গাড়ি চলে, চলে না মিটার

22

মনিরুল ইসলাম মুন্না

নগরীতে সবুজ রঙের সিএনজিচালিত ট্যাক্সিতে মিটার লাগানো থাকলেও সেগুলো সচল নয়। যাত্রীদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করেন চালকরা। ফলে স্বল্প দূরত্বের যাত্রীদের সাথে ভাড়া নিয়ে চালকদের প্রতিনিয়ত চলছে বাকবিতন্ডা। এসব ট্যাক্সিকে মিটারে চলতে বাধ্য করতে একসময় ট্রাফিক বিভাগ ও বিআরটিএ’র ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করলেও এখন সে রকম কোনো কার্যক্রম নেই।
চালকরা বলছেন, বর্তমানে বাজারে সব জিনিসের দাম বেশি। তাই মিটারের ট্যাক্সি চালালে পোষায় না।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) ফয়সাল মাহমুদ পূর্বদেশকে বলেন, ট্যাক্সিগুলোকে মিটারে চলতে বাধ্য করা নিয়ে কোনো অভিযান বর্তমানে নেই। তবে যাত্রীরা অভিযোগ করলে অবশ্যই আমরা কঠোর হবো।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শাহরিয়ার মুক্তার বলেন, আমরা অবৈধ সিএনজি ট্যাক্সির বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা করলেও মিটার নিয়ে তেমন একটা চাপ প্রয়োগ করছি না।
এদিকে, গ্যাসের দাম কতটুকু বেড়েছে, কতটাকা ভাড়া বৃদ্ধি করা দরকার, তা নিয়ে একটি সাব কমিটি গঠন করেছে বিআরটিএ সদর দপ্তর। গত মঙ্গলবার পূর্বদেশকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন বিআরটিএ সদর দপ্তরের ইঞ্জিনিয়ারিং উইং এর পরিচালক শীতাংশু শেখর বিশ্বাস।
জানা যায়, বাংলাদেশে ২০০৩ সাল থেকে সিএনজি ট্যাক্সি চলাচল শুরু করে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত অর্থাৎ দুই দশক পর্যন্ত চলছে এসব সিএনজি ট্যাক্সি। প্রতিটি সিএনজি ট্যাক্সি কেনার পর ভাড়ার মিটার লাগানো বাধ্যতামূলক। বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ নতুন সিএনজি ট্যাক্সির ফিটনেস এবং ট্যাক্স টোকেন যাচাই করার সময় মিটারও যাচাই করে দেখে অনুমোদন দেয়। কিন্তু সেই পর্যন্তই সীমাবদ্ধ মিটারের কাজ। বিআরটিএ অফিস থেকে বের হওয়ার পর মিটারের মধ্যে বাতি জ্বললেও কোনো যাত্রী মিটারে যেতে চাইলে রাজি হন না সিএনজি ট্যাক্সিচালক।
সালাহউদ্দিন নাকে এক সিএনজি ট্যাক্সি মালিক পূর্বদেশকে বলেন, একটি নতুন মিটার স্থাপন করতে খরচ হয় ৫ হাজার ৮০০ টাকা করে। তবে মিটারগুলো নিম্নমানের। এসব মিটার বিআরটিএ কর্মকর্তা ও ঠিকাদার চুক্তি করে আমাদেরকে কিনতে বাধ্য করে। তিনমাসের মাথায় মিটার নষ্ট হয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে গ্যাসের দাম বেশি, সে অনুপাতে মিটারে চলতে গেলে কোনো চালক ট্যাক্সি চালিয়ে পোষাতে পারবে না। সে নিজে কি খাবে আর মালিককে কি দিবে ?
এদিকে বিআরটিএ’র তথ্য অনুযায়ী, নগরীতে ১৩ হাজার সিএনজি ট্যাক্সি চলাচল করে। প্রতিটি মিটারের দাম ৫ হাজার ৮০০ টাকা করে হলে মোট দাম দাঁড়ায় ৭ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। গত ২০১৯ সালে ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে কয়েকদিন মিটারের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হলেও কিছুদিন মিটার চালু রাখেন চালকরা। তবে যাত্রীরা মিটারে যেতে চাইলে রাজি হতো না।
চট্টগ্রাম অটোরিকশা-অটো টেম্পু শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ পূর্বদেশকে বলেন, মিটারগুলোর বাজারমূল্য ছিল অনেক কম। প্রতিটি মিটার মানভেদে আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত। কিন্তু কোম্পানিগুলো বিক্রি করেছে সর্বোচ্চ ৭ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত। কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে বিআরটিএ ও ট্রাফিক পুলিশ নিম্নমানের মিটার লাগানোর অনুমতি দিয়েছে। নিম্নমানের মিটার সংযোজনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি সিন্ডিকেট।
সরকারের সদিচ্ছার অভাবে মিটারে চলাচল বন্ধ রয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, এ বিষয়ে কঠোর আইন আছে। ট্যাক্সি মিটারে না গেলে ৫০ হাজার টাকার জরিমানা অথবা ৬ মাসের জেলের বিধান রয়েছে। কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই। আইনের প্রয়োগ হলে একদিনের মধ্যেই সিএনজি ট্যাক্সি মিটারে চলাচলে বাধ্য হবে।
নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি ট্যাক্সিতে মিটার লাগানো রয়েছে। তবে বেশির ভাগ মিটারই নষ্ট। অচল পড়ে রয়েছে। ট্যাক্সি চালকরা জানান, মিটারের নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর এখন আর মিটার নিয়ে মাতামাতি নেই। বিআরটিএ ও ট্রাফিক পুলিশও মিটারের জন্য চাপাচাপি করে না। দুই বছর ধরে মিটারে চলছে না সিএনজি ট্যাক্সিগুলো।
গত ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে বিআরটিএ, পুলিশ এবং সিএনজি ট্যাক্সি চালক-মালিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে নগরীর সিএনজি ট্যাক্সিতে মিটার সংযোজন করা হয়। এতে ভাড়ার হার পুনর্নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তীতে সে বছরের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে সিএনজি ট্যাক্সি মিটারে ভাড়া আদায়ের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু কথা আর কাজে কোনো মিল পাওয়া যায়নি।
চট্টগ্রাম মহানগরী অটোরিকশা অটোটেম্পো মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক টিটু চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেনন, মিটারে ভাড়ার হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ বছর আগে। এর মধ্যে গ্যাসের দাম চার দফায় বাড়ানো হয়েছে। বেড়েছে মালিকের জমাও। কিন্তু সেই অনুপাতে ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করা হয়নি। তাই মিটারে চলাচল করছে না সিএনজি ট্যাক্সি।
তিনি আরও বলেন, ২০১৫ সালে গ্যাসের দাম ছিল প্রতিঘন লিটারে ১৬ টাকা। বর্তমানে ৪৩ টাকা। মালিকের জমা ৬শ’ টাকা থেকে বেড়ে এখন ৯শ টাকা হয়েছে। ২০১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছিল। তখন প্রথম দুই কিলোমিটারে ৪০ টাকা এবং পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারের জন্য ১২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি ও মালিকের জমা বাড়ানোর সঙ্গে সামঞ্জস্য করে ভাড়া পুনর্নির্ধারণের দাবি রয়েছে আমাদের। খরচ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ভাড়ার হার পুনর্নির্ধারণের পর মিটারে চলাচলে আর কোনো আপত্তি থাকবে না। এ বিষয়ে সমিতির পক্ষ থেকে পূর্ণ সহায়তা দেওয়া হবে।
বিআরটিএ সদর দপ্তরের ইঞ্জিনিয়ারিং উইং এর পরিচালক শীতাংশু শেখর বিশ্বাস পূর্বদেশকে বলেন, গ্যাসের দামবৃদ্ধি ও নগরীর রুটের ভাড়া সমন্বয় করার জন্য বিআরটিএ’র পক্ষ থেকে সিএনজি’র বাজার দর যাচাই করা প্রয়োজন, এছাড়া গাড়ি আমদানিকারক ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন- ‘যন্ত্রাংশের দামও অনেকটা বেড়েছে’। সুতরাং এসবের বাজার দর যাচাই করার জন্য একটি সাব কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটি সুপারিশ আকারে আমাদের কাছে রিপোর্ট জমা দিবে। তারপর আমরা পুনরায় ভাড়া নির্ধারণ করতে পারবো। শীঘ্রই এ ঝামেলার একটা অবসান হবে।