জয় বাংলা প্রশ্নে আপস নেই

45

ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়ে সংসদে গিয়ে নিজের জীবনের গত ১৮টি বছরকে ‘রাজনৈতিক কারাগার’ বলেছেন সুলতান মো. মনসুর আহমেদ।
একাদশ সংসদের সদস্য হিসেবে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে শপথ নেওয়ার পর বিকালে গণফোরাম থেকে বহিষ্কৃত হয়ে সন্ধ্যায়ই সংসদ অধিবেশনে যোগ দেন ভোটে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে জয়ী এই নেতা।
১৯৯৬ সালের সংসদে নৌকা প্রতীক নিয়ে মৌলভীবাজার-২ আসনে প্রতিনিধিত্ব করা সুলতান মনসুর এবার আইনসভায় বসেছেন বিরোধী দলের আসনে দ্বিতীয় সারিতে।
সংসদে যোগ দিয়েই এক অনির্ধারিত আলোচনায় দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, আমার আজকে ওইখানে (সরকারি দল) থাকার কথা ছিল। ওই জোটের (সরকারি দলের জোট) পক্ষেই তো আমি রাজনীতি করতাম। আজ থেকে ১৮ বছর আগে এই সংসদে আসার সুযোগ হয়েছিল।
কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস রাজনীতির ছন্দপতনের কারণে হয়ত আল্লাহ তায়ালা কোনো কারণে .. আমি গত ১৮ বছর একটি রাজনৈতিক কারাগারের মধ্যে ছিলাম। যদিও এমপি ছিলাম না বা এই সংসদে ছিলাম না।
ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মনসুর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকও হয়েছিলেন। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর সংস্কারপন্থি তকমা পাওয়ার পর দলে অপাঙক্তেয় হয়ে পড়েন তিনি।
কিছু দিন নিষ্ক্রিয় থাকার পর আওয়ামী লীগেরই এক সময়ের নেতা কামাল হোসেনের সঙ্গে যোগ দেন তিনি। একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে কামাল বিএনপিকে নিয়ে জোট গঠন করলে তাতে তিনিও সক্রিয় হন। ঐক্যফ্রন্টের হয়ে ধানের শীষ প্রতীকে প্রার্থীও হন তিনি।
কিন্তু এই ভোটে ঐক্যফ্রন্টের হয়ে মাত্র আটজন জেতার পর ভোট ডাকাতির অভিযোগ তুলে জোটের পক্ষ থেকে সংসদে না যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলেও তাতে আপত্তি জানান সুলতান মনসুর।
দলের হুমকি উপেক্ষা করেই বৃহস্পতিবার শপথ নেন তিনি। এই কারণে বিএনপি তাকে বলেছে ‘ছলনাকারী’। ‘প্রতারক’ আখ্যায়িত করে তাকে বহিষ্কার করেছে গণফোরাম।
ওই বহিষ্কারাদেশের পরই সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদের বৈঠক শুরু হলে সুলতান মনসুরকে দেখা যায় অধিবেশন কক্ষে। খবর বিডিনিউজের
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে আলোচনায় দাঁড়িয়ে সুলতান মনসুর বলেন, আজকে যাকে নিয়ে আলোচনা ১৯৬৭-৬৮ সালে স্কুলছাত্র থাকা অবস্থায় যার নামে স্লোগান দিয়ে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলাম, সেই বিশ্বাস থেকে ব্যক্তিগতভাবে বিচ্যুৎ হইনি।
যদিও জোটগতভাবে বা রাজনৈতিকভাবে বা আমার আজকের অবস্থানে হয়ত আমাদের নেতাদের ওই জোটে নেই কিন্তু আমি রাজনৈতিকভাবে বিশ্বাসের যায়গা থেকে ৫২ বছর আগে বিশ্বাস নিয়ে রাজনীতি শুরু করেছিলাম, সেই বিশ্বাসের জায়গা থেকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অবস্থানে থেকে নির্বাচন করে এই সংসদে এসেছি।
সুলতান মনসুর বলেন, ৭ মার্চ আমি শপথ গ্রহণ করেছি। এই ঐতিহাসিক দিনে সংসদে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পেয়েছি। এই সংসদে আমার নেতা আছেন। সহকর্মী আছেন। আমার কর্মীও আছেন। অনেক ভাই-বোনেরা আছেন। এখানে সংসদ নেত্রী আছেন, যার ঘনিষ্ঠ হয়ে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছিল।
শপথ নেওয়ার পর সুলতান মনসুর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, জোটের শীর্ষ নেতা অর্থাৎ কামাল হোসেনকে ‘জানিয়েই’ তিনি শপথ নিয়েছেন।
তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সংবাদ সম্মেলনে এসে সুলতান মনসুরকে গণফোরাম থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দলটির সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু বলেন, কামাল হোসেনের ‘নির্দেশেই’ এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগের একচেটিয়া আধিপত্যের মধ্যে বিরোধী জোটের প্রার্থী হয়ে ভোটে বিজয়ী সুলতান মনসুর বলেন, অপ্রিয় হলেও সত্য এই সংসদে আজ যারা আছেন তারা একই জোটের পক্ষ থেকে নির্বাচিত হয়েছে। আমিই বোধ হয় একজন নীলমনি- এই জোটের বাইরে অন্য জোটের পক্ষ থেকে নির্বাচিত হয়েছি।
শত প্রতিকূলতার মধ্যেও নির্বাচনী এলাকার মানুষের ভোটে নির্বাচিত হয়ে এসেছি। সরকার প্রধান হিসেবে সংসদ নেতাকে ধন্যবাদ জানাই অন্তত আমার নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনে সেইভাবে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। অন্য কোথাও ঘটেছে, না ঘটেছে, তা অন্যদের বিবেকের আদালতে নিজেরাই বলতে পারবেন।
সুলতান মনসুর বলেন, মহাজোটের বিরোধী বিএনপিসহ অন্যরা আমাকে ভোট দিয়েছে, এটা ঠিকই। কিন্তু বঙ্গবন্ধু-জাতির পিতার অনুসারী সর্বস্তরের জনগণ আমাকে ভোট দিয়ে এই সংসদে পাঠিয়েছেন।

মহাজোটের বিরোধী অন্য জোটের একজন ব্যক্তি হয়ে স্বাধীনভাবে জনগণ ও বাংলার মানুষের কথা যেন বলতে পারি, সাদাকে সাদা, কালোকে কালো যেন বলতে পারি এবং জনগণের কথা বলে সারাজীবন রাজনীতি যেন করতে পারি, সেই সহযোগিতা পাব বলে আশা করি। সংসদ নেত্রীও সেই দিকে বিবেচনা রাখবেন বলে আশা করি।
বিএনপির প্রতীক নিয়ে ভোটের লড়াইয়ে নামলেও মুজিব কোট পরেই প্রচার চালিয়েছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সুলতান মনসুর। সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েও বলেছেন, ‘জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু’।
সংসদে তিনি বলেন, এই সংসদে ৯৯ শতাংশ হচ্ছে একজোটে আর আমি অন্য জোট থেকে রাজনীতি করছি। কিন্তু জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধুর প্রশ্নে কোনো আপস নেই। বাংলাদেশ জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু এক নামে পরিচিত। এখানে অনেকে অনেক কথা বলবেন। অনেক কথা বলেছেন। আগামী দিনের ইতিহাস নির্ণয় করবে আমরা সবাই কীভাবে যাব।
যে লক্ষ্যকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধু দেশকে স্বাধীন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সেই পথে যাচ্ছেন মন্তব্য করে সুলতান মনসুর বলেন, সংসদের নেত্রী জাতীয় ঐক্যের কথা বলেছেন। কাজেই সেই জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করতে হবে। মানুষের আশা আকাক্সক্ষা ও বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করে বঙ্গবন্ধুর মতো জাতীয় মনোভাব নিয়ে এগিয়ে গিয়ে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষাকে বাস্তবায়ন করতে হবে।

এমপি হিসেবে
শপথ নিলেন
সুলতান মনসুর
গণফোরাম থেকে বহিষ্কার

দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে সংসদ সদস্য হিসাবে শপথ নিলেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মনোনয়নে নির্বাচিত সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ। একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে কামাল হোসেনের গণফোরামে নাম লিখিয়ে সুলতান মনসুর ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে মৌলভীবাজার-২ আসন থেকে জয়ী হন।
স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা জাতীয় সংসদ ভবনে তার দপ্তরে তাকে শপথবাক্য পাঠ করান। শপথ নেওয়ার পর সুলতান মনসুর ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে স্পিকারের পাশের নির্ধারিত আসনে বসেন।
ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মনসুর এক সময় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। জরুরি অবস্থার সময় সংস্কারপন্থি হিসেবে দলে অপাঙক্তেয় হয়ে পড়ার পর তিনি কামাল হোসেনের সঙ্গে ভেড়েন।
আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গণফোরাম গঠনকারী কামাল হোসেন কয়েক বছর আগে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া নামে একটি ফোরাম গড়ে তোলেন।
এবার নির্বাচনের আগে বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধার সময় গণফোরাম, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া দুটোই জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেয়।
গত ৩০ ডিসেম্বর ওই নির্বাচনে অংশ নিয়ে মাত্র ছয়টি আসনে জয় পায় বিএনপি। আর গণফোরামের দুটি মিলিয়ে ঐক্যফ্রন্ট পায় মোট আটটি আসন। খবর বিডিনিউজের
নির্বাচনে ‘ভোট ডাকাতির’ অভিযোগ তুলে পুনর্নির্বাচনের দাবি তোলে তারা। নির্বাচিতরা সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেবে না বলেও ঘোষণা দেওয়া হয় বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে।
তবে শপথ নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে সুলতান মনরসুর সে সময় বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ ছাড়ার পর তিনি অন্য কোনো দলে যোগ দেননি।
গণফোরামের প্রার্থীদের মধ্যে সুলতান মনসুর ছাড়াও সিলেট-২ আসন থেকে দলীয় প্রতীক উদীয়মান সূর্য নিয়ে বিজয়ী হন মোকাব্বির খান। সুলতান মনসুরের সঙ্গে মোকাব্বিরও শপথ নেওয়ার আগ্রহের কথা জানিয়ে স্পিকারকে চিঠি দিয়েছিলেন। তবে শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদল করে বুধবার তিনি জানান, তিনি শপথ নিচ্ছেন না। দলের সঙ্গে আলোচনা করে পরে সিদ্ধান্ত নেবেন।
গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু গত রোববার সাংবাদিকদের বলেন, তারা (শপথ নিতে) গেলে অবশ্যই আমরা তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেব। দলীয় সিদ্ধান্ত ও আইনগত সিদ্ধান্ত যা নেওয়া দরকার, সেগুলো আমরা নেব।
মন্টুর ভাষায়, যারা যাচ্ছে তাদের মাথা খারাপ না হলে. যেখানে মূল দল বলছে, না যাওয়ার কথা। সেখানে দলের পরিপন্থি হয়ে এই কাজ করবে, এটা গ্রহণযোগ্য না।
তবে বৃহস্পতিবার শপথ নিয়ে বেরিয়ে সুলতান মনরসুর সাংবাদিকদের সামনে দাবি করেন, শীর্ষ নেতাদের জানিয়েই তিনি শপথ নিয়েছেন।
জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়ার বাকি ৭ জন নির্বাচিত সদস্যকেও শপথ নেওয়ার আহবান জানান মৌলভীবাজার-২ আসনের এই এমপি।
শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সংসদ সচিব জাফর আহমেদ খান। ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া, প্রধান হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী, হুইপ ইকবালুর রহিম এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
সুলতান মনসুরকে গণফোরাম থেকে বহিষ্কার : দলের সিদ্ধান্তের বিপরীতে গিয়ে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেওয়ার পর সুলতান মো. মনসুর আহমেদকে বহিষ্কার করেছে গণফোরাম।
কামাল হোসেনের দল গণফোরামে সুলতান মনসুরের নাম সভাপতিমন্ডলীর তালিকায় থাকলেও তিনি দাবি করে আসছেন, এই দলে তিনি যুক্ত নন।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের হয়ে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী এক সময়ের আওয়ামী লীগ নেতা সুলতান মনসুর বৃহস্পতিবার শপথ নেন।
এরপর বিকালে মতিঝিলে দলীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সুলতান মনসুরকে গণফোরাম থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত জানান দলটির সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু।
তিনি বলেন, সুলতান মনসুর সাহেব আমাদের গণফোরামের সদস্য ছিলেন। আমরা মনে করি যে, গণফোরামের যে গণমুখী নীতি, আদর্শ যেটার সাথে উনি প্রতারণা করেছেন এবং গঠনতন্ত্রের পরিপন্থি কাজ করেছেন।
আমাদের কর্মসূচি, নিয়ম-কানুন, আদেশ-নির্দেশ অমান্য করে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে তিনি (সুলতান মনসুর) জাতীয় সংসদে সদস্য হিসেবে আজকে (বৃহস্পতিবার) শপথ নিয়েছেন। এই জন্য দল, জনগণ ও ঐক্যফ্রন্ট সবাই মর্মাহত এবং ক্ষুব্ধ।
আমরা সুলতান মো. মনসুরকে, যিনি মৌলভীবাজার-২ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছেন, তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করছি। সুলতান মনসুরের বিরুদ্ধে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকিও দিয়েছেন গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক, তবে কী ব্যবস্থা তা স্পষ্ট করা হয়নি।
গণফোরাম বহিষ্কার করলেও সুলতান মনসুরের সংসদ সদস্য হিসেবে টিকে থাকায় তার কোনো প্রভাব না পড়ারই কথা। কেননা সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা আছে- কেউ দল থেকে পদত্যাগ করলে কিংবা সংসদে দলের বিপক্ষে ভোট দিলে সদস্যপদ খারিজ হবে।
সুলতান মনসুরকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য পদ থেকেও অব্যাহিত দেওয়া হয়েছে বলে জানান মন্টু।