নতুন প্রজন্মের পাঠকের দৈনিক পূর্বদেশ

19

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

দৈনিক পূর্বদেশ দশম বর্ষে পদার্পণ করছে জেনে ভালোই লাগছে। প্রতিদিন পূর্বদেশ পড়ি, কিন্তু কখনো বর্ষ গণনা করিনি। অনেক প্রতিকূলতার পাহাড় ডিঙিয়ে পত্রিকা নিয়মিত বের হচ্ছে। যখন দিন যায়, তখন মাসও যাবে, বরষও ফুরিয়ে যাবে। এক সময় বর্ষ অবসান হতে হতে দশকের মাইলফলক স্পর্শ করেছে। যুগাবসানেরও আর বিলম্ব নেই।
যুগের কথা যখন উঠলো, তখন কিছু কথা বলতে হয়। ২০১২ খ্রিস্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর পূর্বদেশ যেদিন প্রকাশিত হয়েছিলো, চট্টগ্রামের সংবাদপত্রের ইতিহাসে সেদিন একটি নতুন যুগের আরম্ভ হয়েছিলো। পূর্বদেশকে একটি নতুন যুগের ¯্রষ্টা একারণেই বলতে হয় যে পূর্বদেশ যখন প্রকাশিত হলো, তখন দেখা গেলো এটি কোনো গৎবাঁধা বা গড়পড়তা পত্রিকা নয়। এটি একটি ঘবংি-নধংবফ পত্রিকা, অন্যান্য পত্রিকায়ও নিউজ থাকে। কিন্তু শুধু ঘবংি এর ওপর নির্ভর করে যেসব পত্রিকা প্রকাশিত হয় না। সেখানে সম্পাদকীয়, ফিচার ইত্যাদি আনুপাতিক হারে বন্টন করে দেয়া হয়। হ বিশেষ সংখ্যা পৃষ্ঠা ১৩
পূর্বদেশেও সম্পাদকীয়, ফিচার আছে; কিন্তু পাল্লাটা ঘবংি এর দিকেই ঝুঁকে থাকে।
আর একটা বিষয়, যে কারণে পাঠকের মন জয় করতে পারলো সেটা হচ্ছে, পাঠককে যত বেশি সম্ভব নিউজ উপহার দেয়ার চেষ্টা করে পত্রিকাটি। সেজন্য সম্পাদনা করে নিউজের মেদ, ভুড়ি কমিয়ে যথাসম্ভব ছোট করে পরিবেশনের একটা নতুন ধারা সৃষ্টি করলো পূর্বদেশ। এডিটিং-এর মুনশিয়ানার কারণে পূর্বদেশ-এর নিউজ হলো নির্ভার, যা পড়তে পাঠকের বিরক্তি বা ক্লান্তি আসে না। অন্যান্য পত্রিকায় সংবাদ যথাযথভাবে এডিট না করার ফলে সেগুলি হয় প্রয়োজনহীনভাবে দীর্ঘ, স্ফীতকায় এবং বর্ধিত কলেবর।
পূর্বদেশ-এর যে দু’টি বৈশিষ্টের কথা আমি উল্লেখ করলাম ঘবংি-নধংবফ পত্রিকা এবং সুসম্পাদনার মাধ্যমে আকার ছোট করে বেশি নিউজ পরিবেশন করা- এই বৈশিষ্ট্যচিহ্নিত হয়ে পূর্বদেশ চট্টগ্রামের সংবাদপত্র জগতে একটি নতুন ধারা, একটি নতুন যুগ সৃষ্টি করেছে। সুতরাং একথা তর্কাতীতভাবে বলা যায় যে, পূর্বদেশ একটি নতুন যুগের প্রতীক।
পাকিস্তান আমলে ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন, বাঙালিদের প্রতি অন্যায়, অবহেলা ও বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে গড়ে ওঠা বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ও আন্দোলনের বাহন হয়ে উঠেছিলো তিনটি সংবাদপত্রÑইত্তেফাক, সংবাদ ও অবজারভার। পরে পূর্বদেশও এই ধারায় যুক্ত হয়। ইত্তেফাকের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, সংবাদের জহুর হোসেন চৌধুরী এবং অবজারভারের আবদুস সালামের দক্ষ সাংবাদিকতার সুনিপুণ কৌশলে উপর্যুক্ত তিনটি পত্রিকা হয়ে উঠেছিলো জনমতের বাহন, জনগণের মুখপত্র। তাঁদের কুশলী সাংবাদিকতার কাছে পাকিস্তানের লৌহমানব আইয়ুব খান বারবার পরাস্ত হয়েছেন। পরবর্তীকালে পূর্বদেশও এই ধারায় সাংবাদিকতা করে খ্যাতি অর্জন করে। বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা থেকে বাঙালি জাতিসত্তা সংহত হয়ে ওঠার কালে পূর্বদেশ তার সংবাদ, ভাষা ও সম্পাদকীয় মতামত প্রকাশ করে বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রচারের বলিষ্ঠ প্রবক্তা হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার পর বহু বছর পূর্বদেশ পাঠকের দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়।
বিশ শতকের বার খ্রিস্টাব্দে দেশের পূর্ব প্রান্ত থেকে আবির্ভূত হয়ে নতুন করে তার অস্তিত্ব ঘোষণা করলো পূর্বদেশ। কী বিষ্ময় ও পুলকে ভরা সেই আবির্ভাব। বাঁশখালীর নাপোড়া গ্রামের নীরব জ্ঞানসাধক, মানবপ্রেমি, শিক্ষক শিরোমণি মাস্টার নজির আহমদ ছ’টি সুপুত্র উপহার দিয়েছেন দেশ ও জাতিকে। দক্ষিণ বাঁশখালীর অন্ধকার প্রদেশকে যেমন তিনি শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে আলোকিত করেছেন, তেমনি আপন সন্তানগণকেও উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে এক একটি রতœস্বরূপ গড়ে তুলেছেন। এই শিক্ষার গুণেই তারা বাংলাদেশব্যাপী তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করেন পূর্বদেশের হদিস এবং চট্টগ্রাম থেকে নতুন রূপে প্রকাশ করেন দৈনিক পূর্বদেশ। যা’ বিশ শতকের ষাট দশকের পত্রিকা, তা’ হলো একুশ শতকের প্রভাতবেলার তরুণ তপন। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে দৈনিক পূর্বকোণ প্রকাশের পর চট্টগ্রাম থেকে আরো পত্রিকা যেমন ‘সুপ্রভাত’, ‘বীর চট্টগ্রাম মঞ্চ’ প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু আজাদী, পূর্বকোণের তৌলে সেগুলি কোনো আলোচনায় স্থান পায় না। একমাত্র ৩৫ বছর পর প্রকাশিত পূর্বদেশই মূল ধারার পত্রিকা হিসেবে স্বীকৃত ও পাঠক নন্দিত হয়েছে। আজাদী, পূর্বকোণের সঙ্গে প্রতিদ্ব›িদ্বতার সম্ভাবনা জাগিয়ে পূর্বদেশের আত্মপ্রকাশ চট্টগ্রামের সংবাদপত্রের ইতিহাসে একটি লাল তারকা চিহ্নিত তারিখ।