তিনশ তিন টাকার কেজো ভূত

50

আমাদের পাড়া দিয়ে সম্প্রতি রোজ রাত-দুপুরে একটি লোক ডেকে যায়।
ভূত চাই ভূত……
ভালো ভালো ভূত আছে
ভালোভূত, আলোভূত, মেছোভূত, গেছোভূত, ছানাভূত, দানোভূত, কেজোভূত, হেজোভূত, বাসিভূত, কেশোভূত, মেসোভূত, হরেক রকম ভূত চাই…
প্রথম প্রথম খুবই অবাক হয়েছিলাম। ভয়ে ভয়ে জানলার খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে দেখতাম লোকটাকে। সোজা নাক বরাবর হেঁটে যেত সেই লম্বাগিজাং লোকটা পরিত্রাহি ডাকতে ডাকতে। আর লোকটার ভয়ানক ডাক শুনেই যে ক’টা বাড়ির জানলা খোলা থাকত, সবগুলো বন্ধ হয়ে যেত। নোয়াজিষপুরের মোয়াওয়ালা শান্তি রায় কিংবা গোয়ালা হরি বাবুর মধুর ডাক নয়। এ হলো রীতিমত যাকে বলে রাত-দুপুরে ভূত কেনার আমন্ত্রণ। কে আর শখ করে বাঁশঝাড় ঘাড়ে নেয় বাপু।
আমি একলা থাকি এই তিন কামরার একতলা বাড়িটিতে। একটা শক্ত অসুখে এখন হুইলচেয়ারে আটক। তবে মাঝে মাঝে আমার কিছু উদ্ভট খেয়াল চাপে। হঠাৎ মনে হলো, তাইতো একটা ভূত কিনলে বেশ হয়। একা থাকি, মানুষ না হোক ভূতই সই। আর আজকাল মানুষজনের যা নমুনা দেখছি তাতে বরং ভূতই ভালো সঙ্গী। দরদস্তুর করে যদি একটা ভালো দেখে ভূত কেনা যায় মন্দ কি। কি খায় দায় অবশ্য জানা নেই, তা সে জিজ্ঞাসা করলেই হবে। এই না ভেবে একদিন ওত পেতে ছিলাম, যেই না ভূতওয়ালা ডাকছে, অমনি ডাক দিলাম, ‘ও ভাই ভূত, শোনো, এই যে এদিকে….
লোকটি আমাকে দেখতে পেয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে এসে পড়ল-
বলল, আপনি আমাকে ভূত বলে ডাকছিলেন কেন? আমি ভূত নই, আমি ভূত বেচি গো বাবু।
হা? ও ভুল হয়ে গেছে খুব বাবা, ঠিক খেয়াল করিনি তো, আমিও ততোধিক বিনয় করেই বলি।
মনে ভাবি, কি জানি বাবা তুমি ভূত কিনা, অমন মুলোর মত দাঁত আর কুলোর মত কান কেন তোমার? আমার গা শিরশিরিয়ে ওঠে লোকটার ভাঁটার মত চোখ দেখে আর গায়ে কি একটা বিকট গন্ধ।
তা হতে পারে সব ভূতগুলো ওর পিঠের ওই বস্তায় কিনা। ভূতেদের গায়ে শুনেছি একটা বিজাতীয় গন্ধ বের হয়।
সে যাকগে, অনেক ভেবে ঠিক করলাম একটা কেজো ভূত কিনব। এমনিতে একটু আধটু লেখালেখি করি, তাই অনেক সময় কাজ করার সময় পাই না। ভূত যদি কাজকর্মগুলো সেরে দেয়, আমার খুব উপকার হবে। লোকটা অভয় দেয়, বাবু, এ আপনার সমস্ত কাজ করবে, কোন সময় একটু বসতে পারবে না। আপনাকে ওকে সারাক্ষণ কাজ দিয়ে রাখতে হবে। আর এদের বয়স চারশ বছরের উপরে, ছানা ভূত কেউ নয় এরা। আমিও ভাবলুম, যাক বাপু, শিশুশ্রমিক দিয়ে তো আর কাজ করাচ্ছিনা।
তা সে আর এমন কি কথা। কাজতো মেলাই থাকে, করবে এখন। শেষকালে ঠিক তিনশ তিন টাকা দিয়ে একটা জম্পেশ কেজোভূত কিনে ফেললাম। আর আমার এমন প্রগতিতে আমি নিজে যারপর নাই খুশি হলাম। তিনটে একশ টাকার কড়কড়ে নোট আর তিনটি এক টাকার কয়েন গুনে নিয়ে লোকটা বোতল থেকে কি যেন বের করে ঘরের কোণে ছেড়ে দিয়ে সেই যে হাঁটা দিল, আর এমুখো হলো না।
ও মাগো, ওটা কি! এইটুকু একটা ছাই রঙের জেলির মত। ওমা ওইতো একফুট উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রণাম করলো? নমস্কার? আমিও প্রতিনমস্কার করি। হা বাপু কেজো ভূত, নমস্কার। যাও বাবা ঘরদোর বেশ পরিস্কার করে ফেলোতো। একা থাকি, লোকজন রাখার ঝামেলা নিইনা। কেজো ভূত চোখের সামনে থেকে উধাও হলো। ঠিক দশ মিনিটে আমার বাড়ি একেবারে ঝকঝকে তকতকে। এমন পরিষ্কার যে নিজের ছবি ঘরের লাল মেঝেতে দেখে আমি প্রায় চমকে উঠেছিলাম। আমার আর কিচ্ছু বলার নেই। ভূতওয়ালাকে মনে মনে খুব আশির্বাদ করলাম। আর মিষ্টি জেলিপারা ওই কেজো ভূতটিকে মনে মনে চুমো দিলাম।
মুখে অবশ্য বললাম, বেশ করেছ।
এরপর যাই কাজ দিই নিমেষের মধ্যে সারা।
বলব কি আমাকে রাতে যা ভালো রুটি আর আলুর দম করে খাওয়ালে, আমি, অমন আলুরদম, মা গত হবার পর থেকে আর খাইনি। কেজো তো কিচ্ছু খায়না বলে গেছে লোকটি, বাবু ওরা ‘বায়ুভুক নিরাশ্রয়’ প্রাণী, এই আপনি ওকে আশ্রয় দিলেন, খুব ভালো হোক আপনার।
এরপর একটু মুশকিলে পড়লাম। জামাকাপড় কাচা, রান্নাবান্না করা, একতলার ছাদের এক টুকরো ঘরের জমা জিনিস পরিষ্কার করা, কুয়ো থেকে জল তোলা, উনুন পরিষ্কার করা, আমাকে পিঠ মালিশ করা সেরেও যখন ভূতের এনার্জি অটুট তখন আমার প্রায় কাজ দেওয়ার ক্ষমতা শেষ হয়ে আসছে। কি করি, কি করি। বেজায় বিপাকে পড়লাম, কাজ না পেলে কি করবে জানা নেই. ঘাড় মটকাবে কিনা কে জানে। তখন আমার নিরেট মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। আমি একা মানুষ বলে মনে একটু দু:খু টুঃখু আছে, সে সব চেপেচুপে রাখি। সটান শুয়ে পড়ে কেজো ভূত কে হুকুম করলাম কেজো ভূত, আমার মনের দুঃখগুলো একে একে বার করতে পারো? সে আর দ্বিরুক্তি না করে লেগে গেল দুঃখু বের করার কাজে।
হলো কি, একটা একটা করে দুঃখু টেনে টেনে বের করে সে আর আমার আরামে চোখ জুড়িয়ে যায়। মনে হয় বুকের ভেতর একটা সুখের পালককে বুলিয়ে দিচ্ছে যেন। সেই ইস্তক অন্য কাজ শেষ হয়ে যাবার পর, কেজো এখন যা দুঃখু জমা হয় বের করে দেয়। এই করে করে আমার যদি আর দুঃখই না থাকে? তাইতো ভাবছি কি করা যায়। আমি ভাবছি সব দুঃখী মানুষদের ডেকে তাদের দুঃখগুলো বের করবার কাজে লাগাবো কেজো ভূতকে। ভালো লাগাও হবে আর মানবসেবাও হবে। কি বল, তোমরা?