নগরজুড়ে থৈ থৈ পানি

78

হাঁটু থেকে কোমর পানিতে তলিয়ে গেছে নগরীর বিভিন্ন সড়ক। গতকাল রবিবার সকাল থেকে বৃষ্টিতে প্লাবিত হয়েছে নগরীর বেশিরভাগ এলাকা। বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে নগরবাসীকে পড়তে হয়েছে চরম দুর্ভোগে। শুধু নিম্নাঞ্চল নয়, অধিকাংশ সড়কে পানি উঠে। কিছু সড়কে দিনভর যানচলাচল বন্ধ ছিল। এসব সড়কে একমাত্র রিকশা-ভ্যানই ছিল যাতায়তের মাধ্যম।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, দেশের আকাশে মৌসুমী বায়ু বিরাজমান। এর প্রভাবেই বৃষ্টিপাত হচ্ছে। আরও কয়েকদিন ভারী থেকে বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে।
গতকাল রবিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পূববর্তী ২৪ ঘণ্টায় ৯৮ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করেছে পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস। বিকাল তিনটা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত ছিল ৭৯ দশমিক ৪ মিলিমিটার এবং দুপুর ১২টা পর্যন্ত ছিল ৭৫ দশমিক ০৪ মিলিমিটার।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ ড. মু. শহিদুল ইসলাম জানান, চট্টগ্রাম নদী বন্দরকে ২ নম্বর নৌ হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। বিকেল ৩টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছিল ৭৯ দশমিক ৪ মিলিমিটার। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত হয়েছে ৯৮ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত। সোমবার (আজ) সন্ধ্যা পর্যন্ত চট্টগ্রাম ও পার্শ¦বর্তী এলাকায় অস্থায়ী দমকা বা ঝড়ো হাওয়াসহ মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টি বা বজ্রবৃষ্টি হতে পারে।
গতকাল রবিবার সকাল থেকেই টানা বর্ষণে নগরীর প্রধান সড়ক, গলি, উপগলি পানিতে তলিয়ে যায়। বহদ্দারহাট থেকে মুরাদপুর, কাপাসগোলা, কাতালগঞ্জ, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা দিনের বেশিরভাগ সময় ডুবে ছিল। বাসাবাড়ি, দোকানপাট ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কক্ষেও পানি ঢুকে পড়ে। নগরীর ষোলশহর দুই নম্বর গেট, বহদ্দারহাট, চকবাজার, প্রবর্তক মোড়, মুরাদপুর, চান্দগাঁও, খতিবের হাট, বাকলিয়া, চাক্তাই, আছাদগঞ্জ, মোগলটুলি, আগ্রাবাদ, ট্রাঙ্ক রোড, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, দেওয়ানহাট, আসকারাবাদ, মনসুরাবাদ, পাহাড়তলী, হালিশহর, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড, বাকলিয়া ডিসি রোড, কাতালগঞ্জ, কাপাসগোলা, বাদুরতলাসহ বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
সকাল থেকে বৃষ্টিতে সড়কে পানি জমে যাওয়ায় কর্মস্থলের উদ্দেশে বের হওয়া মানুষকে পড়তে হয় ব্যাপক ভোগান্তিতে। বেশ কয়েকজন নারীসহ পথচারী নালায় পড়ে যাওয়ার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পেয়েছে।
সড়কে যান চলাচল কমে যাওয়ায় অনেকে কোমর পানির মধ্যে হেঁটেই যান গন্তব্যস্থলে। বিভিন্ন সড়কে পানি ঢুকে বিকল হয়ে যায় অনেক গাড়ির ইঞ্জিন। বেশি ভাড়ায় রিকশা, ভ্যানগাড়িতে উঠেন অনেকে। নিচু এলাকা ছাড়াও নগরীর জামালখান, আন্দরকিল্লা, আসকারদিঘির পাড় এলাকার বিভিন্ন ভবনের নিচ তলায়ও পানি ঢুকে পড়ে। এছাড়া চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকার (ইপিজেড) বিভিন্ন কারখানার নিচ তলায় পানি ঢুকেছে। ফলে এসব কারখানার স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
পানি ঢুকেছে বিভিন্ন জায়গার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। টেরিবাজার, খাতুনগঞ্জ, আছাদগঞ্জ ও কোরবানিগঞ্জের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও প্লাবিত হয়েছে। এতে ব্যাহত হয় তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম। এছাড়া নগরীর বহদ্দারহাট, বাকলিয়াসহ নিচু এলাকা কোমর পানিতে তলিয়ে গেছে। হঠাৎ এ বর্ষণে এসব নিচু এলাকার বাসিন্দারা মালামাল সরাতে পারেননি। অনেকে ঘরে হাঁটু পানির মধ্যেই বসে ছিলেন।
কেউ কেউ পানি সরানোর ব্যবস্থা করলেও বাসার পাশের নালা বন্ধ থাকায় পানি সরছিল না। এসব এলাকায় দুপুরে অনেক ঘরে রান্না করাও সম্ভব হয়নি। বেশিরভাগ এলাকা হাঁটু থেকে কোমর পানিতে তলিয়ে গেছে।
পানির ঢেউ ছিল ফ্লাইওভারেও। ফ্লাইওভার থেকে বৃষ্টির পানি নিচে গড়িয়ে পড়ছিল। এ সময় ফ্লাইওভারে উঠা ও নামার দিকে পানির ঢউ বয়ে যায়। ফ্লাইওভার দিয়ে যাওয়া গাড়িগুলোকে এ ঢেউ মোকাবেলা করতে হয়।
জলাবদ্ধতা নিরসনে মেগা প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল শাহ আলী বলেন, আমরা যে লক্ষ্য নিয়ে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ শুরু করেছি, আমি মনে করে সে লক্ষ্যের দিকে এগিয়েছি। বৃষ্টির পর আধঘণ্টা, এক ঘণ্টার মধ্যে পানি নেমে গেছে। আমাদের ড্রেনের প্রায় ৬০ শতাংশ কাজ হয়েছে। এতে পানি দ্রুত নেমে গেছে।
তিনি বলেন, আধঘণ্টা বা ৪০ মিনিট পর উপর থেকে পানি নিচের দিকে নেমে আসে। বৃষ্টি হওয়ার আধঘণ্টা পর পানি গড়িয়ে নিচে নামে। এখন আমাদের সমস্যা হচ্ছে, খালের নিচের দিকে সরু। যেমন হিজরা খালের প্রবর্তক অংশে যে পরিমাণ বড় নিচের দিকে কাপাসগোলা অংশে এসে সরু হয়ে গেছে। এতে প্রবর্তকের দিক থেকে পানি নামলেও কাপাসগোলার দিকে পানি জমে রাস্তায় উঠছে। খালটা বড় করে দিতে পারলে পানি চলে যাওয়ার কথা। প্রকল্পে খাল বড় করার পরিকল্পনা আছে।
বরাবরের মতোই হাঁটু পানি জমে আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালের নিচতলায়। জরুরি কিছু শয্যা ও সেবা দোতলায় স্থানান্তর করা হলেও দুর্ভোগ লেগেই ছিল রোগী, স্বজন, চিকিৎসক ও সেবিকাদের। পানি জমেছিল আগ্রাবাদের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের সামনের সড়কেও। বৈরি আবহাওয়ার কারণে বন্ধ ছিল চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে বড় জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে পণ্য খালাস বা লাইটারিং। বন্দরের এনসিটি, সিসিটি, ৪ নম্বর গেট এলাকার নিচু ইয়ার্ডে বৃষ্টির পানি জমেছিল।
উল্লেখ্য, নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের গৃহীত ৫ হাজার ৬শ ১৬ কোটি ৪৯ লাখ ৯০ হাজার টাকায় ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক চলমান মেগা প্রকল্পটি ২০১৭ সালের ৯ আগস্ট একনেকে অনুমোদন পায়। ২০১৮ সালের ৯ এপ্রিল প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সিডিএর সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। একই বছরের ২৮ এপ্রিল নালা পরিষ্কার করার কাজের মাধ্যমে প্রকল্পের কাজ শুরু করে সেনাবাহিনী। ইতিমধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের ৬০ শতাংশ কাজ শেষ করার পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের দাবি প্রায় ৫২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের তেমন কোন সুফল পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ নগরবাসীর।