পাখির ডানায় ভাষার গান

4

রুনা তাসমিনা

মা, বসন্তকাল এসে গেছে?
মৌলির প্রশ্নে মা হেসে দেয়। একটু ভালোও লাগে। আজকালকার ছেলেমেয়েরা ঋতু চেনেই না। কিন্তু বইমেলায় ঘুরতে গিয়ে এই প্রশ্ন শুনে মা জানতে চায়,
কেন মৌ?
দেখো, সবার মাথায় ফুলের রিং। হাতে ফুল। টিচার বলেছে বসন্তকাল ঋতুর রাজা। অনেকরকম ফুল ফোটে। গাছে গাছে নতুন পাতা হয়। কোকিলের গান শোনা যায়। কিন্তু এই বড় বড় গাছে আমি তো নতুন পাতা দেখছি না! কোকিলের গান শোনা যায় না। শুধু ফুলেরটা মিল আছে।
বইমেলায় তারা বইয়ের স্টল ঘুরে দেখছে।
বাংলা একাডেমির একুশের বইমেলায় গেছে তারা। মৌলি বই পড়তে পছন্দ করে। সে পছন্দের বই কিনতে এসেছে। শিশু কর্ণারে বইয়ের স্টলগুলো সেজেছে খুব সুন্দর করে। নানারকম বই সেখানে। কিন্তু মৌলি আজ বইয়ের চেয়ে মানুষকে খেয়াল করছে বেশি। গেটে ঢোকার মুখেও নানারকম ফুলের দোকান। আজ তেরো ফেব্রæয়ারি। বসন্তের প্রথম দিন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে মা বললো,
মৌলি, চলো আজ বাসায় ফিরে যাই। বই কিনতে আরেকদিন আসবো। কেমন?
অন্যসময় জেদ করতো। কিন্তু আজ মৌলি বললো, আচ্ছা। কিন্তু আমাকে ফুল কিনে দিতে হবে।
বাসায় ফেরার জন্য রিক্সায় উঠলো দু’জন। মৌলি ফুলের রিংটা কখনো মাথায় পরছে। কখনো হাতে নিয়ে ফুলগুলো দেখছে।
মৌলি, তুমি বসন্ত দেখবে?
মা’র কথা শুনে মৌলি অবাক! চশমা পরা চোখ দু’টো বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে মা’র দিকে।
বসন্ত দেখা যায়!
মা হেসে দিলো। বললো,
দেখি না, দেখা যায় কি-না।
বই পড়ে পড়ে মৌলির বুদ্ধি বেশ ভালো হয়েছে। বুঝলো মা কিছু একটা করবে।
দু’দিন পর। ইশকুল থেকে আসতেই মা বললো ঝটপট তৈরি হতে হবে মৌ।
কোথায় যাচ্ছি মা? এখন এতো কথা বলার সময় নেই। আমাদের ট্রেন রাত এগারোটায়।
মা খুব ব্যস্ত। জিগ্যেস করার সুযোগ নেই কোথায় যাচ্ছে। রাত এগারোটায় ট্রেন ছাড়লো বটতলী স্টেশন থেকে। টুকটুক করে হেঁটে চলে গেছে শীত বুড়ি। কিন্তু এখনো তার কুয়াশা চাদরে ঢেকে থাকে রাস্তার বাতি। ট্রেন চলছে ঝিকঝিক শব্দে। ঘুম পরি চুপ করে এসে বসে গেলো মৌলির চোখে।
ট্রেন থেকে নামতেই ম্যাজিক হয়ে গেলো! নানাভাই একদম সামনে দাঁড়িয়ে! সবকিছু স্বপ্নের মতো হচ্ছে। মা হঠাৎ কেন নানুর বাড়ি আসলো কিছুই বুঝতে পারছে না। নানাভাই মৌলিকে গাড়িতে তুলে নিয়ে বললেন,
সবকিছু অবাক লাগছে। তাই না মৌ?
এবার হেসে দিলো মৌলি। বললো,
মা সারপ্রাইজ দিয়েছে। ওর কথা শুনে মা আর নানা ভাই দু’জনেই হেসে দিলো।
নানুর বাড়ি হিজলতলী গ্রাম। এখানে নদী আছে। চারদিকে নানারকম গাছ। উঠোনে লাগানো বেনু খালামনির গাছে কতোরকম ফুল! ভোরের শিশির মেখে ঘাসগুলো চিকমিক করছে রোদ গায়ে দিয়ে। ফুলগুলো দুলে দুলে যেনো মৌলিকে বলছে, এসো, এসো।
বিকেলে মা’র সঙ্গে ঘুরতে গেলো নদীর পাড়ে।
মৌলি, দেখতে পাচ্ছো নতুন নতুন পাতা?
আসলেই তো! কচি পাতাগুলো ঝিরিঝিরি করে হাসছে বাতাসের সঙ্গে। দেখতে ভারী সুন্দর লাগছে। নদীর পানিতে ছোটো ছোটো ঢেউ।
মা, কী সুন্দর! আর বর্ষাকালে কী পচা! শুধু কাদা আর কাদা। নদীর পানি ঘোলা।
মা বললো,
এটিই তোমাকে দেখাতে নিয়ে এসেছি। শহরে ঋতু বোঝা যায় না। এখন দেখছো, গাছে গাছে নতুন পাতা। ওই যে লাল ফুলের পলাশ গাছ! দেখেছো? মৌলি ছোট্ট নদীর ওপারে দেখতে পায় লাল ফুলের সারি।আরও কতো ফুল!
হ্যাঁ মা, বেনু খালামনির বাগানেও অনেক ফুল!
আমি দু’টো ঋতু চিনেছি! আনন্দে চিকচিক করছে মৌলির মুখ।
এবার বলো তো তোমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছি?
বসন্তকাল দেখাতে। মৌলির চটপট উত্তর।
সেটাও ঠিক আছে। আরো একটি কারণ আছে। তুমি যে বইগুলো পড়ছো ওগুলো এখন আরো ভালোভাবে বুঝতে পারবে। তখন পড়তে আরো মজা! নদীতে সূর্যটা সোনালি রঙ ঢেলে দিয়েছে। দূরের গ্রাম থেকে সন্ধ্যার ছায়া ছুটে আসছে। ওরাও ঘরে ফিরে এলো।

নানুর বাড়ির ভোরবেলাটা এখনো শীতের মতো। গাছের পাতায় পাতায় রোদ লুকোচুরি খেলে। দুপুরটা বাইরে ঝিম মেরে থাকলেও ঘরের ভেতর চলে হৈ হুল্লোড়। হঠাৎ হঠাৎ শোনা যায়। কী মজা! দু’দিন কেটে যায় দেখতে দেখতে। কুয়াশার চাদর পরে বিকেল নামে। পাখির ডানায় ভাষার গান। মৌলি প্রথমবার গ্রামের ইশকুলের একুশে ফেব্রুয়ারি দেখে। প্রভাত ফেরিতে যায়। বাইশ তারিখ ফেরার পালা। নানাভাই এগিয়ে দেন ট্রেন পর্যন্ত। ট্রেনে বসতে না বসতেই সূর্যটা টুপ করে ডুব দেয় আকাশের ওপারে।