জনপ্রত্যাশার দিকে কতটা হাঁটছে চসিক

41

ওয়াসিম আহমেদ

স্থানীয় সরকার বিভাগের সাথে করা বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি অনুসারে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) প্রধান কাজ তিনটি। সেগুলো হলো, নগর এলাকায় রাস্তা, ব্রিজ, কালভার্ট, ফুটপাত নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, বর্জ্য সংগ্রহ ও অপসারণ এবং সড়ক বাতি স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ করা। এসব কাজ ছাড়াও নাগরিকদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে চসিকের রয়েছে দীর্ঘদিনের সুনাম। আজ, শুক্রবার চসিকের ৬ষ্ঠ নির্বাচিত পরিষদের মেয়াদ দুই বছর পূর্ণ হচ্ছে। এ সময়ে মধ্যে মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হওয়ার গল্পের সাথে ডেঙ্গুতে মৃত্যু যেমন রয়েছে তেমনি খোলা নালায় পড়ে প্রাণহানির ঘটনাও রয়েছে। পানিতে ডুবেছে নগর। এসবের জন্য অন্য সংস্থাকে দোষারোপ করে দায় এড়ানোর চেষ্টা নগরবাসীর মাঝে ‘বিরক্তিভাব’ তৈরি করেছে। তবে দীর্ঘদিনের গৃহকর ইস্যু নিয়ে আন্দোলনকে প্রশমিত করেছে মেয়রের বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল। প্রায় বিপণœ আর্থিক কাঠামোর প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে স্বনির্ভর করার ছক, সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ফেরানো এবং অস্থায়ীদের চাকরি স্থায়ী করার প্রক্রিয়া শুরু করায় প্রশংসিত হয়েছেন তিনি। এসবের মাঝে নগরের ১৫০ স্থানে পোস্টার বোর্ড স্থাপনের উদ্যোগে বিদায় নেওয়া বিলবোর্ড সংস্কৃতি ফেরার আশঙ্কা করছেন পরিকল্পনাবিদরা।
প্রথাগত আলোকায়ন প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে ভারত সরকারের সহায়তায় ২৬১ কোটি টাকায় প্রতি ওয়ার্ডে ১০ কিলোমিটার সড়ক আলোকায়ন করার স্বপ্ন দেখালেও প্রকল্প পরিচালকের জাল-জালিয়াতির ঘটনায় চসিক দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ করতে পারেনি গত তিন বছরেও। সর্বশেষ চলতি বছরের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়িয়েছে মন্ত্রণালয়। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নের শঙ্কার মধ্যেও আশার আলো দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে পরিচ্ছন্ন বিভাগে ব্যাপক পরিবর্তন আনার প্রয়াস চালাচ্ছে সিটি করপোরেশন। সাড়ে তিন হাজার পরিচ্ছন্নকর্মীকে ডিজিটাল হাজিরার আওতায় আনা, ৬টি জোনে ভাগ করে কাজের তদারকি নিশ্চিত করা হয়েছে। একইসাথে গবেষণা করে মশার ওষুধের কার্যকারিতা যাচাই করার মতো প্রশংসিত উদ্যোগও ছিলো গত দুই বছরে। একইসাথে মেডিকেল বর্জ্য পোড়ানোর ইনসিনারেটর প্লান্ট স্থাপন, চীনের এশীয় পরিকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) এর সহায়তায় নগরীতে দুইটি আধুনিক ল্যান্ডফিল স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করছে সংস্থাটি। আগামী সপ্তাহে দায়িত্বশীল সংস্থা স্মারক চুক্তিও করছে। এ প্রকল্পের অধীনে সংগৃহীত বর্জ্যকে প্রক্রিয়াজাত করে জৈব সার ও ডিজেল উৎপাদন করা হবে। এ প্রক্রিয়ার ফলে বর্জ্য থেকে নির্গত ক্ষতিকারক গ্যাস, ময়লা পানি ও দুর্গন্ধ থেকে মুক্তি পাবে নগরবাসী। প্রকল্পের আওতায় বর্জ্য পরিবহনে ব্যবহার করা হবে সৌর বিদ্যুৎনির্ভর আধুনিক গাড়ি। এসব আলোচিত উদ্যোগের সাথে বিভিন্ন ওয়ার্ডে বর্জ্য সংগ্রহে ঠিকাদার নিয়োগ এবং টাকা আদায়ে নাগরিকদের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে বলে জানা গেছে।
পরিচ্ছন্ন বিভাগের কর্মকান্ড নিয়ে সিটি মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ নগরকে দৈনন্দিন পরিচ্ছন্ন রাখা। এ কাজ করতে প্রথম পরিচ্ছন্ন বিভাগে শৃঙ্খলা ফেরানোর কাজ করেছি। কাজের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করেছি। তার ফলাফল নগরবাসী দেখছে। এখন নগরীর হালিশহর ও অক্সিজেনের আরেফিন নগরে দুইটি প্লান্ট করতে যাচ্ছি। যেখানে বর্জ্যকে সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করে ডিজেল ও সার উৎপাদন করা হবে। স্বাস্থ্যসম্মতভাবে মেডিকেল বর্জ্য পোড়ানো হচ্ছে।’
পরিচ্ছন্নকর্মীদের নিয়মিত কাজের পাশাপাশি ফুটপাত দখলমুক্ত রাখার কাজে নিয়োজিত করা হয়েছে জানিয়ে মেয়র রেজাউল বলেন, ‘আমি দুই বছরে যে পরিমাণ ফুটপাত থেকে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করেছি, তা কোনো আমলে হয়নি। নিয়মিত মনিটরিং করতে পরিচ্ছন্নকর্মীদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। একইসাথে বিশেষ টিম গঠন করে উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। আমাদের দুইজন নিয়মিত ম্যাজিস্ট্রেটের পাশাপাশি আরও চারজনকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা এনে দিয়েছি মন্ত্রণালয় থেকে। ফলে ভেজালবিরোধী ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান জোরদার করা হয়েছে।’ আলোচনা-সমালোচনা নিয়ে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘ সমালোচনা করা সহজ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব দিয়েছেন, সততার সাথে কাজ করে যাচ্ছি। যার কারণে সবাইকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব হয় না। কাজ করে যাচ্ছি, ফলাফল নগরবাসীর সামনে স্পষ্ট হবে।’
নিয়মিত সড়ক মেরামত, সড়ক নেটওয়ার্ক উন্নয়ন, বিজ্র-কালভার্ট নির্মাণ ছাড়াও ফুটওভার ব্রিজ, গোলচত্বর নির্মাণে দৃশ্যমান পরিবর্তন এনেছে সিটি করপোরেশন। তার পেছনে শক্তি হিসেবে কাজ করেছে মেয়র রেজাউলের দায়িত্বের শুরুতেই চসিকের ইতিহাসে শতভাগ সরকারি অর্থায়নে আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের অনুমোদন। প্রকল্পের অধীনে নগরীর সবক’টি ওয়ার্ডে সড়ক উন্নয়নের কাজ চলছে। এই এক প্রকল্পতেই চট্টগ্রাম বদলে যাবে মন্তব্য করে মেয়র বলেছেন, ‘আমি মেয়র হওয়ার পরপরই প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামকে বদলে দিতে চসিকের ইতিহাসের সর্বোচ্চ আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বরাদ্দ দিয়েছেন। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে চট্টগ্রামের মূূল সড়কগুলো প্রশস্ত এবং জনবান্ধব হবে, হ্রাস পাবে যানজট। সড়কে চলতে বর্তমানে মানুষের যে ভোগান্তি হয়, তা লাঘব হয়ে নান্দনিক চট্টগ্রামের পথে হাঁটাও বিনোদনের উৎস হয়ে উঠবে।’
গত দশক ধরে নগরীর সবচেয়ে বড় সমস্যা জলাবদ্ধতা। এ নিয়ে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পের মেয়াদের বেশিরভাগ সময় পেরিয়ে গেলেও তেমন সুফলের লেশমাত্র দেখতে পায়নি নগরবাসী। এ নিয়ে বর্ষাকাল আসলে দুই সংস্থার পাল্টাপাল্টি দোষারোপ জলাবদ্ধতার ভোগান্তিকে নতুন মাত্রায় রূপ দেয়। বিষয়টি নিয়ে সমন্বয়ের নামে বেশ কয়েকবার বৈঠক হলেও বাস্তবে সমন্বয়ের দেখা মেলেনি। ফলে জনপ্রতিনিধি হিসেবে নগর পিতার দিকেই অভিযোগের তীর ছুড়ছেন নগরবাসী।
এ দুই বছরে চসিকের নির্বাচিত মেয়র ও সিটি করপোরেশন কতটা জনপ্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছে? এমন প্রশ্নের জবাবে পরিবেশবিদ ও নগর চিন্তাবিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী পূর্বদেশকে বলেন, ‘সরকার যে গতিতে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সে গতির তুলনায় সিটি করপোরেশন অনেক পিছিয়ে আছে। পলিথিনমুক্ত বাজার ঘোষণা করেও সিন্ধান্ত বাস্তবায়নে অটল থাকতে না পারা অন্যতম উদাহরণ। এক্ষেত্রে মেয়রের সিদ্ধান্তহীনতা, স্থবিরতা ও উদাসীনতা অন্যতম কারণ। গত বর্ষায় বৃষ্টি কম হওয়ায় জলবদ্ধতা নিয়ে কম সমালোচনা হয়েছে। নালায় পড়ে মানুষ মরেছে। এ সময় মেয়রের বক্তব্য রাজনৈতিক ব্যক্তির মত ছিলো না। যেহেতু বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত, পরীক্ষিত মানুষ তাই অবশিষ্ট তিন বছরে মেয়র গতিশীল হলে সিটি করপোরেশন এগিয়ে যাবে।’
মেয়রের দুই বছরের মূল্যায়নে সচেতন নাগরিক কমিটি’র (সনাক) চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি এড. আখতার কবির চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেছেন, ‘জনপ্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি মেয়র। আমরা চূড়ান্তভাবে হতাশ। সবকিছুর মূল্যবৃদ্ধির সময়ে তিনি নগরবাসীর উপর করের বোঝা চাপিয়েছেন। তাও স্থগিত বিষয়টিকে আবেদন করে অনুমোদন করিয়েছেন। একজন রাজনৈতিক বা একজন মেয়রকে নমনীয় হতে হয়। জাইকা’র বড় প্রজেক্ট পাওয়ার জন্য নাগরিকের উপর করের বোঝা চাপিয়েছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।’
উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি চসিকের ৬ষ্ঠ পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন নৌকার প্রার্থী নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী।