ক্ষতিপূরণ এবং শাস্তির আওতায় আনা উচিৎ। অগ্নি গ্নিদুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনাগুলোর মূলে রয়েছে যথাযথ জন-নিরাপত্তা ব্যবস্থা না রাখা। তদারককারি সংস্থাগুলোর দুর্নীতি অবহেলা গাফিলতি নজরদারী এবং সমন্বয়ের অভাব প্রকটভাবে দৃশ্যমান। সরকারদেশের সার্বিক উন্নয়ন কর্মকাÐে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। কিন্তু কতিপয় লুটেরা দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীদের কারণে দেশের অনেক অর্জন আজ ¤øান হতে চলেছে। দেশ এবং জাতির বৃহত্তর স্বার্থে রাষ্ট্রকে এসব বিষয় কঠোর নির্মোহ এবং শক্ত হাতে দমন করতে হবে। দেশকে বাঁচাতে ব্যবসায়ীদের লোভ লালসার লাগাম টেনে ধরার কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: প্রাবন্ধিক