ঢাকে কাঠি পড়লো প্রাণ ফিরেছে প্রতিমার

28

রাহুল দাশ নয়ন

দশভূজা দেবি বোধনের মধ্য দিয়ে ঢাকে কাঠি পড়েছে। প্রাণ ফিরেছে প্রতিমার। মন্ডপে মন্ডপে বাজছে কাঁসার ঘন্টা, উলুধ্বনি। মাইকে বাজছে ‘বাজল তোমার আলোর বেণু’। প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় যেন উৎসবের রঙ লেগেছে। ছড়িয়ে পড়ছে উৎসবের আবহ। মহালয়ার পর থেকে ক্ষণগণনা শুরু হলেও মূল পূজা শুরু হচ্ছে আজ। ষষ্ঠীর সকাল থেকেই ঠাকুর দেখা, নতুন জামাকাপড়, হৈ-হুল্লোড়, আতশবাজি ও নারিকেলের নাড়–র আয়োজনে বারোয়ারির নান্দনিকতা মিশবে দুর্গোৎসবে। বাঙালি হিন্দুদের প্রধান এই ধর্মীয় উৎসব দশমী ও প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে ৫ অক্টোবর শেষ হবে। তবে পূজার রেশ থাকবে আরও কয়েকদিন লক্ষীপূজা পর্যন্ত। দুর্গাপূজা উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পৃথক বাণীতে দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
কলকাতায় দুর্গাপূজাকে ইউনেস্কোর ইনট্যানজিবল হেরিটেজের স্বীকৃতি প্রদান করায় উৎসবের রেশ ছুঁয়েছে বাংলাদেশেও। আনন্দের এই উৎসবে এবারও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের আশঙ্কা থাকায় প্রশাসনের তৎপরতা রয়েছে। প্রতিটি পূজামন্ডপ ঘিরে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। সারাদেশের মতো চট্টগ্রামেও এবার প্রায় দুই হাজার পূজামন্ডপ উৎসবে মাতোয়ারা থাকবে। সতর্ক অবস্থানে আছে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
পঞ্জিকা মতে, জগতের মঙ্গল কামনায় দেবি দুর্গা এবার গজে (হাতি) চড়ে কৈলাশ থেকে মর্ত্যালোকে (পৃথিবী) আসবেন। এতে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঝড়-বৃষ্টি হবে এবং শস্য ও ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে কৈলাশে (স্বর্গে) বিদায় নেবেন নৌকায় চড়ে। যার ফলে জগতের কল্যাণ সাধিত হবে।
নগরীর দক্ষিণ নালাপাড়া পূজামন্ডপ ঘুরে দেখা যায়, নালাপাড়ার আয়োজকরা এবার হীরক জয়ন্তী উপলক্ষে জমকালো আয়োজন করেছে। যার নাম দিয়েছে ‘পার্বণ’। বাঁশ ও বেতের আবরণে পুরো মন্ডপ প্রাঙ্গণ সাজানো হয়েছে। আকর্ষণীয় প্রতিমাও বানিয়েছে। বেড়ার ঘরে যেন বসতি গড়েছে দেবি দুর্গা। বাড়ির সামনে বিস্তীর্ণ উঠান। গ্রামীণ ঐতিহ্যকে ধারণ করে সামিয়ানায় টাঙানো হয়েছে বাঁশের ঝুড়ি। মাছ ধরার পলোর ভেতরে আলোর বাতি। দুই পাশে প্রাচীর ঘরে পাহাড়িদের যাপিত জীবনের উপস্থিতি। থামি পড়া পরিশ্রমী নারীর প্রতিচ্ছবিই যেন ফুটে উঠেছে এই মন্ডপে। এই পূজামন্ডপটি এবার আকর্ষণীয় হয়েছে বেশি। নগরীর প্রতিটি মন্ডপই নানা রঙে রাঙানো হয়েছে।
এমন আনন্দ আয়োজনেই শঙ্কা যেন ছাড়ছে না আয়োজকদের। গতবারের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অপচেষ্টা এবারের পূজার আনন্দে যেন কিছুটা ভাটা পড়েছে। যদিও প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পূজা উদযাপন পরিষদের সাথে বৈঠকে সম্প্রীতি রক্ষায় আশ্বস্থ করেছেন। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে ‘সাবর্বজনীন আইনশৃঙ্খলা কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও উপজেলা ও থানা পর্যায়ে সামাজিক সম্প্রীতি সমাবেশ হয়েছে। গঠিত হয়েছে সম্প্রীতির কমিটি, এসব সমাবেশে পূজায় যাতে কোন অপ্রীতিকর ঘটনার সৃষ্টি না হয় সেই বার্তায় দেয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি আশীষ কুমার ভট্টচার্য্য পূর্বদেশকে বলেন, মহানগরে এবার ২৮২টি পূজা হবে। ইতোমধ্যে আমরা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে পূজার নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা সবখানে আশঙ্কার কথা জানিয়েছি। সুন্দরভাবে পূজা হবে বলে সবাই আমাদেরকে আশ্বস্থ করেছেন। আমরা পূজার নিরাপত্তায় প্রশাসনের সহযোগিতা চাইছি। এবারের দুর্গাপূজা প্রতিবারের মতো যাতে সবার উৎসব হয়ে আসে সে প্রত্যাশা করছি।
প্রতিমা শিল্পী পরিতোষ পাল বলেন, গতকাল (শুক্রবার) সন্ধ্যার মধ্যে মন্ডপে মন্ডপে প্রতিমা পৌঁছে গেছে। গ্রামে বানানো প্রতিমাগুলো আগেভাগেই রঙ করে প্রাণ ফেরানো হয়েছে। প্রতিটি মন্ডপেই বসে গেছে প্রতিমা।
রাষ্ট্রপতির বাণী: রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ শারদীয় দুর্গোৎসবের আনন্দে সকলের শামিল হওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। বাঙালি হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। দুর্গাপূজার সাথে মিশে আছে চিরায়ত বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। আবহমানকাল ধরে এদেশের হিন্দু সম্প্রদায় বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও উৎসবমুখর পরিবেশে নানা উপচার ও অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে দুর্গাপূজা উদযাপন করে আসছে। দুর্গাপূজা কেবল ধর্মীয় উৎসব নয়, সামাজিক উৎসবও। দুর্গোৎসব উপলক্ষে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পরিবার-পরিজন, পাড়া-প্রতিবেশী একত্রিত হন, মিলিত হন আনন্দ-উৎসবে। তাই এ উৎসব সার্ববজনীন। এ সার্ববজনীনতা প্রমাণ করে, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’। ধর্মীয় উৎসবের পাশাপাশি দুর্গাপূজা দেশের জনগণের মাঝে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও ঐক্য সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শারদীয় দুর্গোৎসব সত্য-সুন্দরের আলোকে ভাস্বর হয়ে উঠুক, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার মধ্যে স¤প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে বন্ধন আরো সুসংহত হোক। তবে শারদীয় দুর্গোৎসবের আনন্দে সকলেই যাতে শামিল হতে পারে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
আজ শনিবার ১ অক্টোবর থেকে শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু হচ্ছে জেনে সন্তোষ প্রকাশ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে আমি হিন্দু ধর্মাবলম্বী সকলকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিন্দন। প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও সারাদেশে যথাযথ উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদির মধ্য দিয়ে সাড়ম্বরে দুর্গাপূজা উদযাপিত হচ্ছে জেনে আমি আনন্দিত।
আবদুল হামিদ বলেন, মানবতা সকল ধর্মের শাশ্বত বাণী। ধর্ম মানুষকে ন্যায় ও কল্যাণের পথে আহবান করে, অন্যায় ও অসত্য থেকে দূরে রাখে, দেখায় মুক্তির পথ। তাই ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার পাশাপাশি ‘আমাদেরকে মানবতার কল্যাণে এগিয়ে আসতে হবে। করোনা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের কারণে গোটা বিশ্বের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিশ্বব্যাপী দেখা দিয়েছে মূল্যস্ফীতির উর্ধ্বগতি। এর ফলে নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ নানা সীমাবদ্ধতার মাঝে দিনাতিপাত করছে। রাষ্ট্রপতি সমাজের দুস্থ ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের প্রতি আহবান জানান। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাঙালির চিরকালীন ঐতিহ্য। সম্মিলিতভাবে এ ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিতে হবে ‘আমাদের সামগ্রিক অগ্রযাত্রায়’।
রাষ্ট্রপতি প্রত্যাশা করেন, আবহমান বাঙালি সংস্কৃতিতে ঋদ্ধ অসাম্প্রদায়িক চেতনা, পারস্পরিক ঐক্য, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে উদ্বুদ্ধ করুক, জয় হোক বিশ্ব মানবতার। রাষ্ট্রপতি শারদীয় দুর্গোৎসবের সফলতা কামনা করেন।
প্রধানমন্ত্রীর বাণী: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন অটুট রেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও সুখী-সমৃদ্ধ স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার আহবান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আসুন, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন অটুট রেখে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও সুখী-সমৃদ্ধ স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলি।
প্রধানমন্ত্রী আগামীকাল শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে আজ এক বাণীতে এ আহবান জানান। এ উপলক্ষে তিনি দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী সকল নাগরিককে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, দুর্গাপূজা শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসবই নয়, এটি এখন সার্ববজনীন উৎসব। অশুভ শক্তির বিনাশ এবং সত্য ও সুন্দরের আরাধনা শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আবহমান কাল ধরে বাংলাদেশ সাম্প্রীদায়িক সম্প্রীতির দেশ। ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’- এ মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে বাংলাদেশে আমরা সব ধর্মীয় উৎসব একসঙ্গে পালন করি। আমাদের সংবিধানে সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষের সমান অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে। সকলে মিলে মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছি। এদেশ আমাদের সকলের। বাংলাদেশ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের নিরাপদ আবাসভূমি। প্রত্যেকে যার যার ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবার উন্নয়ন করে যাচ্ছে। সব ধর্মের মানুষ সমভাবে উন্নয়নের সুফল উপভোগ করছে।
সরকার করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছেন এবং জনগণকে সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সবাইকে একে অপরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে হবে। এছাড়াও সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শারদীয় দুর্গোৎসব উদযাপনের অনুরোধ জানান তিনি। দুর্গাপূজা উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী হিন্দু ধর্মাবলম্বীসহ সকল নাগরিকের শান্তি, কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করেন।