নীল সমুদ্রে রূপালি ঢেউ

54

 

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আমি তো এমনই।
তবে আর কী? জগত জয় করে নিয়েছো।
প্রশ্নটা জয় পরাজয়ের নয়। মার্গারেটের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, তুমি বললে এ কথা কাউকে বলা যাবে? আমি বিছানা নিয়েছি, এ কথা অন্যকে বলার প্রয়োজনটা কোথায়?
মার্গারেট চাপা গলায় বললো, প্রয়োজন সেই বলছো?
বলছি।
কিন্তু এবার আমি কিছু শুনতে চাইছি। আমি তোমাদের বাড়ির প্যাটার্ন মানে বাড়ির মানুষদের সম্পর্কে কিছু জানতে চাইছি। তবে তোমার যদি কোন আপত্তি থাকে বলো না।
আপত্তি? তোমার কাছে?
শাশ্বতর বিষ্ময় ভরা ভঙ্গিমা দেখে ভেতরে ভেতরে যথেষ্টেই খুশি হলো মার্গারেট । সেই খুশির ছোঁয়ায় আরো খুশি হতে চাওয়াটাই বোধ হয় মেয়েদের মনস্তাত্তি¡ক সূ²তায় একটা মধুর কাঁপন ধরিয়ে দেয়। মার্গারেট জিজ্ঞেস করলো, কেন আমি কী?
তুমি কী সেটা আমার ভেতরেই থাক। সামান্য নেশার ফুরফুরে মেজাজে বলে যাচ্ছি বলে এটাকে আবার ভেবে বসো না। একটু আগেই তো বললাম, বাইরের শরীরটা একটু বেগড়াবাই মানে সেন্স, সত্তা সব কিছু ঠিকই থাকে। অন্তত আমার তো এমনই উপলব্ধি। সেই জায়গা থেকে বলতে পারি, মাত্র দু’ঘন্টার আলাপে যে মেয়েটা বাইরের একটা উটকে ছেলেকে বিলাসবহুল পাঁচ তারা হোটেলে এমন যত্নে, আন্তরিকতায় খাওয়ায়, সামান্য বেসামালেই তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আরও এক নিষ্ঠায় সেবা-শুশ্রুষা করে, সে কী তা আমার ভেতরই থাক। কিছু কিছু কথাকে যে লুকিয়েও রাখতে হয়।
তারপর শাশ্বত রোমশার প্রথম কথায় উত্তরে তাদের বাড়ির ছবিটা যেভাবে তুলে ধরলো সেটা এই রকম: চট্টগ্রামের পাহাড়তলির শহিদ লেনের কালীবাড়ির স্বল্প মূল্যের সেমিপাকা ভাড়া বাড়িতে সপরিবারে থাকি। বাবা মারা যাবার পর মা আমাদের চার ভাইবোন নিয়ে যখন বিধবা হলেন, সামনে তখন অন্ধকার আর অনিশ্চিত ভবিষ্যত। সম্বল বলতে বাবার অফিস থেকে লাখ খানেক টাকা।
শাশ্বত বলে, আমার মাকে আমি এক স্বার্থহীন মহীয়সী নারী বলে মনে করি। কতো কষ্ট বুকে রেখে এবং আরও কতো কষ্টে আমাদের মানুষ করছেন সে আর এক ইতিহাস। মা কাটছাঁট, সেলাই ফোঁড়াইয়ের কিছু আয় করতেন।
আমাদের মধ্যে মেজদা লেখা পড়ায় ভালো ছিলো। এজন্যই তাকে ইংলিশ স্কুলে ভর্তি করানো হলো। বড়দা ও মার উপার্জনের বেশির ভাগ অর্থই তার পড়াশোনার পিছনে খরচ করা হলো। আশা, মেজদা পাস করে বের হলে সংসারের চেহারাটা পাল্টে যাবে। কিন্তু মা-ভাইয়ের আশা নিদারুন নিরাশায় পরিণত হলো। মেঝ ভাই এখন বিরাট কোম্পানির বিরাট অফিসার। বিরাট বেতন এই শহরের অভিজাত এলাকায় বিলাস বহুল ফ্ল্যাটে থাকে। আমাদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ নাই। বড়দা আমাদের পুরো সংসারটাকে ও নিঃশ্বাসের সঙ্গেই মিশিয়ে নিয়েছে। বৌদি ও ভাইয়ের মতো আমাকে আর বোন সুতপা নিজের ছয় বছরের মেয়েটার মতোই আগলে রাখছে। আমি গোটা দুই তিন টা টিউশনি করে নিজেকে চালিয়ে আর কতোুঁকু করতে পারি?
শাশ্বত ওর বাড়ি এবং বাড়ির মানুষগুলোর মানসিকতার যে ছবিটা তুলে ধরলো এই সদ্য পরিচিত বিদেশী মেয়ের হদয়টা যথেষ্টই নাড়া খেলো। দুই দেশের জাত-পাত, ভাষা-সংস্কৃতি, ভৌগলিক দূরত্ব মুছে গিয়ে কখন যেন সবাই এক পৃথিবীর মানুষ হয়ে ওঠে। এক বাড়ির ছায়ায় পৌছে যায়।
মার্গারেট এক দৃষ্টিতে শাশ্বতর দিকে তাকিয়েই থাকে। গ্রিক সৌন্দর্যের ছেলেটা কথার যাদুকর। সাধারণ ভাষায় কতো অনায়াসেই না একটা পরিবারের হাসি-কান্না, সুখ-দু:খের দরজায় পৌছে দিয়ে তাকেও চিন্তিত করে তুললো। রোমশার মতো ধনী কন্যাটি’ধুর কে শাশ্বত আর শাশ্বতর কষ্টের ঘর-বাড়ি’ বলে মুখ ঘুরিয়ে থাকতে পারলো না। ওর ভেতরে কিছু যে একটা শুরু হয়েছে তাও নিজেও বুঝতে পারছে।
হঠাৎ-ই গম্ভীর হলো মার্গারেট, আমি আজই ঢাকার কাগজে পড়েছি ঘটনাটা। সোনার গাঁ মিউজিয়াম দেখতে গিয়ে জার্মান তরুণীকে কতিপয় দুর্বৃত্ত কর্তৃক গণধর্ষণ। এমন খবর আরো চোখে পড়েছে। কি সাংঘাতিক!
এ বাংলাদেশটায় তুমি দেখতে পাবে কী শহরে, কী গ্রামে-গঞ্জে চায়ের দোকান-সর্বত্রই প্যান্ট-শার্ট অথবা লুঙ্গি ফতোয়া পরা মানুষগুলো দেশের আর দশের সমস্যাগুলো নিয়ে কী সুন্দর আলোচনাই না করে। তুমি মুগ্ধ হয়ে ভাবতে থাকবে, আরে এরাই তো এক একজন স্বপ্নদ্রষ্টা,রাষ্ট্র নায়ক। এখানে প্রতিভা পাবে অভাবও দেখবে। সীমাহীন ভোগ বিলাস আর প্রাচুর্যেও মধ্যে দেখতে পাবে সীমাহীন দারিদ্রও। ধনী লোকে দেশ ভরে গেছে আর ধর্ষণের যে উদাহরণটা দিলে, সেই শ্রেণির মানুষ তো সবদেশেই কিছু না কিছু থাকে। কিন্তু মনে রাখতে হবে ওরাই সেই দেশের প্রকৃত ধমনী নয়। মনে রাখতে হবে, যে দেশের মাটিতে লাখো তরুণ মুক্তিযোদ্ধার কবর, যে দেশের ইতিহাসের ধাপে ধাপে তরুণের রক্তদানের দাগ, সেই দেশে দু’একটা রাজাকারের বংশধর আছে বৈকি। হ্যাঁ, এটা বেড়ে এখন সামাজিক সংকট তৈরি করছে।
বিকাল চারটা নাগাদ মার্গারেট শাশ্বতকে নিয়ে লাউঞ্জে এসে দাঁড়ালো। অল্প সময়ের মধ্যে যতোাঁ বেশি দর্শনীয় জায়গা ঘুরে দেখার আকাঙ্খায় মার্গারেট গাড়ি নিল। প্রথমেই ওরা শহীদ মিনার গেলো, সেখানে গিয়ে লজ্জায় পড়ে গেলো শাশ্বত। শহীদ মিনারের বেদীতে জুতো পায়ে তরুণতরুণীরা জোড়ায় জোড়ায় আপত্তিকর অবস্থায় বসে আড্ডা দিচ্ছে। বেদিটি অপরিষ্কার অপরিচ্ছন্ন। বাদামের ছোলা, চিপসের ঠোঙ্গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। শাশ্বত বললো, আমাদের বাঙ্গালি জাতির গর্ব এই শহীদ মিনার। পাকিস্তানি শাসকশ্রেনি যখন বাঙ্গালির মুখের ভাষা বাংলা কেড়ে নিতে চেয়েছিলো তখন বাংলার দামাল ছেলেরা জীবন দিয়ে রুখে দেয়। সময়টা উনিশ’শ বায়ান্নর একুশে ফেব্রæয়ারি। পরে এর সূত্র ধরেই অবশেষে একাত্তরের স্বাধীনতা। এরপর একে একে সংসদ ভবন। মুক্তিযুদ্ধের যাদুঘর দেখানো শেষ হলে মার্গারেটকে নিয়ে গেলো আমাদের জাতীয় স্মৃতিসৌধে। শ্বাশত বললো ত্রিশ লক্ষ শহীদের আর দুই লক্ষ নারীর নারীত্বের বিনিময়ে এই স্মৃতিসৌধ। এ দেশের সূর্য সন্তানদের হাহাকার কান পাতলেই শোনা যায়। এইদেশ তো তারা চায়নি। চেয়ে ছিলো সুখী – সাম্যে মোড়ানো একটি দেশ।
ফেরার পথে শাশ্বত মার্গারেটকে বলে, কাল আমাদের নববর্ষের দিন। এদিন অন্য অন্য দেশের মতন আমাদের দেশ ও উৎসবে মেতে ওঠবে। তুমি কি এই আনন্দে উৎসবে অংশগ্রহণ করবে?
কেন নয়?
তাহলে ভোরে রমনার বটতলায় অনুষ্ঠান শুরু হবে। এতে শত-সহস্র মানুষ অংশ গ্রহণ করবে। অসম্প্রদায়িক এই উৎসবে আনন্দের ঢেউ উঠবে সারা বাংলাদেশে।
রাত ন’টায় শাশ্বতকে কমলাপুর বস্তির সামনে নামিয়ে দিয়ে মার্গারেট যখন হোটেলে ফিরে যাবার তোড়জোড় করছে, মেয়েটার তখনও কী আবেগ আর আবেগ। বলে কিনা ভোরে ঘুম থেকে তুমি উঠতে পারবে না।
শাশ্বত মৃদু হেসে বলেছিলো, তোমার বুঝি খুব চিন্তা হচ্ছে?
হবে না? দু’জন দু’জায়গায় পড়ে থাকলে-
তা হলে উপায় একটা কী বের করা যায় বলো তো?
একজনের দেরি হলে আরেকজন যে ডেকে দেবে সেই উপায় কোথায়? রোমশা অধৈর্য কন্ঠে বলে উঠলো, কোথায় কমলাপুর বস্তি আর কোথায় সোনারগাঁ হোটেল। এক জায়গায় কাছাকাছি না থাকলে?
শাশ্বতর ভেতরে মধ্যবিত্তের আনন্দ মাথা দোলাচ্ছে। সে জিজ্ঞেস করে বসলো, কতো কাছাকাছি?
এই ধরো, একই হোটেল, পাশাপাশি ঘর।
ব্যস। এইটুকুই তোমার কাছাকাছির সংজ্ঞা?
আর কী?
শাশ্বতর ভেতরে খুশির চারা গাছগুলো যেনো দুলছে। ছেলেটা দোল খেয়েই চলেছে। আগে পরে কী হবে সে জানে না। মধ্যবিত্তের খুশির পরাগ মাখা মুহূর্ত সবসময় আসে না। নানা রকমের বাধা-বিপত্তি, রুক্ষতা ভগ্নাশার জাঁতিকলে সারাক্ষণই তো পিষ্ট হয়ে চলছে। শাশ্বত কপট গম্ভীর সুরে বললো, না, মানে ওই তুমি ডাকাডাকির কথা বললে না, তা শুনে আমার আবার মনে হলো- পাশে শুয়ে থাকা মানুষটাকে ডাকাডাকি করাই তো সব চেয়ে সহজ। সেখানে দূরত্ব বলে কিছুই থাকে না।
নির্দোষ ঠাট্টার মজায় মেতে মার্গারেট কিন্তু যে হাসিটা ছড়িয়ে দিলো তাতেও কোন মলিনতা লেগে নেই। বলা যায় তার ব্যগ্রতা স্ফুরনও কম নয়। সে অর্থপূর্ণ হেসে বললো, তুমি তো বেশ দামাল ছেলে?
হঠাৎ মনে হলো, আজ একটু অন্য রকমের হয়ে উঠি।
এই অন্য রকমটা কী রকম?
শাশ্বত সুজাসুজি বলে দিলো, এক ঘেয়ে জীবন থেকে যা আলাদা।
সেই আলাদা তো অনেক রকমের। মার্গারেট স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে জানতে চাইলো, তুমি ঠিক কোনটাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে চাইছো।
শাশ্বত এবার হেসে ফেললো, এর বেশী বলতে গেলে আমি বেশ নার্ভাস হয়ে পড়ছি।
এটা বেশ বললে তুমি। তবে তুমি তো জানো না, তোমার কথা শুনতে শুনতে আমার আবার সারা শরীর কেমন যেন শিরশির করছে। আসলে ডাকাডাকি, নার্ভাসনেস, শিরশির করা, ভেতরে কী যে হচ্ছে বাংলাদেশে এসে সব যেন কেমন ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে।
সকাল পাঁচটায় বেড়িয়ে দেখলো গ্রীক সৌন্দর্যের ছেলেটা নেই। হোটেলের সামনে পায়চারি করতে করতে সামনের দিকে তাকাতেই দেখলো লম্বা চুলের সুঠাম দেহের ছেলেটি পিঠে একটি ব্যাগ নিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে আসছে।
শাশ্বত মার্গারেটের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই বুঝতে পারলো মেয়েটি একটু গম্ভীর হয়ে আছে। সে হেসে বললো, গুড মর্নিং, ম্যাডাম।
ব্যাড মর্নিং। মার্গারেট কাটাকাটা উত্তর, ভেরি ভেরি ব্যাড মর্নিং।
মৃদু হেসে শাশ্বত জানতে চাইলো, হোয়াই?
আয়াম ভেরি মাচ অ্যাঙ্গরি উহথ ইউ। বিকজ ইউ আর টেন মিনিট নেট।
আই অ্যাম একসট্টিমলি সরি।
মার্গারেট ফোঁসফাঁস করে অন্যদিকে তাকিয়ে বসলো, আফটার রিমাইন্ডিং ইউ, টুডে ইউ আর লেট?
শাশ্বত মার্গারেট মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মিনতি জানিয়ে বললো, আই প্রমিজ ইউ নট টু বি লেট এগেইন।
রমনার বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠান দিয়ে শুরু করে মঙ্গল শোভায়াত্রার দৃষ্টিনন্দিত মুখোশ জীবনজšু‘ নিয়ে শত-সহস্র উচ্চ¦সিত মানুষের অংশগ্রহণ দেখে মার্গারেট প্রাণোচ্ছ¡ল হয়ে উঠে। এছাড়া সারা শহরে নানা অনুষ্ঠান দেখে বাঙ্গালি সংস্কৃতির সঙ্গে মার্গারেটকে পরিচয় করিয়ে দিলো। মার্গারেট বাঙ্গালির বৈচিত্রময় সংস্কৃতির সান্নিধ্যে এসে যার পর নাই উচ্ছ¡সিত হয়ে উঠলো।
সন্ধ্যার পর হোটেল লাউঞ্চে এসে শাশ্বতর প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মার্গারেট প্রায় ফিসফিস করে বললো, এ্যাই শাশ্বত, আমরা কি এক ঘরে থাকবো? ডাকাডাকি করতে, কথা বলতে অনেক সুবিধা। মার্গারেট চোখ ঘুরিয়ে হাসলো, তুমি তো এমনটাই বলেছিলে, তাই না?
শাশ্বত হেসে ফেললো, বলেছিলাম।
এখন কি আপত্তি করছো? মার্গারেট উদাত্ত হাসিটা বড়ই মনোরম। বললো, আমার কিন্তু আপত্তি নেই।
সোনারগাঁ হোটেলের তিনশ এক নম্বর ঘরের বাসিন্দা এখন দু’জন। বিদেশী মার্গারেট ও বাংলাদেশের শাশ্বত মৈত্র। ব্যাগেজপত্র রেখে দিয়ে ঘর এবং তার আসবাবপত্রের উপর চোখ বোলাতে বোলাতে শাশ্বত মুগ্ধ কন্ঠে বলে উঠলো, একটা সত্যি কথা বলবো, রোমশা?
মার্গারেট দু’চোখে কৌতুকের ছুটা’ তুমি কি মিথ্যাও বলো নাকি যে সত্যি বলার প্রশ্ন উঠছে।
তা নয় সত্যি বলার আগে ওটা একটা শপথ নেওয়া। শাশ্বত বললো, বলছিলাম কী? তোমার দৌলতে এই যে পাঁচ তারা হোটেলে থাকছি খাচ্ছি এ সব আমার কাছে স্বপ্ন। মুশকিলটা কখন হবে জানো? তুমি তোমার দেশে ফিরে যাওয়ার পর এই হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে আমার নি:শ্বাস ভারি হয়ে উঠবে। কার সঙ্গে এখানে, সে এখন কোথায়?
মার্গারেট শাশ্বতর মন খারাপ করাটাকে পাত্তা দিল না। হাল্কা সুরে বললো, জীবন হলো একটা আয়না। নিজেকে যখন যেমন দেখবে সেই অনুযায়ী চলবে। এবার কাজের কথাটা শোনো, তাড়াতাড়ি স্নানটা সেরে এসো তারপর আমি ঢুকবো।
চুল না ভিজিয়ে স্নান সেরে বাথরুম থেকে বেড়িয়ে এলো রোমশা। সোনালি সেই রেশম চুলগুলো কাপস তুলোর মতো উড়ছে। বন্ধনহীন চুলে তাই ভেসে বেড়ানোর ডাক। এই মুহূর্তে মার্গারেটের পরনে ঢিলেঢালা সেই প্যান্ট হাঁটুর সামান্য নিচে নেমে থেমে গেছে। ফলে নগ্ন এবং মসৃন পা দু’টোকে হাতির দাঁতের মতোই সৌন্দর্যের এক বাহার বলে মনে হচ্ছে।
আয়নার মধ্যে দিয়ে মার্গারেট নিজেকে আড়াল করে শাশ্বতকে দেখে যাচ্ছিলো। তার ভালোবাসার ছেলেটা সম্ভবত দোটানার মধ্যে পড়েছে। একজন নরম ধাঁচের ছেলের পক্ষে সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু ভালোবাসারও তো চাহিদা থাকে। মার্গারেট ধীর পায়ে বিছানায় গিয়ে নতুন করে শাশ্বতর দিকে তাকালো। দু’জনের চোখাচোখি তো হলোই সমস্যা হলো, কেউই সেই দৃষ্টি সরিয়ে নিতে বিশেষ আগ্রহী হলো না। অনাগ্রহের সেই ইঙ্গিতও তো ভালোবাসাই।
নিষ্পলক দৃষ্টির এই গভীরতার মধ্যেই মার্গারেট এক সময় দ্বিধাহীন গলায় ডাকলো, কাছে এসো, আমার কাছে। ছোট্ট ওই চারটে শব্দের মধ্যেই যে অসম্ভব এক মাদকতা মাখা সুর ছিলো তাতে কারো পক্ষে দূরে সরে থাকা সম্ভব নয়। শাশ্বতও থাকেনি। অপ্রাপ্তি আর অসচ্ছলতার লড়াইয়ে হারতে হারতে ও আজ জিততে চায়। অন্তত নিজের কাছে জয়ী হওয়ারও তো একটা তাগিদ থাকে। দেখো আমি কী জিতেছি, কাকে জিতেছি।
শাশ্বত কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই মার্গারেট অলৌকিক হাসি ছড়িয়ে নিজের মুখটা সামান্য তুলে ধরে একটু হাসলো। তারপর আবারও সেই মাদকতা ভরা গলায় বললো, এসো, উঠে এসো। যেটা স্বাভাবিক সেটা মেনে নাও। আর আমি তোমাকে ভালোবাসি বলেই না একঘরে থাকার এই আয়োজন- ওটা বুঝতেও এতো দেরী?
পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের দু’জন পূর্ণ বয়ষ্ক যুবকÑযুবতী নিজেদের ইচ্ছায় এবং আকাক্সক্ষায় যা করলো সেটাও শিল্প। হোটেলের তিনশো এক নম্বর ঘরের সেই শিল্প কর্মেও দু’স্রষ্টা তখনও মেতে রয়েছে সৃষ্টির আনন্দে। ঘরের হাল্কা মিউজিকের মধ্যেও দু’জনের কথা শোনা যাচ্ছে। সেই কথাও যেন সুমধূর এক সঙ্গীঁত শারীরীকভাবে ঘনিষ্ঠ হওয়া দুই তরুণ- তরুণী ভালোবাসার অন্য এক তাজমহল গড়ে চলেছে।
টেবিলে রাতের খাবার সাজানো ছিলো। খেতে খেতে খুশির গলায় মার্গারেট বললো, আজকের দিনটা সত্যই অন্য রকমের। তাই না, শাশ্বত?
ঠিক তাই।
আমরা দু’জন দু’জনকে উম্মোচন করে চিনলাম, চিনিয়ে দিলাম।
ঠিক তাই। কেন না জীবনের প্রথম স্পর্শ, প্রথম আবেগ উষ্ণতা- এ সবকে তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মধ্যবিত্ত পরিবারের গড়পড়তা এক সাধারণ ছেলের কাছে ঘটনার আবেদনই অসীম। একটা কথা বলবো, মার্গারেট?
হঁ।
আমোরিকা, ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ছেলেমেয়ে, যুবক-যুবতীরা যার সঙ্গে শরীরী সম্পর্কের ভালোবাসা তার সঙ্গে বিয়েÑ এই মতবাদে বিশ্বাসী নয়। তাদের কাছে ভালোবাসা ও বিয়ে দু’টোই আলাদা ব্যাপার। ধরা-ছাড়ার এই মানসিকতা বা দর্শণের আমাদের ঠিক মেলে না। ব্যতিক্রম হয়তো কিছু আছে কিন্তু সেটাই সব নয়। আমাদের মূলধারা হলো, আমরা যাকে ভালোবাসি তাকে বিয়ে করতে পারলেই মন ভরে যায়। আর বিয়ের আগে ওই সব ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা খুব একটা ভাবতেই পারিনা। রক্ষণশীল মনোভাব থেকে যেটা বলতে চাচ্ছি, আজকে যেটা হলো এটা তোমার কাছে বিনোদনের হলেও আমার কাছে এই ঘটনার গভীরতা অনেক বেশি বিস্তৃত। তুমি-তুমি কি আমাকে ফেলে চলে যাবে?
মার্গারেট খাওয়া থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তোমার কী মনে হয়।
দেখো, দুই দেশের ভাষা, সংস্কৃতি, কালচার, ঐতিহ্য, বিশ্বাস, অবস্থান সবই যখন আলাদা তখন তোমার চলে যাওয়াটাই সেই অর্থে নিয়মের মধ্যে, স্বাভাবিকতার মধ্যেই পড়ে। আমার এতো কথা বলার বিষয়টা হলো, একটু আগেই বললে না, এ্যাই শাশ্বত, শোন, তুমি আবার আমাকে ছেড়ে, চলে যাবে নাতো? খুব কষ্ট পাবো তা হলো।
হঁ, বলেছি তো-
আমি বলতে চাইছি, তোমার থেকেও বেশী কষ্ট পাবো আমি।
কিছুক্ষণ থেমে থেকে বললো, তোমার কষ্ট, আমার কষ্ট বলে, এখন আর আমাদের মধ্যে কিছু নেই। আমরা মিশে গেছি এক স্রোতে, এক ভাবনায়। এখন থেকে শুধু আমরা! আমরা!
হোটেলের সুগন্ধি সাবান দিয়ে স্নানটা করে পাজামা-পাঞ্জাবী গায়ে চাপিয়ে শাশ্বত যখন বেড়িয়ে এলো, তখন সারা ঘরটা অপূর্ব এক গন্ধে ভরে আছে।
শাশ্বত ওর মুখোমুখি বসে চোখের দিকে তাকাতেই মার্গারেট বললো, আমার জন্য হোয়াইট ওয়াইন আনিয়েছি। আমি এটা ছাড়া অন্য কোন ড্রিঙ্ক সাধারণত নেই না। তোমার জন্যে বিয়ার রয়েছে। তবে- মার্গারেট আদুরে গলায় বললো, তুমি না বলেছিলে, একদিন হোয়াইট ওয়াইন খাবে। আজ খাবে? একটা খেয়ে দেখো ভালো লাগবে।
নিজের জন্যে এবং শাশ্বতর জন্য ড্রিঙ্কটা বানিয়ে ফেললো। তারপর ছোট ছোট চুমুক বসিয়ে সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে রোমশা জিজ্ঞেস করে, আমাদের তো দিনাজপুর কান্তিজির মন্দির দেখতে যাওয়ার কথা,
হ্যাঁ।
সকালেই হোটেল ছেড়ে দিচ্ছি।
তেমনটাই তো ঠিক।
ঢাকায় রাতে পৌঁছেই আবার পরদিন সকাল দশটায় ছুটতে হবে-
শাশ্বত হোয়াইট ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিয়ে একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, দশটায় আবার কোথায় ছুটবে?
এরি মধ্যে ভুলে গেলে?
আমি এখন সত্যিই হাল্কা মেঘের মতো ভেসে চলেছি। ভারি ভালো লাগছে মার্গারেট । অভাবী ঘরের একটা ছেলেকে তুমি যে ঐশ্বর্য স্বেচ্ছায় দিলে আবারও বলছি তোমার কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। আজীবন। এতো ফুরফুরে আনন্দে থেকে আমি অনেক কিছু ভুলে গেছি। সকাল দশটায় কোথায় যাবার কথা বলো তো?
এসিয়াটিকের অফিসে একবার যেতে হবে না? তোমরা বিশ জন যে ইন্টারভিউ দিয়ে এলে এর রেজাল্টটা তো জানতে হবে।
ওহ, ইয়েস। এবার মনে পড়েছে। শাশ্বত বললো, বারজনকে নেবে। বাদ পড়বে আটজন। কিন্তু মার্গারেট আমি তোমাকে বলে রাখছি, এবারে ওরা আমাকে বাদ দিতে পারবে না।
কেন? ইন্টারভিউ ভালো দিয়েছো বলে?
সেটাতো একটা আছেই। আরো বড়ো কারণটা হলো, আমার সঙ্গে মার্গারেট রয়েছে। একটা চাকরি তো সামান্য, আমি এখন এই পৃথিবীটা জয় করতে পারি।
আচ্ছা শাশ্বত—
বলো।
এই যে তুমি চাকরি-বাকরি খুঁজছো এটা ছাড়া তুমি অন্য কিছু করতে পারো না? মানে ব্যবসা। মার্গারেট উচ্ছ্বল হেসে বললো, আমি ব্যবসা করে এখন চারটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরসের মালিক হয়েও মাঝে মাঝে একটা কথা ভাবি, চাকরি করে আর কতদূর এগোতে পারতাম?
শাশ্বতর গ্লাসটা ফাকা হতেই রোশমা ভালোবাসার গলায় বললো, অ্যাই শাশ্বত আর একটা নাও।
উহ! একটাতেই ভালো আছি।
আজ আমি তোমাকে আরো মন্দ করে দেবো।
মার্গারেট চোখের দিকে গভীরভাবে তাকালো। জাগতিক সব শব্দ যেন মুছে গিয়েছে। দু’জনেরই দৃষ্টি তখন স্থির। শাশ্বত নিচু গলায় বললো, মন্দ যদি বলো আমিতো মন্দ হতেই এসেছি। কিন্তু মার্গারেট মায়া স্পর্শে কেউ মন্দ হতে পারে না বলেই আমার বিশ্বাস। কথাটা শেষ করেই শাশ্বত মার্গারেটকে টেনে তুলে যে আগ্রহ এবং তীব্রতায় ওর ঠোঁটের দখল নিল, সেই দাবি ছাড়ার বিন্দুমাত্র লক্ষণ ছেলেটার মধ্যে দেখা গেল না। বরং ধীরে ধীরে সে এক সময় মার্গারেট পুরো শরীরটারও দখল নিয়ে ফেললো। আর শাশ্বতর সেই অনায়াস জয়ে সব থেকে বেশি সহযোগীতা করলো কিনা ওই মার্গারেটই। শরীরী সাম্রাজ্যেও ওই সম্রাজ্ঞী নিজের রাজ্যপাট, ঘর দোর সব হাট করে খুলে দিয়ে যদি লুন্ঠনের আহবান জানায় সেটা তখন হয়ে ওঠে সত্যিই এক আনন্দেরই মৃগয়াভূমি।
চল্লিশ মিনিট বাদে শাশ্বত মৃদু হেসে বললো, আমার নেশা টেশা সব কেটে গিয়েছে। আমাকে আর একটা দাও।
মার্গারেট চোখের কোনে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি, তার মানে আর একটা খেয়ে আরেকবার।
আজ আর কোন কিছুতেই গোনাগুনি নেই। শাশ্বত হেসে ফেললো। মন্দ যখন হয়েই গেছি সংখ্যাতত্তে¡ও হিসাব নিয়ে কী করবো? আর কখনো কি এ জিনিস খেতে পাবো? গ্রেট মার্গারেটের দয়ায় এই কদিন যে রাজকীয়ভাবে কাটালাম। তার জন্যে আমোরিকা থেকে আসা এই মার্গারেট কাছে কৃতজ্ঞ রইলাম। আমাকে আরেকটা দাও মার্গারেট। আমাকে আরেকটা-
নাহ তোমাকে আর দেবো না। অভিমানে মার্গারেট গলা বুজে যায়।
কিন্তু একি তোমার চোখে জল কেন? শাশ্বত ওর পাঞ্জাবির প্রান্ত দিয়ে পরম মমতায় সেইজল মুছিয়ে দিয়ে গম্ভীর সুরে বললো, হাসি ছাড়া ওই মার্গারেটকে যে আর কিছু মানায় না।
নিজেকে সামান্য একটু গুছিয়ে নিয়ে মার্গারেট বললো, আমি বাংলা দেশে এসেছি, চিটাগাং যাচ্ছি কেন জানো?
শাশ্বত মাথা নেড়ে জানালো, না।
চিটাগাং আমি একজন লোকের সন্ধানে এসেছি।
শাশ্বত জিজ্ঞেস করলো, তিনি কে, কী হন তোমার?
আমার বাবা।
মার্গারেট কথা শুনে শাশ্বত চমকে উঠলো। সে ফ্যাল ফ্যাল করে ওর মুখের দিকে তাকিয়েই রইলো।
মার্গারেট জিজ্ঞাস করলো বাবার নামটা জানতে চাইলে নাতো।
কী নাম তোমার বাবার?
কাওশিক মাইত্র।
কী বললে? শাশ্বত হতভম্ব। সে বুঝতে পারলো কাওশিক মাইত্র উচ্চারণটা হবে কৌশিক মিত্র। কিন্তু সঠিক উচ্চারণ নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় এটা নয়।
ইয়েস, আমার গায়ে ও বাঙ্গালির রক্ত। তাতে আমি গর্বিত নই। আমি আমার মায়ের পদবীটা ব্যবহার করি। আর বাবার নাম কৌশিক মিত্র। তাকে কতো দিনেই বা দেখলাম?
সানফ্রান্সকিকোতে মায়ের সঙ্গে প্রেম তারপর বিয়ে। তারপর অতি নিষ্ঠার সঙ্গে ঘর-সংসার করছেন সাত বছর। তারপর চট্টগ্রাম যাওয়া একটু প্রয়োজন মনে করে বাড়ি থেকে এসেছেন। আর ফিরে যান নি।
আমার মা হলেন ধনী ব্যবসায়ী পরিবারের মেয়ে সচ্ছলতায় মোড়া আমাদের জীবন। ফলে অন্য কোন দিকে আমাদের বিন্দুমাত্র অসুবিধে না থাকলেও আমাদের সংসারে ওই একজন মানুষের অভাবটা খুব বেশি বেশিই ছিলো। আমার পড়াশোনা, বড়ো হওয়া এবং আমাদের ডিপার্টমেন্টাল স্টোর্সেও ব্যবসা দেখার ফাঁকে ফাঁকে মাকে কথা দিয়েছিলাম, বাংলাদেশে গিয়ে বাবার খোঁজ করতে আমি অবশ্যই চিটাগাং যাবো।
হ্যাঁ, তোমাকে যখন পেয়েছি তখন আমার চট্টগ্রাম যাওয়া আর আটকায় কে?
শ্বাশত, এই কাজটায় তুমি আমাকে সাহায্য করবে?
লোকটা কাওয়ার্ড। ধান্দাবাজ-প্রতারক। এছাড়া ওকে আর আমি কিছু ভাবতে পারছিনা। হয়তো গিয়ে দেখবে সে একটা বাঙ্গালি বিয়ে করে সেই নারীর উত্তাপ নিয়ে ঘর সংসার করছে।
তুমি এমন একটা মনগড়া কাহিনী সাজিয়ে বললে তা খুবই অন্যায়। না জেনে কারো উপর দোষ চাপানো উচিত নয়। তুমি যেমন বাঙ্গালি বিয়ে করে ঘর সংসার করছে বললে। তা না হয়ে উনি আমাদের মধ্যে নাও তো থাকতে পারেন। চট্টগ্রাম এর প্রতি তোমার বাবার কোন আকর্ষণ নেই। বাড়ির কথা তোমাদের বলেন নি। এর অর্থ পারিবারিক ইতিহাসটা উনি ভুলতে চান। সত্যিটা আমরা জানি না। কিন্তু এটা আমাদের বের করতে হবে। কৌশিক মিত্রকে আমরা
মার্গারেট বলে উঠলো, তুমি আমার বাবাকে খোঁজে দাও। শ্বাশত, আমি তোমর কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো।
এটা কৃতজ্ঞ থাকার ব্যপার নয়। এটা আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য — তোমার প্রতি ভালোবাসা। কাজটা কঠিন হলেও একেবারে অসম্ভব নয়। একটু সময় লাগবে। এক-একটা পাড়া, এলাকার বাড়ি ধরে ধরে আমরা এগোবো। তারপর দেখা যাক তোমার বাবাকে উদ্ধার করতে পারি কিনা।
মার্গারেট বললো, তোমার নাম শ্বাশত। কাজটা পারলে তুমিই পারবে।
শ্বাশত মৃদু হেসে বললো আমার চেষ্টা তো থাকবে। কিন্তু যদি না পারি?
দেশে ফিরে গিয়ে আমি মায়ের সামনে একা দাঁড়াতে পারবো না। আমার সঙ্গে আমেরিকা গিয়ে মাকে সামলানোর দায়িত্ব তোমাকে নিতে হবে। আমি শুধু মাকে একটা কথা বলতে পারি, তুমি যে ভুলটা করেছ আমি তা করিনি। শ্বাশতর বাড়ির ঠিকানা জেনে, ওর মা, দাদা-বৌদির সম্মতি নিয়েই এসেছি। ও আর কোথাও হারাবে না। ওকে আমরা হারাতেই দেবো না।