চিকিৎসকদের ‘জিরো পার্সেন্ট’ পাসের দায় কার?

33

উচ্চশিক্ষায় চিকিৎসকদের পাসের হার দিন দিন কমছে, বাড়ছে অকৃতকার্যের সংখ্যা। ২০১৯ সালের জুলাই সেশনে অনুষ্ঠিত উচ্চশিক্ষা কোর্সের ডক্টর অব মেডিসিন ও মার্স্টাস অব সার্জারিসহ বিভিন্ন কোর্সের পরীক্ষায় চিকিৎসকদের পাসের হার ছিল জিরো বা শূন্য পারসেন্ট। অর্থাৎ, কেউই পাস করেননি। চিকিৎসকরা নির্ধারিত বিষয়গুলোতে কেন উত্তীর্ণ হতে পারছেন না, এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
চিকিৎসা শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমবিবিএস পাস করার পর এখন শিক্ষার্থীরা এমডি/এমএস কোর্সে ভর্তি হতে পারছেন। কিন্তু এমবিবিএসের ফরম্যাট আর এমডি/এমএসের ফরম্যাট পুরো আলাদা। এ জন্য মনে হয় কিছুটা ডেফিসিয়েন্সি থেকে যাচ্ছে। তাই যে শিক্ষকরা কারিকুলাম তৈরি করেন, এ বিষয়ে তাদেরকে নতুন করে ভেবে দেখা দরকার।
সূত্র জানায়, দেশের সব কয়টি মেডিক্যাল কলেজের ডক্টর অব মেডিসিন (এমডি) ও মার্স্টাস অব সার্জারিসহ (এমএস) কোর্সের পরীক্ষা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। পুরো পরীক্ষা প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে এই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এসব কোর্স অতিক্রম করেই একজন চিকিৎসক নির্ধারিত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন। কিন্তু বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা কোর্সে শিক্ষার্থীদের অকৃতকার্যের হার বেড়ে যাওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে। খবর বাংলা ট্রিবিউন এর শিক্ষকরা বলছেন, ফরম্যাট ঠিক না থাকা এবং বিভিন্ন কলেজে এসব বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ানোর কারণে একইরকম সুপারভিশন হচ্ছে না— এটা অকৃতকার্য হওয়ার বড় কারণ। তারা বলছেন, মেডিক্যাল কলেজগুলোতে একজন শিক্ষক নিয়মিত কোর্স পড়ানোর পর পঞ্চম বর্ষ শেষ করে আবার এমডি ও এফসিপিএস পড়াচ্ছেন। এতে করে তারা চাপে থাকেন। তাই উচ্চশিক্ষার কোর্সগুলো মেডিক্যাল কলেজে না পড়িয়ে বরং সব শিক্ষার্থীকে বিএসএমএমইউতে ভর্তির সুযোগ দেওয়া দরকার। এতে করে সবাই একইরকম সুপারভিশন ও মনিটরিংয়ের আওতায় থাকবেন।
ফলাফল খারাপ করার পেছনে শিক্ষকদের দায়িত্বহীনতাকেও দায়ী করছেন অনেকেই।
২০১৯ সালের এমডি এবং এমএম সেশনের ফলাফলে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরো সার্জারি (ফেইজ-বি), রেডিওলজি ও ইমেজিং (ফেইজ-বি), পেডিয়াট্রিক নেফ্রোলজি (ফেইজ-বি), ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন (ফেইজ-বি), ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের নিউরোলজি (ফেইজ-এ), প্লাস্টিক সার্জারি (ফেইজ-এ), কার্ডিওলজি (ফেইজ-এ), পালমোনলজি (ফেইজ-এ), ইন্টারনাল মেডিসিন (ফেইজ-এ এবং ফেইজ-বি), গ্যাস্ট্রো এন্টারোলজি (ফেইজ-এ), চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের নিউরোলজি (ফেইজ এ এবং ফেইজ বি), জেনারেল সার্জারি (ফেইজ এ), নিউরো সার্জারি (ফেইজ বি), পেডিয়াট্রিক (ফেইজ-বি), ইন্টারনাল মেডিসিন (ফেইজ-বি), রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের ইন্টারনাল মেডিসিন (ফেইজ- বি), জেনারেল সার্জারি (ফেইজ-এ), পেডিয়াট্রিক্স (ফেইজ-বি), রংপুর মেডিক্যাল কলেজের ইন্টারনাল মেডিসিন (ফেইজ-এ), পেডিয়াট্রিক (ফেইজ- বি), সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের ইন্টারনাল মেডিসিন (ফেইজ-এ এবং ফেইজ-বি), জেনারেল সার্জারি (ফেইজ-এ), ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের পেডিয়াট্রিক (ফেইজ-বি), নিউরোলজি (ফেইজ-এ), ইব্রাহিম মেডিক্যাল কলেজের ইন্টারনাল মেডিসিন (ফেইজ-এ), জেনারেল মেডিসিন (ফেইজ-এ), জাতীয় হার্ট ফাউন্ডেশনের কার্ডিওলজি (ফেইজ-এ), জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের মেডিক্যাল অনকোলজি (ফেইজ-বি) এবং মাতুয়াইলের মা ও শিশু স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পেডিয়াট্রিক (ফেইজ-বি) পরীক্ষাগুলোতে অংশ নেওয়া একজন চিকিৎসকও পাস করেননি।
আবার ইন্টারনাল মেডিসিন বিষয়ে দেখা যায়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে পরীক্ষার্থী ছিলেন সাত জন, কেউ পাস করেননি। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজে চার পরীক্ষার্থীর কেউ পাস করেননি। ইব্রাহিম মেডিক্যাল কলেজের দুইজনের মধ্যেও কেউ পাস করেননি। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের পরীক্ষায় অংশ নেওয়া তিন জনই অকৃতকার্য। রংপুর মেডিক্যাল কলেজের চার জনেরও কেউ পাস করেননি। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের ১২ জনের মধ্যে পাস করেছেন একজন। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের আট জনের মধ্যে পাস করেছেন দুই জন আর রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের আট জনের মধ্যে পাস করেছেন তিন জন।
চিকিৎসক শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন তুলেছেন, একজনও যদি পাস না করে, তাহলে তারা কিভাবে ভর্তি পরীক্ষায় পাস করেছিলেন? তাছাড়া, শিক্ষকরাই বা তাদেরকে কী পড়িয়েছেন? শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের পড়ানোর মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্দিষ্ট কিছু সাবজেক্টে শতভাগ অকৃতকার্য, সেসব বিষয়ের শিক্ষকদের ব্যর্থতার দায় নিয়ে পদত্যাগ করা উচিত, বলেছেন শিক্ষার্থীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চিকিৎসক অভিযোগ করেন, পুরো প্রক্রিয়াটি বিএসএমএসইউর অধীনে সম্পন্ন হয়, তাই ব্যর্থতার পুরো দায় তাদেরকেই নিতে হবে। কিন্তু সত্যি হচ্ছে, এই প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনিক কাঠামো বলে বর্তমানে কিছুই অবশিষ্ট নেই। আর ভুক্তভোগীরা পরীক্ষায় ফেল করার ভয়ে এ নিয়ে প্রতিবাদও করতে পারেন না।
বিএসএমএমইউ’র এমডি কোর্সের শিক্ষার্থী একাধিক চিকিৎসক বলেন, শিক্ষার্থীদের ফলাফল এত খারাপ হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে, তাদের ঠিকমতো মনিটরিং করা হয় না। অনেক বিভাগই রয়েছে, যেখানে বছরে ছয়টা ক্লাসও নেওয়া হয় না। কোর্সের ডিজাইন বা মডিউল ঠিকমতো ফলো করা হয় না। পরীক্ষায় বসতে একজন শিক্ষার্থীকে যেভাবে সিস্টেমেটিক পড়াশোনা করা দরকার, তা হচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের ফুল টাইম মনিটরিং করার কথা থাকলেও দুপুরের পর ওই শিক্ষার্থীরা কোথায় যাচ্ছে, কী করছে তার কোনও মনিটরিং নেই। এসব কারণে ফলাফল বিপর্যয় ঘটে। এর পুরো দায়িত্ব শিক্ষকদের নিতে হবে।
জানতে চাইলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘রেজাল্ট বের হওয়ার পর আমি মারাত্মকভাবে আহত ও বিস্মিত হয়েছি। বিষয়টি নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন।’
তিনি আরও বলেন, যে ফরম্যাটে পড়ানো হয় এবং পরীক্ষা হয়, তাতে করে শিক্ষার্থীদের এমবিবিএস পাসের পরই এমডি, এমএসের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। তারা পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করার জন্য ‘রিয়েলি প্রিপেয়ার্ড’ কিনা, তাও দেখা প্রয়োজন। ‘পড়বে ও শিখবে’ এমন মন্ত্র হওয়া দরকার। এসব কারণে শিক্ষার্থীরা হয়তো সঠিকভাবে প্রস্তুতি নিতে পারছেন না। এতে করে তাদের রেজাল্ট এবং পারফরমেন্স দুটোই খারাপ হচ্ছে।
তাহলে উচ্চশিক্ষায় আগে কীভাবে পাস করতো, প্রশ্নে অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘এর আগে পাস করতো এই কারণে যে, আগে শিক্ষার্থীরা অপেক্ষাকৃত দক্ষ ছিল। যারা ‘এফসিএস’ ট্রাই করেছিল এবং যারা ট্রেনিংও করেছে কিছুদিন, কেবল সেরকম শিক্ষার্থীরাই রেসিডেন্সিতে যেতেন। তাদের পারফরমেন্স অপেক্ষাকৃত ভালো হতো এবং তাদের ফলাফলও ভালো হতো।’
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শামীম হাসান বলেন, ‘পরীক্ষা হয় ঢাকায়, এ বিষয়ে মন্তব্য করা কঠিন। বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষকরা এসে ওখানে পরীক্ষা নেন, সেখানে কোনও কারণে কেউ যদি ‘স্যাটিসফায়েড’ না হন, তাহলে হয়তো সেখানে।’
মেডিক্যাল কলেজগুলোতে নির্দিষ্ট বিষয়ে শিক্ষার্থীরা কেন পাস করছেন না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা এতে নজর দিয়েছি, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসবো। ওদের ঘাটতিটা কোথায়, সেটাও দেখবো। তারপর সেটা রেকটিফাই করার চেষ্টা করবো।’
বিএসএমএমইউ’র বেসিক সায়েন্স অ্যান্ড প্যারা ক্লিনিক্যাল সায়েন্স অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘শিক্ষকদের যেমন দায় রয়েছে, তেমনি শিক্ষার্থীদেরও দায় রয়েছে। যারা শিক্ষক আছেন, তাদের সিনসিয়ারিটির অভাব রয়েছে। তারা যদি শিক্ষার্থীদের শেখান, তাহলে শিক্ষার্থীরা শিখবে না— এটা আমি বিশ্বাস করি না।’
নিজের শিক্ষাজীবনের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘সে সময় বিকাল বেলায় রেজিস্ট্রার, সহকারী রেজিস্ট্রাররা আমাদের পড়াতেন। কিন্তু এখন তেমন কেউ ক্লাস নেন বলে আমার মনে হয় না। অধ্যাপকরাও আসেন না। আর যখন শিক্ষকরা আসেন না, তখন শিক্ষার্থীদের মধ্যেও শৈথিল্য চলে আসে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ সিকদার বলেন, ‘এককভাবে কাউকে দায়ী করা যাবে না। শিক্ষকরা ছাত্রদের ফেল করার জন্য পড়ান না। ফেল করার বিষয়টি ছাত্র-শিক্ষক এবং প্রতিষ্ঠান কারও জন্যই কাম্য না। তবে কোনও সাবজেক্টে একজনও পাস করবে না— এটা ভীষণ অ্যালার্মিং। এটা হওয়া উচিত না। বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে।’ কোনও একটি বিষয়ে কেন কেউ পাস করবে না, তা অনুসন্ধানের প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।