পদ্মাসেতু-অর্থনীতির নতুন চালিকাশক্তি

23

 

স্বপ্নের পদ্মাসেতু এখন বাস্তব। আমাদের পদ্মাসেতু দেশে বিদেশে একটি আলোচিত ইস্যু। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পদ্মা সেতু অবশেষে চালু হতে যাচ্ছে। দেশের এত বড় একটি মেগা প্রজেক্টের বাস্তবায়ন মানে বিশাল এক অর্জন এবং এ সেতুর সাথে বাংলাদেশের মানুষের আবেগ জড়িত রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দৃঢ় মনোবল ও সাহসী নেতৃত্বের সোনালি ফসল পদ্মা সেতু। দেশের আরো অনেক মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়িত হচ্ছে, কিন্তু পদ্মাসেতুর বিষয়টি একেবারে ভিন্ন। শুরুতেই নানা মহল থেকে পদ্মা সেতু নিয়ে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। সে ধারাবাহিকতায় দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক তার সাথে করা ঋণচুক্তি বাতিল করে। দুর্নীতির অভিযোগে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন পদত্যাগ করেন। এমন এক পরিস্থিতিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। তখন দেশ বিদেশের অনেক বড় বড় ব্যক্তিরাও তাঁর ঘোষণাকে একটি অসম্ভব কল্পনা বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এই একটি প্রতিশ্রুতি শুধু প্রতিশ্রুতিই নয়, একটি সম্ভাবনা, দেশ এবং জাতির দীর্ঘ অপেক্ষা। স্বপ্নের পদ্মাসেতু এখন আর স্বপ্ন নয় বরং বাস্তব। দেশের ইতিহাসে অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে এই সেতু অন্যরকম এক মেগা প্রজেক্ট। সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো হলো পদ্মা সেতু। এটি আমাদের আত্মগৌরবের জায়গাটিকে মজবুত ভিত্তি দিয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে বাংলাদেশ তার আত্মবিশ্বাস ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে নির্মাণ করেছে পদ্মা বহুমুখী সেতু। ২০০১ সালের ৪ জুলাই মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১২ সালের ৪ জুলাই সংসদে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নদী নির্ভর আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা বহু বছর ধরে। স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে সড়ক যোগাযোগের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। এক্ষেত্রেও বাধা ছিল অসংখ্য নদ-নদী। যে কোনো সড়ক তৈরি করতে গেলেই এখানে ছোট-বড় নদী অতিক্রম করতে হয়। এক সময় অনেক ফেরি চালু ছিল। পদ্মার ফেরির সাথে আছে মানুষের অনেক দুঃখ-বেদনার ইতিহাস। বহু প্রতীক্ষিত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যোগাযোগের সুবিধার জন্যই স্বপ্নের পদ্মা সেতু। ৭ ডিসেম্বর ২০১৪ সালে পদ্মার ওপর সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করে বাংলাদেশ। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মাসেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ১৮ দশমিক ১০ মিটার। দ্বিতল এই সেতুর এক অংশ মুন্সিগঞ্জের মাওয়া এবং অপর অংশ শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে যুক্ত। নির্মাণে মোট ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। সেতুর নির্মাণ কাজে মোট জনবল ছিল প্রায় ৪০০০। পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য অধিগ্রহণকৃত মোট জমির পরিমাণ প্রায় ৯১৮ হেক্টর। অনেক চিন্তা ভাবনা করে প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল। বিশ্বের সবচাইতে গভীরতম পাইলিং এর সেতু পদ্মাসেতু। বিশ্বের অন্যতম খর স্রোতা নদী পদ্মাতে এ সেতু নির্মাণে অনেক আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটানো হয়েছে। এ সেতু বিশ্বের বিস্ময়। একই সঙ্গে রেল ও গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা রয়েছে এ সেতুতে। এ সেতু সর্ম্পকে এ সেতুর সাথে সংশ্লিষ্ট দেশের প্রখ্যাত প্রযুক্তিবিদ প্রয়াত ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী তাঁর এক লেখনীতে বলেছিলেন, ‘কেন দোতলা সেতু হবে? এর সুবিধাই বা কী? আমরা ভবিষ্যতের কথা ভেবেছি। এ পথটি ট্রান্স-এশীয় রেলপথের অংশ হবে। তখন যাত্রীবাহী ট্রেন যত চলবে, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি চলবে মালবোঝাই ট্রেন। ডাবল কনটেইনার নিয়ে ছুটে চলবে ট্রেন। পদ্মায় নৌযান চলে অনেক এবং সেটাও বিবেচনায় রাখতে হয়েছে।’ তার কথা অনুযায়ী এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। যাত্রীবাহী ট্রেন যত চলবে, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি চলবে মালবোঝাই ট্রেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হবে মোংলা ও পায়রা বন্দর। অর্থনীতিতে যুক্ত হবে নতুন সোনালি স্বপ্ন। বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরলস প্রচেষ্টায় এই স্বপ্ন ও বাস্তবতার এক বিরল উদাহরণ। অনেকে আবদার অনুরোধ উপেক্ষা করে সেতুর নাম ‘পদ্মাসেতু’ রাখার সিদ্ধান্তও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত দূরদর্শী ও বিচক্ষণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞামূলক একটি সিদ্ধান্ত। বিশ^ব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থ বরাদ্দ করেও ঘুষ ও দুর্নীতির মতো মিথ্যা অভিযোগে তা প্রত্যাহার করার পর নিজস্ব অর্থায়নে এমন একটি সেতু নির্মাণ করার কাজ হাতে নেয়া একটি অবশ্যই চ্যালেঞ্জিং কাজ ছিল। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু তৈরি নিঃসন্দেহে এটি অনেক আনন্দ ও অনেক গৌরবের বিষয়। পদ্মাসেতু চালু হবার মাধ্যমে বদলে যাবে দেশের অর্থনীতির হিসাব নিকাশ। এ সেতু দিয়েই দক্ষিণ -পশ্চিমাঞ্চলে যাবে গ্যাস সংযোগ। যাবে বিদ্যুৎ লাইন। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে পদ্মার এ পাড়-ও পাড় একত্রিত হবে। যার ফলে দূরত্ব কমে আসবে দেশের এক অঞ্চলের সঙ্গে আরেক অঞ্চলের। বাংলাদেশের র্অথনীতির গতি বাড়বে। সচল হবে অর্থনীতির চাকা। জিডিপির হারও বাড়বে। ভাগ্য বদলে যাবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বহু জেলার মানুষের। মানুষের জীবনযাত্রার মানও বাড়বে। যানজট কমে জীবনযাত্রাও সহজতর হবে। পদ্মা সেতু চালু হলে বরিশাল পটুয়াখালীসহ অন্যান্য জেলাগুলির সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক সহজ হয়ে যাবে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে সড়ক ও রেলপথে যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে। পরিবহন খরচও অনেক কমে যাবে। সময় কম লাগবে। অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে। অনেক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এই সেতু সার্বিক অর্থনীতিসহ বিশেষ করে ঐ অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থার রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ঘিরেই একটি দেশের উন্নয়ন কর্মকাÐ আবর্তিত হয়। কৃষিপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল এবং শিল্পজাত পণ্যসামগ্রী সহজে ও স্বল্প ব্যয়ে স্থানান্তর করতে যোগাযোগ ব্যবস্থাই হলো প্রধান চালিকা শক্তি। শিল্পায়ন ও ব্যবসার প্রসারে যোগাযোগই নিয়ামত শক্তি। পদ্মা সেতু এক্ষেত্রে অর্থনীতির একটি শক্তিশালী ভিত রচনা করবে। পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের প্রথম কোনো সমন্বিত যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে উঠবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এমনিতেই কৃষিতে উন্নত। এই সেতু হয়ে গেলে তাদের কৃষিপণ্য খুব সহজেই ঢাকায় চলে আসবে। বর্তমানে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে শিল্পায়নের অবস্থা তেমন উন্নত ও যুগোপযোগী নয়। দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে বেশ পেছনেই পড়ে আছে দেশের দক্ষিণাঞ্চল। এই অঞ্চলে কৃষিপণ্য উৎপাদন হয় বটে, কিন্তু যোগাযোগ সমস্যার কারণে দরিদ্র কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছেন। পদ্মাসেতু এই পরিস্থিতির অবসান ঘটাবে। তাই আমরা বলতে পারি, পদ্মাসেতু দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকদের ভাগ্য পরিবর্তনে যেমন ভূমিকা রাখবে, অন্যদিকে কৃষকরা আরও অধিক হারে পণ্য উৎপাদন করবে। পাশাপাশি এ সেতুকে কেন্দ্র করে নতুন শিল্প-কলকারখানা গড়ে উঠবে, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে সচল রাখবে। মংলা ও পায়রা বন্দর এবং বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। পুরো দেশের অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। অর্থনীতি, শিক্ষা, বাণিজ্যÑসব ক্ষেত্রেই এই সেতুর বিশাল ভূমিকা থাকবে। বলা হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের কুয়াকাটা ও সুন্দরবন সংলগ্ন ছোট ছোট বিভিন্ন দ্বীপে মালদ্বীপের মতো পর্যটন উপযোগী করা যাবে। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, সুন্দরবন ও পায়রা বন্দরকে ঘিরে দেখা দেবে পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা। দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন চর ও দ্বীপকে কেন্দ্র করে মালদ্বীপের মতো পর্যটনের বিশাল জগৎ তৈরি করা সম্ভব। পদ্মাসেতু চালু হলে সেই সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যাবে। পদ্মাসেতুর ফলে কক্সবাজারের চেয়ে কম সময়ে সুন্দরবন ও কুয়াকাটায় পৌঁছানো সম্ভব হবে। এ জন্য অনেক দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান পটুয়াখালীর পায়রা বন্দর ও এর আশপাশে বিনিয়োগ করার আগ্রহ প্রকাশ করতে পারে। পদ্মার দুই পাড় ঘিরে সিঙ্গাপুর ও চীনের সাংহাই নগরের আদলে শহর গড়ে তোলার চিন্তা ভাবনা হচ্ছে। সেতুকে ঘিরে পর্যটনে যুক্ত হবে নতুন মাত্রা। অনেক আধুনিক মানের হোটেল মোটেল রিসোর্ট গড়ে উঠবে। অর্থনীতিবিদদের মতে, সেতুটি বাস্তবায়িত হলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২ শতাংশ বেড়ে যাবে। আর প্রতিবছর দারিদ্র্য নিরসন হবে শূন্য দশমিক ৮৪ ভাগ। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার প্রায় ৬ কোটি মানুষের ভাগ্যে পরিবর্তন করবে পদ্মা সেতু। নির্মাণাধীন এই সেতুর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের মিলন ঘটবে। ২০৩৫-৪০ সালে বাংলাদেশ যে উন্নত দেশ হবে, সেক্ষেত্রে এই সেতু নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। অর্থনীতিবিদদের ধারণা, পদ্মাসেতু চালু হলে দেশের সার্বিক দারিদ্র্যতার সূচক অনেক কমে যাবে। মানুষের আয় বাড়বে। পদ্মার দুইপাড়ে নানা স্থাপনা গড়ে উঠবে। শিল্পের বিকাশ ঘটবে। মানব উন্নয়ন সূচকেরও অনেক অগ্রগতি হবে। মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন ঘটবে। যানবাহনের এই টোল আদায়ও আমাদের জাতীয় প্রবৃদ্ধির বৃদ্ধিতে বিশাল একটি ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশ দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী এক সশস্ত্র সংগ্রামের ভেতর দিয়ে জন্ম লাভ করা একটি দেশ। এই বীর বাঙালি জাতি তার হাজার বছরের আরাধ্য ধন স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে, সে জাতি তো বীরেরই জাতি। তার অগ্রযাত্রা উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিকে রুখে দেয়ার সাধ্য কারো নেই। বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে আত্মমর্যাদাশীল একটি জাতি হিসেবে তার বিকাশে পদ্মাসেতু হবে আত্মমর্যাদা ও অর্থনীতির ভিত রচনার প্রতীক। স্বপ্নের পদ্মা সেতু হবে বাংলাদেশের মানুষের অনাগত স্বপ্ন পূরণের স্বপ্নসারথি। পদ্মা সেতুর প্রকৃত সুফল ভোগ করার অপেক্ষায় দেশের কোটি কোটি মানুষ।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বিএমসি ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম