চকরিয়ায় ভয়াবহ রূপ নিয়েছে বন্যা পরিস্থিতি

50

টানা এক সপ্তাহ ধরে থেমে থেমে ভারী বর্ষণ ও মাতামুহুরীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে চকরিয়া উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। পৌর এলাকাসহ উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নের বেশিরভাগই বন্যার পানিতে তলিয়ে গিয়ে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় অঘোষিতভাবে বন্ধ হয়ে গেছে উপজেলার শতশত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
এছাড়া উপজেলার প্রায় ৪০ হাজার পরিবারের বসতঘরে বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় এসব পরিবারের চুলার রান্নাবান্না সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। খাবার ও বিশুদ্ধ পানীয় জলের সঙ্কট দেখা দেওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে পানিবন্দী মানুষেরা। রবিবার পর্যন্ত উপজেলার বিভিন্নস্থানে পাহাড় ধস, বিদ্যুস্পৃষ্ট ও পানিতে তলিয়ে গিয়ে এক নারীসহ চারজন নিহত হয়েছে। বৃষ্টি কমে যাওয়ায় মাতামুহুরী নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। বন্যার পানিতে বিভিন্ন ইউনিয়নের সড়কগুলো ডুবে থাকায় উপজেলা সদরের ওইসব ইউনিয়নের সকল ধরনের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
এদিকে চকরিয়া উপজেলার বন্যাকবলিত বিভিন্ন ইউনিয়নের বানভাসি লোকজনের জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ সহায়তা হিসেবে গতকাল রবিবার পর্যন্ত ৪০ মেট্রিক টন চাল ও ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। আরও ত্রাণ সহায়তার জন্য জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নুরুদ্দীন মোহাম্মদ শিবলী নোমান।
উপজেলার সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম জানিয়েছেন, গত এক সপ্তাহ ধরে ভারী বর্ষণের ফলে মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তার ইউনিয়নের বেশিরভাগ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে কয়েক হাজার লোক পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এছাড়া প্রায় দুই হাজার পরিবারের বসত বাড়িতে বন্যার পানি ঢুকে রান্নাবান্না বন্ধ হয়ে পড়ায় এসব পরিবারের লোকজন খাবার ও পানীয় জল নিয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে গিয়ে জিদ্দাবাজার-কাকারা-সুরাজপুর-মানিকপুর সড়ক যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বন্যায় মাঝের ফাঁড়ি ব্রীজ সংলগ্ন একটি মসজিদ ও মানিকপুর রাখাইন পাড়া এলাকার দুইটি মন্দির নদীগর্ভে তলিয়ে যাওয়ার সম্ভবনা দেখা দিয়েছে বলেও জানান তিনি।
কাকারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত ওসমান বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে প্রবল বর্ষণ ও মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তার ইউনিয়নের অন্তত ২৫ হাজার লোক পানিবন্দী হয়ে পড়ে। এছাড়া প্রায় ৫ হাজার পরিবারের বসতবাড়িতে বন্যার পানি প্রবেশ করায় এসব পরিবারের চুলায় রান্নাবান্না বন্ধ হয়ে গিয়ে খাবার ও বিশুদ্ধ পানীয় জল নিয়ে তারা চরম দুর্ভোগে পড়েছে। বিষয়টি স্থানীয় সাংসদ জাফর আলম ও উপজেলা প্রশাসনকে অবহিত করার পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাড়ে ৮ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। পরে ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডের মধ্য থেকে অধিক ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের তালিকা তৈরি করে সরকারি এসব ত্রাণ সহায়তা তাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
বমুবিলছড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল মতলব বলেন, এক সপ্তাহ ধরে প্রবল বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তার ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডই বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। শনিবার রাতেও ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকায় রাত দুইটার দিকে হঠাৎ ইউনিয়নের বমুরকুল এলাকায় পাহাড়ের একটি অংশ ধসে গিয়ে পাহাড় সংলগ্ন একটি বসতবাড়ির উপর পড়লে ঘুমন্ত অবস্থায় মাটি চাপা পড়ে স্বামী-স্ত্রী দুইজন নিহত হয়। পরে স্থানীয় লোকজন মাটি সরিয়ে ফেলে নিহতদের লাশ উদ্ধার করে। এখনো বন্যার পানি না নামায় ইউনিয়নের অন্তত ১০ হাজার লোক পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এছাড়া প্রায় ৫ শতাধিক বসতঘরে বন্যার পানি ঢুকেছে। এসব পরিবারের সদস্যদের খাবার ও পানীয় জলের সংকট দেখা দিয়েছে।
বরইতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জালাল আহামদ সিকদার বলেন, ভারী বর্ষণের ফলে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে গোবিন্দপুর, ডেইংগাকাটাসহ ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৬টি ওয়ার্ড পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে ওই ইউনিয়নের অন্তত ২৫ হাজার লোক পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এছাড়া প্রায় দুই হাজার পরিবারের বসত বাড়িতে বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় রান্নাবান্না বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, সরকারি ত্রাণ সহায়তা হিসেবে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এক হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ পাওয়া গেছে। ওইসব বরাদ্দ ইউনিয়নের স্ব স্ব ওয়ার্ডের ইউপি সদস্যদের মাধ্যমে বানবাসি লোকজনের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে গিয়ে বানিয়ারছড়া-শান্তিরবাজার-কুতুববাজার সড়কে সব ধরণের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া বন্যায় ইউনিয়নে বেড়িবাধসহ অন্তত তিন কিলোমিটার কাঁচাপাকা সড়ক সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। পানিতে ডুবে থাকায় এ ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অঘোষিত বন্ধ হয়ে গেছে বলেও জানান তিনি।
লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা কাইছার বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে তার ইউনিয়নে পূর্বপাড়া, জহিরপাড়া, হাজীপাড়া, মÐলপাড়া ও চরপাড়া এলাকার অন্তত ১০ হাজার লোক পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এসব লোকদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হয়। পরে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ সহায়তা হিসেবে পাওয়া আড়াই মেট্রিক টন চাল ইউনিয়নের বানবাসি লোকজনের মাঝে ১০ কেজি করে বিতরণ করা হয়। তিনি আরও বলেন, বন্যা ও বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গিয়ে চকরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ও আমজাদিয়া ফাজিল মাদ্রাসাসহ বেশকিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অঘোষিত বন্ধ হয়ে গেছে।
এছাড়া কৈয়ারবিল, হারবাং, চিরিঙ্গা, সাহারবিল, পূর্ব ভেওলা, পশ্চিম বড় ভেওলা, বিএমচর, কোণাখালী, ডুলাহাজারা-খুটাখালী, ঢেমুশিয়া, বদরখালী ও চকরিয়া পৌরসভা এলাকায় হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূরুদ্দীন মোহাম্মদ শিবলী নোমান বলেন, ভারী বর্ষণের ফলে সৃষ্ট বন্যা পরবর্তী উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ সহায়তা হিসেবে বন্যাকবলিত ইউনিয়নগুলোতে ৪০ মেট্রিক টন চাল ও ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। এ কন্ট্রোল রুম থেকে বন্যাপরিস্থিতি সার্বিক অবস্থা মনিটরিং করা হচ্ছে। ইউএনও আরও বলেন, আরও ত্রাণ সহায়তার জন্য জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করা হয়েছে।