চট্টগ্রাম ও বাণিজ্যিক রাজধানী

17

 

২১ মার্চ ২০১৮ বঙ্গকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম আগমন করবেন। বিপ্লবীদের ইতিহাসের প্রাচীনতম এই বন্দরনগরী চট্টগ্রামে প্রধানমন্ত্রীর আগমনে শুভেচ্ছা অভিনন্দন জানাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে ঘিরে বিগত ১৫ দিন পর্যন্ত শহর হয়ে উঠে আনন্দমুখর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে স্থানে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিবেন কিংবা জনসভায় মিলিত হবেন সে স্থানে তাঁর পিতা স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও বক্তব্য রাখেন। স্থানটির নাম ঐতিহাসিক পটিয়া। পটিয়াকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহকুমা ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর ঘোষিত প্রত্যেক মহকুমা জেলায় উন্নীত হলেও পটিয়া ও রামগড় জেলায় উন্নীত হয়নি। সেটি থানায় রয়ে গেছে। বর্তমানে পটিয়া একটি উপজেলা শহর। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে, স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস ও ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে (ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন) বৃহত্তর এই পটিয়ার মাটি ও মানুষের অবদান অনস্বীকার্য। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কিংবদন্তি অনেক বিখ্যাত বিখ্যাত জননেতার জন্মভূমি এই পটিয়াতে। মাস্টারদা সূর্যসেনের সহযোগী বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের জন্মভূমি এই পটিয়ার মাটিতে। মাস্টারদা সূর্যসেনকে ব্রিটিশ সৈন্যরা গ্রেফতার করেন পটিয়া থেকে। বিপ্লবীদের ইতিহাসে এই পটিয়ার অবস্থান গৌরবোজ্জ্বল। পটিয়া থেকে বের হয়ে থানা করা হয় রাঙ্গুনিয়া, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, বোয়ালখালী। আজ পটিয়ার পার্শ্ববর্তী থানাগুলো নিয়ে সাংগঠনিক রাজনীতিক জেলা হিসেবে পরিচিত দক্ষিণ চট্টগ্রাম। প্রশাসনিকভাবে দক্ষিণ চট্টগ্রাম জেলা এর কোন অস্থিত্ব নেই। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে প্রত্যেক দলেরই দক্ষিণ জেলাভিত্তিক কমিটি রয়েছে। চট্টগ্রাম দক্ষিণ ভিত্তিক জেলা করার জন্য ইতিপূর্বে অনেক কর্মকান্ড পরিলক্ষিত হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ পৃথক কোন জেলা হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করতে সক্ষম হয়নি। পটিয়াকে জেলা বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘদিনের আন্দোলন ছিল। এখনো আছে। চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম উত্তর, চট্টগ্রাম দক্ষিণ এই তিনটি অঞ্চলের মানুষের কল্যাণার্থে বর্তমান সরকার বহু উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হচ্ছে। কর্ণফুলী নদীর উপর রেলসেতু নির্মাণ এখন সময়ের দাবি। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর দেয়াং পাহাড়ে জাতীয় আরবি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রাচীন সভ্যতার স্মারক আনোয়ারার ঐতিহাসিক পন্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয় নবপ্রতিষ্ঠা, দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ, দোহাজারী শঙ্খ নদীর উপর সেতু নির্মাণ, বরুমতি খালের উপর সেতু নির্মাণ, দোহাজারীতে রাবার ড্যামের মাধ্যমে বোরো চাষের ব্যবস্থা, পাহাড়ি অঞ্চলগুলোকে বৃক্ষনিধন থেকে রক্ষার জন্য বোয়ালখালী, পটিয়া, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া পাহাড়ভিত্তিক থানা স্থাপন, বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী আনোয়ারা ও বাঁশখালী উপজেলায় সমুদ্র সৈকতকে আধুনিকায়নকরণ এবং কর্ণফুলী নদীর পানিকে দূষণমুক্ত ও কর্ণফুলী নদী দখলমুক্তকরণ, কর্ণফুলীর কালুরঘাট ব্রিজ থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত নদী পথে ওয়াটারবাস চালুসহ এই এলাকাগুলোর শিক্ষা, সামাজিক, যোগাযোগ উন্নয়নে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আশা করছে এলাকাবাসী।
চট্টগ্রামের উন্নয়ন ও বাণিজ্যিক রাজধানী বাস্তবায়নে সকলে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। বলা হয় চট্টগ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন দিয়ে পুরো বাংলাদেশ সচল রাখা সম্ভব। আর সেই বন্দরনগরীর বাণিজ্যিক রাজধানী বাস্তবায়ন এখনো কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামের অনেক সভায় বলেছেন চট্টগ্রাম উন্নয়নের দায়িত্ব আমি নিজ হাতে নিয়েছি। আমরা চাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে চট্টগ্রামের উন্নয়ন আরো এগিয়ে যাক। ২০১৬ সালে বিশিষ্ট আইনবিদ শঙ্কর প্রসাদ দে চট্টগ্রামের উন্নয়ন ও বাণিজ্যিক রাজধানী প্রসঙ্গ শীর্ষক এক প্রবন্ধে লিখেছেন: “রাজনৈতিক মতপার্থক্য নির্বিশেষে, আমাদের স্বীকার করতেই হবে চট্টগ্রামের বহু ব্যয়বহুল উন্নয়ন প্রকল্প গৃহীত এবং বাস্তবায়িত হচ্ছে। ৬০ লক্ষ জনগোষ্ঠীর এই মহানগরীর প্রধানতম সমস্যা হলো পানি সরবরাহ। আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি, পানি কি দুর্মূল্য বস্তুতে পরিণত হয়েছে। নগরবাসী অধীর আগ্রহে সেটি বাস্তবায়িত হওয়ার অপেক্ষায় আছে।
সীতাকুন্ড পাহাড় ক্রমশ অনুচ্চ হয়ে ফৌজদার হাট এলাকায় এমন এক প্রাকৃতিক অবস্থার সৃষ্টি করেছে যে, এখানে বিশাল এক জলাধার তৈরি সম্ভব স্বল্পখরচে। ফয়’স লেক এর দৃষ্টান্ত। কয়েক বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিশাল জলাধার নির্মাণে মাত্র কয়েকটি ছোট ছোট বাঁধ দেয়াই যথেষ্ট। এই চিন্তা ব্রিটিশের মাথায় এসেছিল এবং মাত্র একটি বাঁধ দিয়ে বিশাল ফয়’স লেক সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে। দীর্ঘ শতবছর পরেও আমরা ব্রিটিশ প্রবর্তিত ঐ পদ্ধতিকে বড় পরিসরে ব্যবহারের দিকে এগোইনি।
সিটি কর্পোরেশন ও সিডিএ বহু প্রকল্প নিয়েছে। অনেকগুলো বাস্তবায়িতও হচ্ছে। এসব প্রকল্পের অর্থ আসে সচিবালয় থেকে। অভিযোগ হলো, এ প্রক্রিয়ায় দেশের অন্য শহরগুলোর সাথে চট্টগ্রামের পার্থক্য তেমন নেই। অথচ চট্টগ্রাম এদেশের সমৃদ্ধি আর অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রাণকেন্দ্র। হু হু করে মাঝারি শিল্পের বিকাশ ঘটছে। গার্মেন্টস, টেক্সটাইল, লৌহ ও সিমেন্টের পাশাপাশি জাহাজ নির্মাণের মতো শিল্পেরও বিকাশ ঘটছে। যে কোন শিল্পোদ্যোগের প্রধান শর্ত হলো গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ। এই দুটো রাষ্ট্রীয় সেবার জন্য অনেককে দৌড়াতে হয় ঢাকায়। এখানেই সমস্যার সৃষ্টি। এসব প্রতিষ্ঠানের নীতিনির্ধারণী বা অনুমোদন কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রামে থাকলে দ্রæত সেবা পাওয়া যেত। এ জন্য বাণিজ্যিক রাজধানী হওয়ার প্রসঙ্গটি রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্ববহ। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, অতীতের মতো বর্তমান সরকারও বাণিজ্যিক রাজধানী ঘোষণার বিষয়টিকে খুব বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে না।
চট্টগ্রামকে সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের বিশাল বনভূমি। বন মন্ত্রণালয় ঢাকায় রাখার খুব বেশি যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। তেল শোধনাগারগুলো পতেঙ্গা উপকূল ভিত্তিক। বিশাল সমুদ্রসম্পদ তথা মৎস্য আহরণ প্রক্রিয়া চট্টগ্রামভিত্তিক। মৎস্য অধিদপ্তরের প্রধান অফিস চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত হওয়ার ক্ষেত্রে কোন বাধা থাকার কথা নয়। শুল্ক বিভাগ বলে রাজস্বের প্রধান অফিস ডিজিটালাইজেশনের এ যুগে চট্টগ্রামে স্থানান্তরে কোন অসুবিধা নেই। দু’টো বিমানবন্দর আর ভারতীয় সীমান্ত পয়েন্টগুলোর শুল্কায়ন ছাড়া মূল আমদানি রপ্তানি শুল্কায়ন ঘটে চট্টগ্রাম বন্দর ও বিমানবন্দরকে ঘিরে। বাংলাদেশের শুল্ক বিভাগের প্রধান কার্যালয় চট্টগ্রামেই থাকা উচিত।
অন্তত দশটি মন্ত্রণালয়ের প্রধান সচিবালয় চট্টগ্রামে হতে পারে। উন্নয়নের যে গর্বিত যাত্রার কথা সরকারি দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে সেটি আরো ত্বরান্বিত এবং টেকসই করতে হলে, আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন নিয়ে ভাববার সময় এসেছে। বাণিজ্যিক রাজধানী শুধুমাত্র একটি কথার কথা নয়, এটির সাংবিধানিক ও আইনি মূল্য রয়েছে। এদেশে বাজেট প্রণয়নের সময় অন্য জেলার মতো করে চট্টগ্রাম মূল্যায়িত হয়। প্রত্যেক জেলার উপজেলা সদরগুলোর বহু ধরনের প্রয়োজনীয়তার সৃষ্টি হয়েছে। নাগরিক সুবিধাগুলোর উপর ভিত্তি করে শিল্পায়ন অর্থাৎ শিল্পের স্থানীয়করণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মফস্বল ছোট শহরগুলোতে শিল্পায়ন ত্বরান্বিত করতে হলে রাষ্ট্রীয় সেবা তার কাছাকাছি আনা দরকার। হয়তো সব জেলার জন্য এ জাতীয় বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব নয় কিন্তু চট্টগ্রামের জন্য তা সম্ভব। চট্টগ্রামের শহরগুলোতে মাঝারি শিল্প স্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি হলে, চট্টগ্রাম শহরকেন্দ্রীক নীতিনির্ধারণী কেন্দ্র গড়ে তোলা দরকার। এটি করতে হলে বাণিজ্যিক রাজধানী প্রসঙ্গটি গুরুত্ব বহন করে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও মরমী গবেষক