চরম গরমে তীব্র লোডশেডিং বিপর্যস্ত জনজীবন

22

মনিরুল ইসলাম মুন্না

চট্টগ্রামে লোডশেডিংয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। দিন-রাত সমানতালে চলছে লোডশেডিং। অফিস-আদালতের কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটছে প্রতিদিন। চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রতিদিন ১৩০০ থেকে সাড়ে ১৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে মিলছে ৯০০ থেকে ১১শ’ মেগাওয়াট। এতে দৈনিক দুই থেকে আড়াইশো মেগাওয়াট লোডশেডিং হচ্ছে। এছাড়া জ্বালানি সংকটের কারণে চট্টগ্রামের নয়টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বন্ধ রয়েছে উৎপাদন। আবার কিছু উৎপাদন কেন্দ্রে যান্ত্রিক ত্রæটি থাকায় ধারণ ক্ষমতার চেয়ে কম বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে।
গতকাল বুধবার পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) এবং বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিপিডিবি সূত্র জানিয়েছে, লোডশেডিংয়ের পরিমাণ দিনের বেলায় ১০০ থেকে ৩০০ মেগাওয়াট। রাতের বেলায় ২০০ থেকে আড়াইশো মেগাওয়াট পর্যন্ত হয়। কখনও কখনও আবার সেটা ৪০০ মেগাওয়াটও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মূলত গ্যাস ও জ্বালানি সংকটের কারণেই এমনটা হচ্ছে।
বিপিডিবি চট্টগ্রাম অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী অশোক কুমার চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, ‘জাতীয়ভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন না হওয়ায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে। চাহিদামত উৎপাদন হলে লোডশেডিংয়ের প্রয়োজন পড়ে না। আমরা কেন্দ্রীয়ভাবে যা পাচ্ছি, তা সুষম বণ্টন করে সমতা বজায় রাখছি।’
যেসব কেন্দ্রে উৎপাদন ক্ষমতা কমে গেছে : পিজিসিবি সূত্রে জানা গেছে, কাপ্তাই হাইড্রোলিক পাওয়ার প্ল্যান্টের পাঁচটি ইউনিটে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার ক্ষমতা রয়েছে ২৩০ মেগাওয়াট। কিন্তু লেকে পানির লেভেল নিচে নেমে যাওয়ায় একটি ইউনিট থেকে মাত্র ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। রাউজান তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুইটি ইউনিটে ৩৬০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা থাকলেও গ্যাস স্বল্পতার কারণে উৎপাদন হচ্ছে ১১৯ মেগাওয়াট। তবে রাউজানের অপর ২৫ মেগাওয়াট উৎপাদন কেন্দ্রের বিদ্যুৎ স্বাভাবিক অবস্থায় রয়েছে। পতেঙ্গার ৫০ মেগাওয়াট উৎপাদন কেন্দ্রে জ্বালানি সংকটের কারণে ১৯ মেগাওয়াট উৎপাদন হচ্ছে। শিকলবাহায় তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে একটিতে মেনটেনেন্সের কাজ চলছে। অপর ২২৫ মেগাওয়াট উৎপাদনকেন্দ্রে স্বাভাবিকভাবে উৎপাদন হচ্ছে ২১২ মেগাওয়াট এবং ১০৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি স্বল্পতার কারণে মাত্র ১৭ মেগাওয়াট উৎপাদন করতে পারছে। হাটহাজারী ১০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্লান্টে ইঞ্জিনে সমস্যার কারণে পাওয়া যাচ্ছে ৬৯ মেগাওয়াট, দোহাজারী ১০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্লান্টে ইঞ্জিনে সমস্যার কারণে পাওয়া যাচ্ছে ৫১ মেগাওয়াট, জুলধা ১০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্লান্টের দুইটি ইউনিটের একটিতে জ্বালানি সংকট এবং অপরটিতে ইঞ্জিন সমস্যার কারণে পাওয়া যাচ্ছে ২৫ মেগাওয়াট, বাড়বকুন্ডের ২২ মেগাওয়াট উৎপাদনকেন্দ্রে জ্বালানি সংকটের কারণে পাওয়া যাচ্ছে ৫ মেগাওয়াট, আনোয়ারা ৩০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টে জ্বালানি সংকটের কারণে পাওয়া যাচ্ছে ১৬ মেগাওয়াট, কর্ণফুলী পাওয়ার লিমিটেডে ১১০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা থাকলেও জ্বালানি স্বল্পতার কারণে পাওয়া যাচ্ছে ৩৪ মেগাওয়াট, এনলিমা এনার্জি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে ১১৬ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা থাকলেও জ্বালানি স্বল্পতার কারণে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ১৭ মেগাওয়াট এবং মিরসরাই ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে ১৬৩ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার পুরোটাই পাওয়া যাচ্ছে। বাঁশখালীর এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টে উৎপাদন ক্ষমতা ১২২৪ মেগাওয়াটের মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে ২৭৬ মেগাওয়াট উৎপাদন হচ্ছে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরাসরি জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়ে সারাদেশে সরবরাহ হচ্ছে।

বন্ধ রয়েছে যেসব বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র : জ্বালানি সংকটের কারণে রাউজান তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট ১৮০ মেগাওয়াট, টেকনাফে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ২০ মেগাওয়াট, শিকলবাহা পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট মেনটেনেন্সের কারণে ১৫০ মেগাওয়াট, জ্বালানি সংকটের কারণে জুলধা ইউনিট ২ এবং ইউনিট ৩ এর ১০০ মেগাওয়াট, সোলার প্যানেলে সমস্যা হওয়ায় কাপ্তাই সাত মেগাওয়াট সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট, জ্বালানি সংকটের কারণে জুডিয়াক পাওয়ার প্ল্যান্টে ৫৪ মেগাওয়াট, পরীক্ষামূলক থাকায় মিরসরাই গ্যাস চালিত ১৫ মেগাওয়াট এবং সোলার প্যানেলে সমস্যা থাকায় সোনাগাজীর ৭৫ মেগাওয়াট সোলার পাওয়ার প্ল্যান্টে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।
পিজিসিবি’র সুপারভাইজরি কন্ট্রোল অ্যান্ড ডাটা অ্যাকুইজিশনের (স্ক্যাডা) মতে, জ্বালানি সংকটের কারণে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ থাকায় চট্টগ্রামে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ বেড়েছে। গ্যাসের প্রেসার কম ও জ্বালানি তেলের সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। লোডশেডিংয়ের পরিমাণ অনেক সময় পরিবর্তন হচ্ছে। আসলে বিদ্যুতের উৎপাদন, সরবরাহের ওপরই নির্ভর করে লোডশেডিংয়ের নির্ধারিত মাত্রা।
নগরীর মিডিয়াপাড়া নামে খ্যাত চেরাগীপাহাড়, জামালখান ও কাজীর দেউড়ি পিডিবির স্টেডিয়াম ডিভিশনের আওতায় থাকায় সংবাদপত্র অফিসগুলোতেও ভোগান্তি বেড়েছে। এই ডিভিশনে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ ১০ থেকে ১৫ মেগাওয়াট। অথচ পিডিবির স্টেডিয়াম ডিভিশনে চাহিদাই থাকে ১৫ থেকে ২০ মেগাওয়াট। এই চাহিদার পুরোটাই এখন লোডশেডিংয়ে ডুবে আছে। তাই কিছুক্ষণ পর পর সংবাদপত্র ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার অফিসগুলোতে লোডশেডিং হচ্ছে।
এদিকে বিপিডিবি দক্ষিণাঞ্চলের দেয়া তথ্যমতে, গতকাল (বুধবার) দুপুর ১২টায় চট্টগ্রামের উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ১৪৬৪.১ মেগাওয়াট। একই সময়ে চাহিদা ছিল ১৩১২ মেগাওয়াট। কিন্তু এর বিপরীতে জাতীয়ভাবে চট্টগ্রাম বিদ্যুৎ পায় মাত্র ১১৯৫ মেগাওয়াট। লোডশেডিং হয়েছে ১১৭ মেগাওয়াট। যা সমানভাবে প্রতিটি উপকেন্দ্রের মাধ্যমে সমন্বয় হয়।
বিপিডিবি চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম পূর্বদেশকে বলেন, ‘কখন লোডশেডিং হবে, তা আমি বলতে পারছি না। কারণ সবকিছু কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত হচ্ছে। উৎপাদনের উপর ভিত্তি করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। তাই পরিস্থিতি প্রতিনিয়তই বদল হচ্ছে। তাই কখন কী হবে, বলা যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয়ভাবে যে নির্দেশনা আসছে আমরা সেভাবেই কাজ করছি। মূলত জ্বালানি সংকটের কারণেই পাওয়ার প্ল্যান্টে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আমরা কেন্দ্রীয়ভাবে যে বিদ্যুৎ পাই, তাই বণ্টন করে থাকি।’
পরিস্থিতি কতদিন এমন অবস্থায় থাকবে তা জানতে চাইলে রেজাউল করিম বলেন, ‘এটা বলা মুশকিল। জ্বালানি সংকট না মেটা পর্যন্ত এমন অবস্থা থাকবে।’