চট্টগ্রামের সূর্যসন্তান শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী

176

­­নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

বিস্মৃতিপ্রবণ জাতি হিসাবে বাঙালির ‘খ্যাতি’ বিশ্বজোড়া। ‘খ্যাতি’ সাধারণত সদর্থক অর্থাৎ ‘সুখ্যাতি’ অর্থে ব্যবহৃত হয়। তবে নঞর্থক অর্থাৎ ‘কুখ্যাতি’ অর্থেও যে ব্যবহার হয় না তা নয়। এখানে নঞর্থক বা নিন্দার্থেই যে ব্যবহৃত হয়েছে, তা স্পষ্ট। তাহলে ‘বিস্মৃতি’ অর্থাৎ জাতির জনক, ইতিহাস, ঐতিহ্য, স্বাধীনতা সংগ্রামী, মুক্তিযোদ্ধা এবং স্মরণীয় বরণীয় মনীষীদের ভুলে যাওয়া নিঃসন্দেহে একটি অপরাধ, যাকে ক্ষমা করা যায় না এবং ক্ষমা করা উচিতও নয়। মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরীকে ভুলে যাওয়া এমনি অমার্জনীয় অপরাধ। একদিন চট্টগ্রামের রাজনৈতিক আকাশে উজ্জ্বল তারকার দীপ্তি ছড়িয়ে স্বমহিমায় বিরাজ করতেন যিনি, ৪১ বছরের ব্যবধানে সেই তিনিই (সাইফুদ্দিন খালেদ) বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছেন।
সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী যখন ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল রাউজানের পাহাড়তলী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সামনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৪ বছর। কিন্তু ঐ বয়সেই তিনি চট্টগ্রামের ছাত্র সমাজের নয়নমণি হয়ে উঠেছিলেন। ৬২ সালে ছাত্র রাজনীতিতে দীক্ষা, অতঃপর পর্যায়ক্রমিক প্রতিটি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে করতে ৬৮-৬৯-এ তিনি রাজপথের লড়াকু নেতা। মিছিলে উত্তোলিত বজ্রমুষ্টি, সমাবেশে অনলবর্ষী ভাষণ, দৃপ্ত পদে এ কলেজ ও কলেজ, অলিগলি রাজপথে ধাববান সাইফুদ্দিন তখন যেন বিপ্লবের বহ্নিশিখা হয়ে উঠেছিলেন। রক্তেই আছে বিদ্রোহের টানÑসংগ্রামী পিতা জহুর আহমদ চৌধুরীর সংগ্রামী পুত্র সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী। তিনি যে স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে আগুনের শিখার ন্যায় জ্বলে উঠবেন, তাতে আর আশ্চর্য কি! বুলেট ছাড়া তখন তাঁকে আর কিছুই থামাতে পারতো না। সেই বুলেটকে আলিঙ্গন করেই মাতৃভূমির মুক্তির সংগ্রামে নিজেকে নিঃশেষে নিবেদন করে তিনি নশ্বর জীবন থেকে অবিনশ্বর সত্তায় রূপান্তরিত হন। বন্ধু সতীর্থ জনের মধ্যে ত্যাগের মহিমায় অমর হয়ে সাইফুদ্দিনই শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা অর্জন করেছেন।
তাঁর বন্ধু, সমসাময়িক ছাত্রনেতা নেহাত কম নয়Ñমৌলভী সৈয়দ, ইদরিস আলম, সুলতান-উল কবির চৌধুরী, আবদুর রব, হারুনুর রশিদ (সাবেক ভিপি-সিটি কলেজ), গোফরান গাজী, কায়কোবাদ, যোবায়ের আহমদ, ফিরোজ আহমেদ, মোসলেম উদ্দিন আহমদ (সাধারণ সম্পাদক, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ), শফর আলী (আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ শ্রমিক লীগ), সাবেক বিচারপতি হারুন ওসমানী Ñএই তালিকা আরো দীর্ঘ করা যায়, কিন্তু সে অবকাশ এখানে নেই। সাইফুদ্দিন তাঁর বর্তমানকে, শ্রেষ্ঠ সম্পদ জীবনকে বাংলাদেশের জন্য উৎসর্গ করে বন্ধুদের ছাড়িয়ে অনেক ঊর্ধে উঠে গেছেন। সাইফুদ্দিনকে দেখা যায় নক্ষত্রের ভিড়ে; মুসলিম হাইস্কুলে যে মেধাবী ছেলেটি অখÐ মনোযোগে শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকের বক্তৃতা শুনছে, তার মাঝে সাইফুদ্দিনকে খুঁজে পাওয়া যায়; ডিসি হিল, শহীদ মিনার, থিয়েটার ইনস্টিটিউট, শিল্পকলায় আবৃত্তির আসরে উৎকর্ণ শ্রোতাটির মাঝে সাইফুদ্দিনকে খুঁজে পাওয়া যায়, নগরীর বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে যেখানে বিতর্ক সভা বসে, সেখানে যে ছেলেটি সবচেয়ে কেতাদুরন্ত ভঙ্গিতে মুখে খই ফুটিয়ে যুক্তির জাল বুনে চলেছে, তার মাঝে সাইফুদ্দিনকে খুঁজে পাওয়া যায়। সাইফুদ্দিনকে দেখা যায় এই মহানগরের মাঠ-ঘাট, সাগর, নদী, পুকুর, দীঘি, লেক-এর স্বচ্ছ, শান্ত, নিস্তরঙ্গ জলে হঠাৎ জলকেলি করতে দেখা যায় সাইফুদ্দিনকে; তাঁকে দেখা যায় বাটালী হিলে, সিআরবি পাহাড়ে, প্রকৃতির পত্রপল্লব, ফুল, পাখি, বৃক্ষলতায় বয়ে চলা মৃদুমন্দ সমীরণে। সাইফুদ্দিন আমাদের মাঝে ছিলেন, আছেন, থাকবেন। বাংলাদেশ ও বাংলার প্রকৃতিই সাইফুদ্দিনের উপস্থিতির প্রমাণ।
আমরাই তাঁকে ভুলে গিয়েছিলাম। ৪০ বছর পর তাঁর কবরটি অনাদরে, অবহেলায় এতদিন পাহড়তলীর পাহাড়ে চাপা পড়ে ছিলো; ৪০ বছর পর সেটিকে উত্তোলন করে দামপাড়ায় এনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের ব্যবস্থা হয়েছে। সাইফুদ্দিনের অতৃপ্ত আত্মা এতদিনে হয়তো শান্তি পেয়েছে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা