ড. নিরঞ্জন ধর

9

 

ড. নিরঞ্জন ধর, একজন যুক্তিবাদী সমাজবিজ্ঞানী ও মানবতাবাদী ঐতিহাসিক। নিরঞ্জন ধর দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার ডায়মন্ড হারবারের হটুগঞ্জে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা যোগেশচন্দ্র ধর ছিলেন হটুগঞ্জ স্কুলের প্রধান শিক্ষক। মাতার নাম অমিয়বালা ধর। নিরঞ্জন ছিলেন এঁদের ছয় পুত্রের দ্বিতীয় সন্তান। পিতার আদি বাড়ি ছিল তৎকালীন পূর্ব বাংলার ফরিদপুর জেলার বিনতিলক গ্রামে। কর্মসূত্রে ডায়মন্ডহারবারের হটুগঞ্জে আসেন। নিরঞ্জন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে বি.এ. পরীক্ষা সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেন। ইতিহাস ও বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। দুটি বিষয়েই প্রথম স্থান অধিকারী হিসাবে স্বর্ণ পদক লাভ করেন।
কলকাতার রিপন কলেজে (বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে) অধ্যাপনা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। কিছুকাল সরকারি এডুকেশন সার্ভিসে যোগ দিয়ে কালিম্পং এর জনতা কলেজে অধ্যাপনা করেন। পরবর্তীতে স্বাধীনতার পর উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বাণীপুরে নবগঠিত ‘বেসিক ট্রেনিং কলেজে’ যোগ দিয়ে অবসর অবধি (১৯৫৬ – ৭২) সেখানেই অধ্যাপনা করেন । অধ্যাপনাকালেই ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পি এন ব্যানার্জির তত্ত্বাবধানে অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গবেষণা করে পি.এইচ.ডি লাভ করেন। গবেষণাপত্রের বিষয় ও শিরোনাম ছিল – The Administrative System of the East India Company in Bengal : ১৭৪৬ – ১৭৮৬। উচ্চ প্রশংসিত হওয়ায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘Griffith Scholar’ সম্মানে ভূষিত করে।
স্নাতকোত্তর পঠনপাঠনের সময়ই নিরঞ্জন ধর মানবেন্দ্র নাথ রায়ের Radical Democratic Part’ র বিশ্বস্ত সদস্য হন। মিতভাষী, আত্মমগ্ন, শান্ত ও বিনয়ী স্বভাবের এই স্থিতধী মানুষ সেই অর্থে activist হয়ে ওঠেন নি। মনোযোগী শ্রোতা হয়ে সুকৌশলে কলমের ব্যবহার করেছেন। মানবেন্দ্র নাথ রায়ের Independent India পত্রিকায় তার প্রথম লেখা Trojan Horse প্রকাশিত হয় । তিনি সেই সময় ইংরাজীতে বেশি লিখতেন। তার লেখা ‘Vedanta and Bengal Renaissance’ বইটি ইতিহাস ও সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্র ও গবেষকদের কাছে এবং গণবিজ্ঞানকর্মী, বামপন্থায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সকল কর্মীদের পাঠযোগ্য মূল্যবান সম্পদ। কারোর অনুরোধ বা অনুপ্রেরণায় মাঝে মধ্যে বাংলায় প্রবন্ধ রচনা করতেন। গোঁড়া রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দভক্ত পরিবারের ছেলে হলেও ‘জিঞ্জাসা’ ও ‘উৎস মানুষ’ পত্রিকায় প্রকাশিত রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ রাণী রাসমণি, নিবেদিতা, অরবিন্দ, চৈতন্য ও চৈতন্য পরবর্তী ‘হরে কৃষ্ণ আন্দোলন’ প্রভৃতির উপর তথ্য ও বস্তুনিষ্ঠ নির্মোহ দৃষ্টিতে তার যুক্তিবাদী লেখা তুমুল আলোড়ন তুলেছিল। বস্তুনিষ্ঠ গবেষণায় মনীষীবৃন্দের মূল্যায়ন কিভাবে করা যায় তা শিখিয়েছেন। তখনকার সময়ে, বলা বাহুল্য, এটি ছিল অত্যন্ত কঠিন এক বৈপ্লবিক প্রয়াস। ‘বিবেকানন্দ অন্য চোখে’ গ্রন্থটি তার উল্লেখযোগ্য উপস্থাপনা। প্রখ্যাত গবেষক-অধ্যাপক নৃসিংহ প্রসাদ শীল নিরঞ্জন ধর সম্পর্কে শিখেছেন – স্বামীজির পুনর্মূল্যায়নের ব্যপারে তার অবদান অবিস্মরণীয়। আমি আমার ‘Ramakrishna Revisited : A New Biography (1998)’ বইটি অধ্যাপক ধরের নামে উৎসর্গ করেছিলাম। কারণ, তিনি ছিলেন আমার সত্যিকারের গুরু-ঐতিহাসিক পুনর্মূল্যায়নের পরিপেক্ষিতে। তার সব লেখা নতুন প্রজন্মের ঐতিহাসিকদের অবশ্যপাঠ্য হওয়া দরকার। কেননা অধ্যাপক নিরঞ্জন ছিলেন এবং চিরদিন থাকবেন, এক কিংবদন্তিসম Humanitarian Historian হয়ে।
প্রকাশতি পুস্তকাবলি : *Vedanta and Bengal Renaissance * Aurobinda Gandhi & Roy* বিবেকানন্দ : অন্য চোখে * রামকৃষ্ণ- অন্য চোখে * অবতার থেকে মানুষ। অকৃতদার নিরঞ্জন ধর ২০০২ খ্রিস্টাব্দের ৮ই মার্চ ৭৩ বৎসর বয়সে প্রয়াত হন । সূত্র : উইকিপিডিয়া