দীর্ঘদিন ধরে দেশে একের পর এক বেড়ে চলছে নিত্যপণ্যের বাজারের দাম। করোনা পরবর্তী বিশ্বের মানুষ যখনি স্বস্তির নিঃশ্বেস নিবে, এমন সময় বেঁধে গেল রাশিয়া – ইউক্রেন যুদ্ধ। যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী তেল, গম, চালসহ নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিসহ বেড়ে গেছে ডলারের দাম। বাংলাদেশ এর থেকে পরিত্রান পাবে-এমনটি ভাবার কোন সুযোগ ইেন। দেশে নিত্যপণ্যের পাশাপাশি অব্যাহতভাবে বেড়ে চলছে ডলারের দাম, যা উদ্বেগজনক। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, করোনা পরিস্থিতি উন্নতির প্রেক্ষাপটে সারা দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাÐ বেড়েছে। স¤প্রতি বিভিন্ন পণ্য আমদানির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। সেই তুলনায় রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। করোনা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পর চিকিৎসা, পড়াশোনা ও ভ্রমণের জন্য অনেকেই বিদেশে যাচ্ছেন। এসব কারণে নগদ ডলারের চাহিদা যেমন বেড়েছে, তেমনি দামও বেড়েছে। সব মিলিয়ে বাজারে ডলারের সংকট তীব্র হচ্ছে। যা পণ্য আমদানী-রফতানীতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। সূত্র জানায়, একদিনের ব্যবধানে গত মঙ্গলবার আন্তঃব্যাংকে ডলারের দাম আরও ১০ পয়সা বেড়ে সর্বোচ্চ ৮৭ টাকা ৬০ পয়সা দরে বিক্রি হয়েছে। মানিচেঞ্জারগুলো প্রতি ডলার বিক্রি করেছে ১০১ থেকে ১০২ টাকায়। কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে ১০২ থেকে ১০৩ টাকায়। জানা গেছে, নগদ ডলার বিভিন্ন ব্যাংক ভিন্ন ভিন্ন দরে বিক্রি করছে। সরকারি ব্যাংকগুলোতে এর দাম কিছুটা কম হলেও বেসরকারি ব্যাংকে বেশি। ডলারের পাশাপাশি অন্যান্য মুদ্রার দামও বেড়েছে। এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, ব্যয় সংকোচন নীতিমালা প্রণয়ন ও আমদানি ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নেওয়া। ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রে দ্রুততম সময়ে আমদানি ব্যয় কমানোর কাজটি কঠিন হলেও বিলাস পণ্যের ক্ষেত্রে দ্রুততম সময়ে আমদানি ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব। এ সময়ে আমদানিনির্ভর নতুন বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করার বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। আশার কথা, সরকার গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রীসভার বৈঠকে এ জাতীয় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে আমরা জানতে পারি। বৈঠকে ডলারের দামসহ নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির ফলে করণীয় ঠিক করতে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি কমিটি করে দিয়েছেন। তারা আগামী ৩দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করবেন। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে সংযত ব্যয়সহ আমদানীর উপর কিছু নির্দেশনা আসতে পারে বলে ঈঙ্গীত পাওয়া গেছে। বলাবাহুল্য, দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ কমে যেতে পারে। এ অবস্থায় রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর জন্য স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়িয়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো সম্ভব। দীর্ঘ মেয়াদে প্রবাসী বাংলাদেশিদের শ্রমনির্ভর কাজের পরিবর্তে মেধানির্ভর কাজে অংশগ্রহণে গুরুত্ব দিতে হবে। রপ্তানির ক্ষেত্রেও শ্রমনির্ভর, রপ্তানি পণ্যের পরিবর্তে মেধানির্ভর পণ্যে গুরুত্ব বাড়াতে হবে। এতে রেমিট্যান্স প্রবাহে কাক্সিক্ষত গতি আসবে। প্রবাসীরা যাতে হুন্ডির পরিবর্তে ব্যাংক চ্যানেলে অর্থ প্রেরণে বেশি আগ্রহী হয় সেজন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের নৈতিকতাবোধের উন্নতিও কাম্য। অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুর্নীতির মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ বিদেশে পাচার করে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এ ছাড়া অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একই ধরনের বিলাসপণ্য দেশে থাকা সত্ত্বেও বিদেশি পণ্য ক্রয়ে আগ্রহী হয়। সেক্ষেত্রে বিলাসপণ্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করা হলে বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ চিকিৎসার জন্য প্রতিবেশী দেশে যায়। এ প্রবণতা রোধে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। আমদানিকৃত পণ্যের দাম বাড়লে মানুষ বেশি দামে পণ্য ক্রয়ে বাধ্য হয়। মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমলে তা দেশের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলে। নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা অর্জিত না হলে আলোচিত বিষয়ে যত পদক্ষেপই নেওয়া হোক না কেন, তা কতটা টেকসই হবে সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। ডলারের দাম বৃদ্ধির পেছনে কোনো সিন্ডিকেট কাজ করছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। বাজারব্যবস্তাপনায় সিন্ডিকেটের যে আলোচনা সবসময় আসে এর বিরুদ্ধেও কঠোর হতে হবে সরকারকে। আমরা মনে করি, উল্লিখিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংযত ব্যয় সংকোচন নীতির প্রয়োগসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে।