তরুণীদের দিয়ে ফাঁদে ফেলে ‘ব্ল্যাকমেইলিং’

51

সুন্দরী তরুণীদের ব্যবহার করে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ব্যবসায়ী-চাকরিজীবী-বিত্তশালীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র। নগরীতে অহরহ এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও ভুক্তভোগীরা লোকলজ্জার ভয়ে তা চেপে যান। চক্রের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, বেকার যুবকরাও রয়েছেন। এ চক্রে বেশ কয়েকজজন তরুণী-যুবতী রয়েছেন। গত এক বছরে এ চক্রের ৩০ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হলেও থেমে নেই প্রতারণা। সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার আকবরশাহ থানা এলাকা থেকে তিন যুবককে আটক করে পুলিশ। এ তিনজনই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। ৯৯৯ নম্বরে ফোন করার পর পুলিশের হাতে ধরা পড়ল চক্রের এ তিন সদস্য।
জানা যায়, এক নারীকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মাধ্যেেম টাকা আদায়ের চেষ্টার তিন যুবককে আটক করে পুলিশ। ৯৯৯ নম্বরের মাধ্যমে জানতে পেরে পুলিশ গিয়ে তাদের আটক করে। একটি ওষুধ কোম্পানির এক কর্মকর্তাকে কৌশলে বাসায় ডেকে জিম্মি করে টাকা আদায়ের অভিযোগে ওই তিনজনকে আটক করে খুলশী থানা পুলিশ।
গতকাল সকালে নগরীর বিশ্বকলোনির ডি-ব্লকের একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে ওষুধ কোম্পানির ওই কর্মকর্তাকেও উদ্ধার করা হয়। ওই বাসা থেকে দুইজনসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন আকবারশাহ থানার মনছুরাবাদ এলাকার শামসুল আলমের ছেলে ইফতেখারুল আলম (২৫), সন্স্বীপের শিবেরহাট এলাকার শাহাবউদ্দিনের ছেলে তালিম উদ্দিন (২৪) ও পটিয়ার উত্তর গোবিন্দরখিল এলাকার ওসমান গণির ছেলে সালেহীন আরাফাত (২৮)। তিন যুবকই বিশ্বকলোনি এলাকার অভিজাত পরিবারের সন্তান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। তারা একটি ব্ল্যাকমেইলিং চক্রের সদস্য বলে জানিয়েছে পুলিশ। এই ঘটনায় হাসান তারেকের বোন প্রেসিডেন্সি স্কুলের শিক্ষিকা শারমিন ফারজানা বাদি হয়ে মামলা দায়ের করেছেন।
উদ্ধার হওয়া ব্যক্তির নাম হাসান তারেক (৩৭)। তিনি নগরীর পাঁচলাইশ থানার রহমান নগরের হাতিম বিল্ডিংয়ের বাসিন্দা মোফাজ্জল আহমেদের ছেলে। হাসান তারেক রেনেটা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে কর্মরত।
অভিযান পরিচালনকারী খুলশী থানার এসআই খাজা এনাম এলাহী বলেন, তথ্য পাওয়ার পর আমরা তারেকের এক স্বজনকে নিয়ে অভিযানে যাই। ওই স্বজনকে চেক নিয়ে অপহরণকারীর কাছে পাঠাই। পাশে ছদ্মবেশে আমাদের টিম অবস্থান নেয়। চেক নিয়ে যাওয়ার সময় আমরা এক ব্যক্তিকে আটক করি। পরে তার দেওয়া তথ্যমতে আকবরশাহ থানার বিশ্বকলোনির ডি বক্লের একটি বাসা থেকে আরো দুইজনকে আটক করা হয়। অপহৃত যুবককেও অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। ইসরাত নামে ওই মহিলাকে আটক করা যায়নি।
পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ইফতেখারুল আলম চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে ইসলামের ইতিহাস বিভাগের অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। তালিম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউএসটিসিতে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ষষ্ঠ সেমিস্টারের ছাত্র। সালেহিন আরাফাত আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। পাশাপাশি সালেহীন তার বাবার সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানেও কাজ করেন।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে খুলশী থানার ওসি প্রণব চৌধুরী বলেন, দুই সপ্তাহ আগে হাসান তারেক কোম্পানির কাজে বিশ্বকলোনিতে যান। সেখানে ইশরাত নামে এক মেয়ের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তাদের মধ্যে মোবাইল ফোনে কথাবার্তা হতো। গত বৃহস্পতিবার রাতে মেয়েটি হাসান তারেককে বিশ্বকলোনির ডি-ব্লকের নিজ বাসায় ডেকে নিয়ে যায়। বাসায় যাওয়ার পর চার যুবক সেখানে প্রবেশ করে এবং তাকে মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে জিম্মি করেন। মুক্তি পেতে হাসান তারেক প্রথমে বিকাশের মাধ্যমে ২৪ হাজার টাকা দেন। কিন্তু এতে সন্তুষ্ট হননি তারা। আরও টাকা দাবি করলে ভোরের দিকে হাসান তারেক তার ছোট বোনকে দুটি চেক নিয়ে খুলশীতে ইউএসটিসির সামনে আসতে বলেন। এসময় হাসানের কণ্ঠস্বর শুনে বোনের সন্দেহ হলে তিনি ৯৯৯-এ ফোন করে পুলিশের সহযোগিতা চান। এরপর খুলশী থানার একটি টিমও ছদ্মবেশে ইউএসটিসির সামনে অবস্থান নেয়। তালিম চেক নিতে এলে পুলিশ তাকে হাতেনাতে ধরে ফেলেন। এরপর তার দেওয়া তথ্যমতে ওই বাসায় অভিযান চালিয়ে হাসানকে উদ্ধার করা হয় এবং অপর দু’জনকেও আটক করা হয়। তবে ইসরাত পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নগরীতে দীর্ঘদিন ধরে একটি চক্র সক্রিয় রয়েছে। এ চক্রে অর্ধশতাধিক সদস্য রয়েছে। তারা নগরীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
এ চক্রে যুবক-তরুণদের পাশাপাশি রয়েছে নারী সদস্যও। এ কাজে তারা নারী সদস্যদের ব্যবহার করে। কোন সামাজিক বা অন্য কোন অনুষ্ঠানাদিতে নিজে গিয়ে পরিচিত হয় এসব তরুণী-যুবতীরা। ফোন নাম্বারও দিয়ে আসেন। এরপর শুরু হয় ফোনালাপ। এক পর্যায়ে প্রেমের অভিনয় শুরু হয়। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পরিচয় ঘটে নারীদের সাথে। এ চক্রের সদস্যরা ফেসবুকে প্রেমের অভিনয় করে। তারপরই শুরু হয় আসল কাজ।
চক্রের সদস্যরা নারী সদস্যদের মাধ্যমে প্রেমের ফাঁদে ফেলে বাসায় ডেকে আনেন। তারপর চক্রের সদস্যরা ওই নারীর সাথে জোরপূর্বক অশ্লীল ছবি তুলে, ভিডিও ধারণ করে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে আদায় করে অর্থ। উপস্থিত তার কাছে যা আছে তা ছাড়াও মোবাইলে পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে টাকা নিয়ে আসা হয়। চাহিদামত টাকা পেলে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। লোকলজ্জার ভয়ে অনেকেই তা প্রকাশ করেন না।
খুলশী থানার ওসি প্রণব চৌধুরী জানান, গ্রেপ্তারকৃতরা স্বীকার করেছেন, তারা আরো কয়েকজন লোককে প্রেমের ফাঁদে ফেলে এনে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। শহরজুড়ে তাদের সদস্যরা রয়েছেন। টাকা হাতিয়ে নেয়াই তাদের কাজ।
জানা যায়, স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে নগরের বিভিন্ন এলাকায় বাসা ভাড়া নেন তারা। তাদের বাসার ড্রইংরুমে হালকা আসবাবপত্র থাকলেও বাকি রুমগুলোতে কোনো কিছু থাকে না। আসলে তারা স্বামী-স্ত্রী নয়।
চলতি সালের মে মাসে কোতোয়ালী থানা পুলিশ চান্দগাঁও এলাকায় অভিযান চালিয়ে এ চক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছিল। তারা হলেন মো. নাসির উদ্দিন, প্রদীপ দাশ, হাসিনা আক্তার প্রকাশ মুক্তা ও ছালেহা আক্তার। তারা এক ব্যবসায়ীকে ব্ল্যাকমেইলিং করে ৪ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছিল। এক নারীকে ব্যবহার করে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ব্ল্যাকমেইলিং করছিল তারা।
কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন বলেন, নগরীতে এধরনের একটি চক্র তৎপর রয়েছে। চক্রটি নানাভাবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে। এর মধ্যে চক্রের নারী সদস্যরা বিভিন্ন ব্যবসায়ীসহ বিত্তবান শ্রেণির লোকজনকে টার্গেট করে মোবাইলে ফোন করে কিংবা ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। পরে নানা প্রলোভন দেখিয়ে ওই ব্যক্তিকে তাদের বাসায় নিয়ে আসেন। বাসায় আনার পর ওই ব্যক্তির সঙ্গে অশ্লীল ছবি ও ভিডিও ধারণ করে। পরে এসব ছবি ও ভিডিও স্বজনদের দেখানো ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করেন। ভয়ে ভুক্তভোগীরা টাকা দিয়ে পালিয়ে বাঁচেন। তারা লোকলজ্জার ভয়ে ঘটনাটি চেপে যান। এর আগে মার্চ মাসে পাঁচলাইশ থানাধীন চশমা হিল এলাকার একটি বাসা থেকে এ চক্রের ৫ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে কোতোয়ালী থানা পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন দিদারুল ইসলাম (৩৬), ফাতেমা ইয়াছমিন নিশি (২৭), বিথিত মাহমুদ মোস্তফা সিফা (২২), আনোয়ার হোসেন (৪০) ও রাকিব আল ইমরান (২৪)।
২ মার্চ রাত ১০টার দিকে ইমরান নামের এক ব্যবসায়ীকে কাজীর দেউড়ি এলাকায় পুলিশ পরিচয়ে সিএনজি অটোরিকশা থামিয়ে তুলে নিয়ে যায় ওই চক্রের সদস্যরা। এরপর চোখ বেঁধে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাকে পাঁচলাইশ থানাধীন চশমা হিল এলাকার একটি ভাড়া বাসায় উঠান তারা। সেখানে দুই নারীর সঙ্গে জোর করে আপত্তিকর অবস্থায় ছবি তোলা হয়। এসব ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হবে এবং প্রাণে মেরে ফেলা হবে-এমন ভয় দেখিয়ে ২ লক্ষ টাকা দাবি করা হয়। বিকাশের মাধ্যমে ৫০ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে ৩ মার্চ বিকেল ৫টার দিকে ছাড়া পান ইমরান।
পুলিশ জানতে পেরেছে, নগরীতে এ চক্রে অর্ধশতাধিক সদস্য রয়েছে। তারাই কৌশলে ব্ল্যাকমেইলিং করে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।
কোতোয়ালী থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন বলেন, এ চক্রের অনেক সদস্য ধরা পড়েছে। বাকিদের ধরার জন্য ফাঁদ পাতা আছে। তারাও ধরা পড়বে।
খুলশী থানার ওসি প্রণব চৌধুরী বলেন, তাদের ফাঁদে পড়ে অনেকে লাখ লাখ টাকা হারাচ্ছেন। এ চক্রের সন্ধানে আমরা কার্যক্রম চালাচ্ছি।